ভোটার তালিকায় জেএসএস প্রধান সন্তু লারমার নাম, গোপনীয়তায় সেরেছেন অন্তুর্ভূক্তির কাজ
নিউজ ডেস্ক
বাংলাদেশে বসবাস করে, সরকারী নানা সুবিধা ভোগ করেও বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই সন্তু লারমার, দীর্ঘদির ধরে এমন সমালোচনার পর এবার ভোটার তালিকায় অন্তুর্ভূক্ত হলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি ৭৭ বছর বয়সী সাবেক গেরিলা নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা।
গত ২৯ আগষ্ট ২০২১ রাঙামাটি জেলা নির্বাচন অফিসে গিয়ে চরম গোপনীয়তায় নিজেকে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকায় অন্তুর্ভূক্ত করতে ছবি তোলাসহ আনুসাঙ্গিক সকল কাজ সম্পন্ন করেছেন বলে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে। মূলত জাতীয় পরিচয় পত্র ছাড়া করোনা টিকা নিতে না পারায় তিনি এই আবেদন করেছেন বলে বিশস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত দিয়ে জানা যায়, ২৯ আগষ্ট বিকেল ৪.৩০ মিনিটে সন্তু লারমা গাড়ী বহর নিয়ে সরাসরি রাঙামাটি জেলা নির্বাচন অফিসে আসেন। অফিস সময় ৫টা পর্যন্ত হলেও অতিরিক্ত ৩০ মিনিট যুক্ত করে সেখানে প্রায় এক ঘন্টা অবস্থানের পর ছবি তোলাসহ আনুসাঙ্গিক কার্যক্রম শেষে বিকেল ৫.৩০ মিনিটে সেখান থেকে পূণরায় গাড়ী বহর নিয়ে বের হয়ে যান। এসময় নির্বাচন কমিশন অফিসে কঠোর গোপনীয়তা ও কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৪৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী রাঙামাটি জেলার মহাপুরম এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন সন্তু লারমা। তার পিতার নাম চিত্তকিশোর চাকমা, মাতা সুভাষিণী দেওয়ান। বর্তমানে সন্তু লারমার বয়স ৭৭। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধের পানিতে মহাপুরম এলাকা ডুবে যাওয়ায় সন্তু লারমাদের পরিবার খাগড়াছড়ির পানছড়িতে আবাস গড়তে হয়। পরে ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তির পর আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হয়ে আবারও রাঙামাটি ফিরে আসেন তিনি। বর্তমানে তিনি রাঙামাটি শহরের কল্যাণপুর এলাকায় সরকারি বাসভবনে বসবাস করেন। আঞ্চলিক পারিষদের আইনে তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে নতুন ভোটার তালিক প্রনোয়নের দাবিতে দীর্ঘ দিন ভোটার হওয়া থেকে বিরত ছিলেন সন্তু লারমা। অংশগ্রহণ করেনি কোন জাতীয় নির্বাচনের ভোটে। কিন্তু দাবিপূরণ না হলেও অবশেষে জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্য আবেদন করতে হলো সন্তু লারমাকে।
সূত্র জানায়, সন্তু লারমা চেয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনের কর্তাদের তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আবেদন করতে। কিন্তু জেলা নির্বাচন কমিশন অফিস থেকে জানানো হয় টেকনিক্যালি সেটা সম্ভব নয়। এরপর তিনি নির্বাচন কমিশন অফিসে এসে আবেদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
রাঙামাটি জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. শফিকুর রহমান বলেন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আমাকে ফোন করে ভোটার হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন নির্বাচন থাকায় তাকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে গত ২৯ আগস্ট রাঙামাটি জেলা নির্বাচন অফিসে এসে নিজেকে ভোটার তালিকায় অন্তুর্ভুক্ত করতে ছবি তোলাসহ আনুসাঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করেছেন। জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য সন্তু লারমা আবেদন করলেও এখনো তা হাতে পাননি তিনি। তবে ভোটার তালিকায় ইতোমধ্যেই অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন।
তবে আবেদনের সময় ছবি তুলতে গিয়ে গায়ে থাকা শার্টের কালার ম্যাচিং করতে না পারায় তথ্যের সাথে ছবি যুক্ত করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এতে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতে পড়তে হয় এ নেতাকে। পড়ে বাজার থেকে একাধিক নতুন সার্ট কিনে এনে ছবি তোলার কাজ সম্পন্ন করেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, মূলত জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় কোভিড-১৯ এর টিকা নিতে পারছিলেন না মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার উত্তরসূরী সন্তু লারমা। ফলে বিদেশ ভ্রমণসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে বার বার আটকে যাচ্ছিলেন তিনি। ফলে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও অবশেষে নিজেকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করলেন।
আবেদনের সময় একাধিকবার উপস্থিত কর্মকর্তাদের কাছে এ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন তিনি। এ জন্য জেলা নির্বাচন অফিসসহ সবক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জোরালোভাবে এ সংক্রান্ত তথ্য বাইরে প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়।
জেলা নির্বাচন অফিসার মোঃ শফিকুর রহমান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তিনি (সন্তু লারমা) মূলত চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আমাকে ফোন করে ভোটার হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন নির্বাচন থাকায় তাকে ভোটার তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে কোন গোপনীয়তার কথা অস্বীকার করে নির্বাচন কর্মকর্তা জানান, একজন নাগরিক হিসেবে যে কেউ বৈধ কাগজপত্র নিয়ে আমাদের কাছে আসলে তাকেই আমরা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করবো এটাই স্বাভাবিক।
জেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য আবেদন করলেও এখনো তা হাতে পাননি তিনি, তবে ভোটার তালিকায় ইতোমধ্যেই অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেছেন।
উল্লেখ্য, জনসংহতি সমিতির সামরিক শাখা শান্তিবাহিনীর সাবেক প্রধান সন্তু লারমা ১৯৯৭ সালে সরকারের সাথে একটি চুক্তির মাধ্যমে অস্ত্র সমর্পন করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসেন। এরপর সরকার তাকে প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন। এরপর থেকে দীর্ঘ দুইযুগেরও অধিককাল প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করলেও কখনোই বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করেননি এবং ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হননি।
বিষয়টি নিয়ে ইতোপূর্বে সংবাদ প্রকাশিত হলে বিষয়টি সকলের নজরে আসে এবং ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দেয়। এমনকি জাতীয় সংসদেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়।
পার্বত্য বাঙালিদের দাবী, সন্তু লারমা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী নয়, বরং তিনি বাংলাদেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে জুম্মল্যান্ড নামক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা করছেন সন্তর্পনে। সেকারণে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের স্বীকৃতি স্বরূপ জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করেননি। তবে সন্তু লারমার কাছের লোকদের বক্তব্য, আন্দোলন, সংগ্রাম ও প্রতিবাদের অংশ হিসেবে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করেননি।
এ ব্যাপারে সন্তু লারমার বক্তব্য জানা যায়নি। তবে, ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর ঢাকায় হোটেল সুন্দরবনে জেএসএস আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এক গণমাধ্যমকর্মী তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি জবাবে বলেন, ”কাউকে জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে হবে বা তাকে ভোটার হতে হবে বাংলাদেশের আইনে এমন বাধ্যবাধকতা আছে কিনা? নাই। একইভাবে বাংলাদেশের সকলকে ভোটার হতে হবে এমন কোনো আইনী বাধ্যবাধকতা আছে কিনা? নাই।”
সন্তু লারমা বলেন, “এখানে আইডি কার্ড নেয়া না নেয়া যেমন সেই ব্যাক্তির ইচ্ছার উপর নির্ভর করে, তেমনি ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হওয়া না হওয়াও সেটা তার ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। আমার যেহেতু আইডি কার্ড এ পর্যন্ত প্রয়োজন হয় নাই সে জন্য আমি আইডি কার্ড করি নাই। আমি এই দেশের নাগরিক, আমি কেন এ পর্যন্ত ভোটার হই নাই এ প্রশ্নটা তো এখন পর্যন্ত কেউ জানতে চায় নাই শাসক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে।”