সংবিধান অমান্য করে আদিবাসী বিতর্কঃ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র
মোঃ সাইফুল ইসলাম
৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। প্রতিবছর সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করে কয়েকটি সংগঠন। তবে বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশে কোন আদিবাসী না থাকায় বহুবার প্রজ্ঞাপন জারি করে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহারের উপর বিধি নিষেধ জারি করেছিলো সরকার। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীগুলোর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নিয়ে বেশ কিছুবছর ধরেই আমাদের দেশে এক ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক চলছে। বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ক্ষুদ্র সম্প্রদায়/ গোষ্ঠীকে উপজাতি/ক্ষুদ্র জাতিসত্তা/নৃ-গোষ্ঠী বলে অভিহিত করা হয়েছে। উপজাতীয় সম্প্রদায়কে কোনো অবস্থাতেই আদিবাসী হিসেবে উল্লেখ না করার বিষয়ে সংবিধানে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
সংবিধানই যেখানে বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছে তাই এ নিয়ে কারো মধ্যে দ্বিধা থাকার কথা ছিল না। গণমাধ্যমে সংবিধান পরিপন্থি ‘আদিবাসী’শব্দ ব্যবহার বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর তথ্য অধিদপ্তর হতে সাংবাদিকদের পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু সংবিধান উপেক্ষা করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর ‘আদিবাসী’স্বীকৃতি আদায়ের জন্য মহলবিশেষ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, বাংলাদেশ নামের এই ভূখণ্ডে কখনোই কোনো আদিবাসীর বসবাস ছিল না। নৃতাত্ত্বিক সংজ্ঞায় আদিবাসী বা ‘এবোরিজিন্যালস’রা হচ্ছে— কোনো অঞ্চলের আদি ও অকৃত্রিম ভূমিপুত্র বা Son of the soil। প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ মর্গানের সংজ্ঞা অনুযায়ী আদিবাসী হচ্ছে, কোনো স্থানে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাসকারী আদিমতম জনগোষ্ঠী যাদের উত্পত্তি, ছড়িয়ে পড়া এবং বসতি স্থাপন সম্পর্কে বিশেষ কোনো ইতিহাস জানা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, তারা ওই অঞ্চলের অকৃত্রিম ভূমিপুত্র বা আদিবাসী নয়। বরঞ্চ বাঙালিরাই তাদের আগে সেখানে গিয়ে বসতি গড়েছেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের ২৩ক অনুচ্ছেদে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অন্যান্য বৈশিষ্ঠ্যপূর্ন আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষন, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে মর্মে সংবিধানে বিধান সন্নিবেশিত রয়েছে।
আদিবাসী ইস্যু নিয়ে সরকারী পদক্ষেপ ও রাষ্ট্রের অবস্থান
ক। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি তথা শান্তিচুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সাক্ষর করে এবং চুক্তির খ খন্ডের ০১ নং ধারায় জেলা পরিষদের আইনে `উপজাতি’ শব্দটি বলবৎ থাকিবে মর্মে উল্লেখ রয়েছে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির সাথে তৎকালীন শান্তিবাহিনী প্রধান সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে সম্পাদিত পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে অত্যন্ত সঙ্গতকারণে ‘উপজাতি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। চুক্তির ‘ক’ ধারার ‘১’ উপধারায় উল্লেখ করা হয়েছে—‘উভয়পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করিয়া এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিয়াছেন। চুক্তির ‘খ’ ধারার ‘১’ উপধারায় বলা হয়েছে—‘পার্বত্য জেলা পরিষদের আইনে বিভিন্ন ধারায় ব্যবহূত উপজাতি শব্দটি বলবৎ থাকিবে’। পার্বত্য শান্তি চুক্তির আগে প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থাকাকালে জনসংহতি সমিতির কোনো নেতার মুখে আদিবাসী শব্দের ব্যবহার শোনা যায়নি। চুক্তি পরবর্তী দশ বছরেও এ নিয়ে কেউ তেমন উচ্চবাচ্য করেননি। জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দ নিজেরাও কখনো আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করেন না। এক্ষেত্রে কিছুটা কৌশলী অবস্থান নিয়ে তারা কখনো উপজাতি আবার কখনো ‘জুম্ম জাতি’ উল্লেখ করেন।
খ। ২৫ জুলাই ২০০৫ তারিখে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের জাতিসংঘ অনুবিভাগ কর্তৃক উপজাতি ও আদিবাসী বিতর্ক অবসানের লক্ষ্যে বাংলাদেশের উপজাতি গোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত না করে উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে মর্মে নির্দেশনা জারী করা হয়।
গ। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের অপতৎপরতার প্রেক্ষিতে গত ০৯ সেপ্টেম্বর ২০০৮ তারিখ বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই মর্মে সরকারের উক্ত সুস্পষ্ট অবস্থান সম্পর্কে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয় কর্তৃক নির্দেশনা জারি করা হয়। তখন এই মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে ছিলেন চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রাষ।
ঘ। ২৮ জানুয়ারি ২০১০ তারিখ বালোদেশে বসবাসরত বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়কে কোন অবস্থাতেই যেন উপজাতি এর পরিবর্তে আদিবাসী হিসেবে উল্লেখ না করা হয় সে বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয় কর্তৃক নির্দেশনা জারি করে।
ঙ। ২৪ জুলাই ২০১১ তারিখে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে অনুষ্ঠিত আদিবাসী ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রনালয় সভা শেষে কার্যবিবরনী জারি করে।
চ। ১১ অক্টোবর ২০২০ তারিখ চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রাষ কর্তৃক নাগরিক সনদ প্রদানে ও দাপ্তরিক কাজে আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করার প্রেক্ষিতে আদিবাসী শব্দের পরিবর্তে সংবিধানে উল্লেখিত শব্দমালা ব্যবহারের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয় নির্দেশনা প্রদান করে। একইভাবে ২৩ অক্টোবর ২০১৭ তারিখ সকল সার্কেল চীফকে এ নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০১৪ সালের ১১ আগস্ট সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার রাঙ্গামাটিতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমি ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে যখন প্রথম আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপন করেছিলাম, তখন সন্তু লারমা (জনসংহতি সমিতির সভাপতি) বলেছিলেন এই দেশে কোনো আদিবাসী নেই, এখানে আমরা সবাই উপজাতি। জুম্ম জনগণের আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য আদিবাসী দিবস পালন করা হচ্ছে’। সাবেক প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের সময়ে আমি সন্তু লারমাকে বলেছিলাম এ সময়ে উপজাতির পরিবর্তে আদিবাসী বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে ফেলি, তখনও সন্তু লারমা রাজি হননি। সন্তু লারমা বলেছিলেন আমরা আদিবাসী নই, আমরা উপজাতি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশেষ উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকালে চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় সরকারিভাবেই লিখেছেন, বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই, কিছু জনগোষ্ঠী আছে উপজাতি।
মূলত এদেশে বিশেষ ভাবাদর্শ প্রচারে নিয়োজিত এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীর বক্তৃতা, বিবৃতিতে উপজাতির পরিবর্তে আদিবাসী শব্দটি শোনা যায়। তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত গুটিকয়েক সংবাদমাধ্যমও আদিবাসী শব্দের ব্যবহারে স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করে। এই প্রবণতা জোরালো রূপ ধারণ করে ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ‘আদিবাসী জনগণের অধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র ২০০৭’ গৃহীত হওয়ার পরপরই। আদিবাসীদের অধিকার আদায়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে তখন নতুন করে প্রাণপ্রবাহ সৃষ্টি হয়। যুগ যুগ ধরে উপজাতি হিসেবে পরিচিত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে হঠাৎ আদিবাসী অভিধা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে প্রচেষ্টা শুরু হয়, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর আদিবাসী স্বীকৃতির দাবির যৌক্তিকতা অনুধাবনের জন্য আদিবাসী শব্দের ব্যবহার বাংলাদেশের জন্য কতটা প্রাসঙ্গিক তা জানা অত্যন্ত জরুরি। প্রথমত, এক্ষেত্রে সাধারণত জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্র এবং আইএলও কনভেনশনের দোহাই দেওয়া হয়ে থাকে; কিন্তু জেনে রাখা ভাল যে, এই ঘোষণাপত্র এবং কনভেনশনের কোনোটির সঙ্গেই বাংলাদেশ নেই। আদিবাসী স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে পারে—এমন যুক্তি দেখিয়ে অনেকে বলেন, আদিবাসী আন্দোলনকারীরা প্রকারান্তরে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে মদদ দিচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, আদিবাসী শব্দটির সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সংজ্ঞাও আসলে নেই। জাতিসংঘের ফ্যাক্টশিটে বলা হয়েছে, আদিবাসীদের বৈচিত্র্যের কথা বিবেচনা করে, জাতিসংঘের কোনো সংস্থাই এই শব্দটির কোনো আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা প্রণয়ন করেনি। সংজ্ঞা স্পষ্ট না করেই আদিবাসীদের বিভিন্ন ধরনের অধিকার এবং সুবিধাদির কথা বিবৃত হয়েছে। এ কারণে আদিবাসী শব্দটিকে সুযোগসন্ধানী চক্র তাদের স্বার্থ আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
পৃথিবীতে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় যেসব দেশ জোরালো ভূমিকা পালন করছে সেসব দেশও আইএলও কনভেনশন-১৬৯ এবং জাতিসংঘ আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্র-২০০৭ গ্রহণ করেনি। তারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি করে এমন কোনো কিছু করতে নারাজ। এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকারের দূরদর্শিতার পরিচায়ক তা বলাই যায়।
২০০০ সালে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় বা ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর লোকেরা বাংলাদেশে নিজেদের আদিবাসী দাবি করে বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালন শুরু করে। পরবর্তীকালে তারা দেশের সমতলের বিভিন্ন উপজাতীয় ও তফসিলী জনগোষ্ঠীকেও এতে শামিল করে মোট ৪৫টি মতান্তরে ৭৫টি জনগোষ্ঠীকে একত্রে আদিবাসী আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে স্বীকৃতি দাবি করে। কিন্তু বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর এই আদিবাসী দাবি শুরুতেই দেশের মধ্যে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করে। কারণ, আভিধানিক ও নৃতাত্ত্বিক সংজ্ঞা অনুযায়ী আদিবাসী মানে আদিবাসিন্দা। আদিবাসী শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ Indigenous people. প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ মর্গানের সংজ্ঞানুযায়ী আদিবাসী হচ্ছে, ‘কোনো স্থানে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাসকারী আদিমতম জনগোষ্ঠী যাদের উৎপত্তি, ছড়িয়ে পড়া এবং বসতি স্থাপন সম্পর্কে বিশেষ কোনো ইতিহাস জানা নেই।’ মর্গান বলেন, The Aboriginals are the groups of human race who have been residing in a place from time immemorial … they are the true Sons of the soil..’ .(Morgan, An Introduction to Anthropology, 1972).
আদিবাসী বলার পেছনে আছে ষড়যন্ত্র
একই দেশ, একই জাতি। তবে আছে জাতিগত ভিন্ন গোষ্ঠী। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কিংবা উপজাতিরা। সবারই এক পরিচয়-তারা বাংলাদেশি। অথচ শান্তিপ্রিয় এই দেশটিতে প্রতিবছরই ৯ আগষ্টকে সামনে রেখে একটি গোষ্ঠী প্রতিবারই উপজাতি আর আদিবাসী নামে নতুন করে ষড়যন্ত্রের বীজ তৈরি করছে। আদিবাসী দাবির পেছনে স্বার্থান্বেষী এই গোষ্ঠীর রয়েছে গভীর ষড়যন্ত্র। উপজাতিদের উসকে দেওয়া, তাদেরকে বিপথে পরিচালিত করা। বাঙালিদের সঙ্গে বিভেদ তৈরি করা। কিন্তু তা কখনই সম্ভব নয়। কেননা রাঙামাটি, বান্দরবান আর খাগড়াছড়িতে রয়েছে পাহাড়ি বাঙালির অনন্য নজির। রয়েছে সম্প্রীতির চমৎকার উদাহরণ।
বিশ্বের সকল ঐতিহাসিক, নৃতাত্বিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর কেউই বাংলাদেশে স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাস করছে না। তাদের সকলেই বহির্বিশ্ব বিশেষ করে ভারত ও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বিভিন্ন সময়ে। এই অনুপ্রবেশও স্মরণাতীত কাল পূর্বে ঘটেনি। মাত্র কয়েকশ’ বছর পূর্বে ভারত ও মিয়ানমার থেকে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উপরন্তু বাংলাদেশের এই উপজাতীয় জনগোষ্ঠী তাদের আদিনিবাস ভারত ও মিয়ানমারেও আদিবাসী জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত নয়। যারা নিজেদের আদিবাসী দাবি করছে তাদের স্বার্থ একটাই, বাংলাদেশকে দ্বিখন্ডিত করা। আলাদা রাজ্য গড়ে তোলা।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রত্মতাত্ত্বিক গবেষণায় মানব বসতির যেসব তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে তা খৃস্টপূর্ব ১৬০০-৫০০ সালের পুরাতন। সে কারণে উপজাতিদের আদিবাসী আখ্যাদানকারী গবেষকগণ এখন ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) কনভেনশন-১৬৯’র আদিবাসী বিষয়ক সংজ্ঞার অপব্যাখ্যা করে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও তফসিলী সম্প্রদায়কে আদিবাসী দাবি করছেন ও দাবি করতে উদ্বুদ্ধ করছেন। এ বিষয়ে জাতিসংঘ ও এর অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে এ পর্যন্ত প্রধানত: তিনটি চার্টারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এগুলো হলো: ১৯৫৭ সালের ৫ জুন অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ৪০তম অধিবেশনে প্রদত্ত- Indigenous and Tribal Populations Convention, 1957 (No. 107), আইএলও’র ১৯৮৯ সালের ৭ জুন অনুষ্ঠিত ৭৬তম অধিবেশনে প্রদত্ত-Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169), এবং ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ৬১তম অধিবেশনে The United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples.
এখানে আইএলও’র প্রথম চার্টার দুটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। চার্টার দুটির শিরোনাম হচ্ছে- Indigenous and Tribal Populations Convention. অর্থাৎ আদিবাসী ও উপজাতি জনগোষ্ঠী বিষয়ক কনভেনশন। অর্থাৎ এই কনভেনশনটি আদিবাসী ও উপজাতি বিষয়ক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। কনভেনশনে পাস হওয়া ধারাগুলো একই সাথে আদিবাসী ও উপজাতি নির্ধারণ ও তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে, শুধু আদিবাসীদের নয়। অথচ বাংলাদেশে এই চার্টারকে আদিবাসীদের জন্য এক্সক্লুসিভ করে উপস্থাপন করা হয়।
এখানে উপজাতি ও আদিবাসীদের জন্য আলাদা সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169)- এর আর্টিকল ১ এর (a)-তে ট্রাইবাল বা উপজাতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘tribal peoples in independent countries whose social, cultural and economic conditions distinguish them from other sections of the national community, and whose status is regulated wholly or partially by their own customs or traditions or by special laws or regulations’. অর্থাৎ একটি দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্নতর যারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও আইন দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচলিত তাদেরকে উপজাতি বলা হয়। এখন আইএলও’র এই সংজ্ঞাটি যদি আমরা বাংলাদেশের চাকমা, মারমা, সাঁওতাল ও অন্যান্য সাবস্পেসিস সমূহের সাথে বিচার করি তাহলে পরিষ্কার বোঝা যায় তারা উপজাতি। কেননা, ট্রাইব শব্দের বাংলা অর্থ উপজাতি। কিন্তু বাংলাদেশের এক শ্রেণির মতলববাজ বুদ্ধিজীবী আইএলও কনভেনশনের আর্টিকেল ১-এ উপস্থাপিত ট্রাইবাল ডেফিনেশনটি সম্পূর্ণ চেপে গিয়ে শুধু ইনডিজিন্যাস পিপলের সংজ্ঞাটি উপস্থাপন করে থাকেন।
এখন আমরা ইনডিজিন্যাস পিপলের সংজ্ঞাটি বিশ্লেষণ করবো। Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169)-এর আর্টিকল ১-এর (বি)-তে ইনডিডজিন্যাস পিপল বা আদিবাসীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘peoples in independent countries who are regarded as indigenous on account of their descent from the populations which inhabited the country, or a geographical region to which the country belongs, at the time of conquest or colonization or the establishment of present state boundaries and who, irrespective of their legal status, retain some or all of their own social, economic, cultural and political institutions.’ অর্থাৎ আদিবাসী তারা যারা একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস করছে বা অধিকৃত হওয়া বা বর্তমান সীমানা নির্ধারণের পূর্বে বা উপনিবেশ সৃষ্টির পূর্ব থেকে বসবাস করছে। যারা তাদের কিছু বা সকল নিজস্ব সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও আইনগত অধিকার ও প্রতিষ্ঠানসমূহ ধরে রাখে।
আইএলও কর্তৃক উপজাতি ও আদিবাসী সংজ্ঞার মূল পার্থক্য হচ্ছে নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস বা অধিকৃত হওয়ার, বর্তমান সীমানা নির্ধারণের পূর্বে বা উপনিবেশ সৃষ্টির পূর্ব থেকে বসবাস। বাকি শর্তগুলো মোটামুটি উপজাতিদের মতোই। অর্থাৎ একজন উপজাতি আদিবাসী হবেন বা হবেন না উপরোক্ত শর্তের ভিত্তিতে। এছাড়াও রয়েছে ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ৬১তম অধিবেশনে The United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples চার্টার। এটি এক্সক্লুসিভলি আদিবাসীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট, উপজাতিদের নয়।
Indigenous and Tribal Populations Convention, 1957 (No. 107)- – ১৯৫৭ সালে পাস হলেও এ পর্যন্ত বিশ্বের মাত্র ২৭টি দেশ এই কনভেশন র্যাটিফাই করেছে। ১৯৭২ সালের ২২ জুন বাংলাদেশ এই কনভেনশন র্যাটিফাই করেছে। বাংলাদেশ এই কনভেনশন র্যাটিফাই করলেও তা ছিল বৈশ্বিক দৃষ্টিতে। কেননা, বাংলাদেশ কখনই এ দেশে কোনো আদিবাসী জনগোষ্ঠী আছে তা স্বীকার করেনি। বাংলাদেশের বাইরে উপমহাদেশের পাকিস্তান ও ভারত এই কনভেনশন র্যাটিফাই করেছে। যদিও এরই মধ্যে ৮টি দেশ এই কনভেনশনকে নিন্দা করে তা থেকে বেরিয়ে গেছে। অন্যদিকেIndigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169)- ১৯৮৯ পাস হলেও এখন পর্যন্ত বিশ্বের মাত্র ২৩টি দেশ এই কনভেনশন র্যাটিফাই করেছে। এরমধ্যে কনভেনশন-১০৭ থেকে বেরিয়ে আসা ৮টি দেশও রয়েছে। উপমাহদেশের একমাত্র নেপাল ছাড়া আর কোনো দেশ এই কনভেনশন র্যাটিফাই করেনি। বাংলাদেশের মতো উপমহাদেশীয় রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান Indigenous and Tribal Populations Convention, 1957 (No. 107)- – র্যাটিফাই করলেও কনভেনশন-১৬৯ র্যাটিফাই করেনি। কনভেনশন-১৬৯ অবশ্য ১০৭-এর মডিফিকেশন, তবুও তা আলাদা করে র্যাটিফিকেশন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, কনভেনশন-১৬৯ পাস হওয়ার পর কনভেনশন-১০৭ এর গুরুত্ব হারিয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক চার্টার কোনো দেশ র্যাটিফাই না করলে তা তার জন্য প্রযোজ্য নয়। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, আইএলও কনভেনশন ১০৭ ও ১৬৯ যে দেশগুলো র্যাটিফাই করেছে তাদের বেশিরভাগই আফ্রিকান ও দক্ষিণ আমেরিকান দেশ যাদের প্রধান বা অন্যতম প্রধান জনগোষ্ঠী বা গোষ্ঠীগুলো আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃত।
সত্যি কথা হলো, এক শ্রেণীর মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে আদিবাসী বলে ব্যাপকভাবে প্রচার করছে। এক কথা বললে এরা মূর্খ। এদের কারো অ্যানথ্রোপলজি, সোসিওলজি, ইতিহাস, ভূগোল ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, আদিবাসী ও উপজাতি সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। আর যারা জেনে বুঝে এ কাজ করছে তারা বিভিন্ন পারিতোষিক, বৃত্তি, উচ্চ বেতনের চাকরির লোভে করছে। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা, এনজিও কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণীর প্রভাবশালীরা দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এমন মিথ্যাচার করছে। কাজেই আমাদের সকলকে এই বিষয়টিতে সতর্ক হতে হবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের আদিবাসী বলা বন্ধ করতে হবে।
এদেশের সকল নাগরিকের মত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরাও বাংলাদেশের নাগরিক। তাদের অল্প কিছুদিন আগে থেকে দাবিকৃত আদিবাসী হওয়ার প্রবল ইচ্ছা আসলে জাতিসংঘের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রের বিভিন্ন ধারা থেকে ভবিষ্যতে ফায়দা লোটার কৌশল। এ কৌশলের ফাঁদে পা দেয়া ভয়ঙ্কর এবং বিপদজনক। কারণ, তাদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ তার এক দশমাংশ ভূমির মালিকানা হারাতে পারে। যার সাথে আমাদের ভৌগোলিক অখণ্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন জড়িত। আমাদের সকলকে সতর্ক হতে হবে এদেশের বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের আদিবাসী বলা বন্ধ করতে হবে। দেশ রক্ষার জন্য উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ধারণা সবাই মেনে নেবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় পার্বত্য এলাকা থেকে বাঙালিদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র হবে মর্মান্তিক।
নতুন বিতর্ক কেন?
বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী বর্তমানে দেশে আদিবাসীদের কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও বিভিন্ন সময় বিশেষ করে জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে ‘আদিবাসী’ শব্দটি দেশেও বার বার ব্যবহার হয়ে থাকে। পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এমনকি সরকারি ঘোষণায় আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের অনুষ্ঠান, আলোচনা ও টকশোতে ‘আদিবাসী’ শব্দটির ব্যবহার পরিহার করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। আলোচনা ও টকশোতে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের প্রতি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আদিবাসী শব্দটির ব্যবহার পরিহারের জন্য পূর্বেই সচেতন থাকতে অনুরোধ পর্যন্ত জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র কিন্তু জনবহুল রাষ্ট্র। জনসংখ্যার অধিকাংশ বাঙালি হলেও অনেকগুলো উপজাতি গোত্রও রয়েছে। বাংলাদেশের উপজাতি জনগোষ্ঠির সিংহভাগ পাবর্ত্য চট্টগ্রাম এবং ময়মনসিংহ, সিলেট ও রাজশাহী অঞ্চলে বসবাস করে। বিবিএস ১৯৮৪ সালের রিপোর্টে ২৪টি নৃতাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী এবং মোট জনসংখ্যা ৮,৯৭,৮২৮ জন বলা হয়েছে। উপজাতিগুলো হলো- সাঁওতাল, ওঁরাও, পাহাড়িয়া, মুন্ডা, রাজবংশী, কোঁচ, খাসিয়া, মনিপুরী, টিপরা, প্যাংখো, গারো, হাজং, মার্মা, চাকমা, তংচঙ্গা, চাক, সেন্দুজ, ম্রো, খিয়াং, বোম (বনজোগী), খামি, লুসাই (খুমি)।
বাংলাদেশের প্রায় এক-দশমাংশ জুড়ে চট্টগ্রাম। পার্বত্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ভূসম্পদ এ দেশের অন্তর্গত রাষ্ট্রীয় সম্পদ। এ সম্পদ ব্যবহার করে জনগণ দেশকে আরো অগ্রসর করতে পারে। কিন্তু সেখানে ক্রমাগত জাতিগত দ্বন্দ্ব, সংঘাত, অন্তঃকলহ ও বিরোধ, নেতৃত্বের টানাপড়েন ও রেষারেষি সাধারণ নিরীহ পার্বত্যবাসীর অশান্তির কারণ হয়েছে। অনগ্রসর, পিছিয়ে পড়া ও দরিদ্র মানুষ অনিরাপদ, উদ্বিগ্ন থাকে।
এসব সঙ্কট নিরসনের লক্ষ্যে ২ ডিসেম্বর, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও শান্তিপূর্ণ মনোভাবের প্রতিফলন তাতে ঘটেছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এ শান্তিচুক্তি বেশ প্রশংসিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি, অ-উপজাতি ও স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অগ্রগতি, বিকাশ, নিরাপত্তা, শান্তি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় যাবতীয় উদ্যোগ গৃহীত হয়। বিভ্রান্তি ও অনিরাপত্তার আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসে যুবশক্তি, বিচ্যুত মানুষ। শান্তিচুক্তির আওতায় জাতীয় জীবনের সঙ্গে অগ্রগতির স্বার্থে উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার অনুমোদিত হয়। পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও ইতিবাচক উদ্যোগে অংশগ্রহণের মাধ্যমে পার্বত্যবাসীর স্বার্থ উৎসাহিত হয়। পার্বত্য জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ও আওতায় জমি, পাহাড় ও বনাঞ্চলের অধিগ্রহণ-হস্তান্তরের সুযোগ সৃষ্টি হয়। সবাইকে মিলেমিশে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে শান্তির পক্ষে বসবাস করতে হবে। এটা পরীক্ষিত যে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সংঘাতকে আহ্বান করলে কোনো পক্ষেরই শান্তি আসবে না।
হারিয়ে যাচ্ছে উপজাতি সংস্কৃতি
চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা, যা বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের দশ ভাগের একভাগ। ১৩ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই পার্বত্য এলাকায় বাঙালিসহ বসবাস করছে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ১৪-১৫ লাখ মানুষ। এ এলাকার জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করে বিচ্ছিন্নতাবাদকে উস্কে দেয়ার জন্য বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল সদা তৎপর রয়েছে। এমনকি একশ্রেণীর প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা, মানবাধিকার সংস্থা এবং এনজিও কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণীর প্রভাবশালীরা স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য দেশের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন মিথ্যাচার করছে।
এসব উপজাতি, আদিবাসী কিংবা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর এই মায়াকান্নার পেছনে মূলত ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক, সামরিক এবং সর্বোপরি আধিপত্যবাদী স্বার্থই প্রবলভাবে কাজ করছে। প্রতিবছর ইস্টার সানডে, তীর্থউৎসব, ইংরেজী নববর্ষ ও ওয়ানগালা উৎসব পালন করে থাকে। কোচদের বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব হলো দুর্গাপূজা ও কালিপূজা উৎসব। এসব ধর্মীয় উৎসব ছাড়াও এ দুই সম্প্রদায়ই আরও অলাদা আলাদা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। কালের বিবর্তনে বর্তমান ডিজিটাল যুগে এসব গারো, হাজং ও কোচ উপজাতিদের হাজার বছরের ঐতিহ্য- সংস্কৃতি অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। বর্তমান ডিজিটাল যুগে উপজাতিদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। হারিয়ে যাওয়া বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে আছে (উপজাতিদের ভাষায়) মান্দিদামা, ক্রাম, খোল, নাগ্রা, জিপসি, খক, মিল্লাম, স্ফি, রাং, বাঁশের বাশি, আদুরী নামের বাদ্যযন্ত্র ও পোশাক দকবান্দা, দকশাড়ী, খকাশিল, দমী, রিক মাচুল আর কোচ উপজাতীদের রাংঙ্গা লেফেন ও আছাম হারিয়ে যেতে বসেছে।
চট্টগ্রামে বসবাসকারী চাকমা, মার্মা, ত্রিপুরা, মগসহ বিভিন্ন বসতি স্থাপনকারী উপজাতীয় ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোকে। একই সাথে এই গোষ্ঠী ও তাদের অর্থপুষ্ট এনজিও চক্র বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে যেমন- সিলেটের খাসিয়া, মণিপুরী, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের গারো, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুরের বনাঞ্চলের কুচ রাজবংশীয় বহিরাগত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে এদেশের আদিবাসী বলে প্রচার-প্রপাগান্ডা চালাতে শুরু করেছে এবং এর মাধ্যমে এদের এসব সংশ্লিষ্ট বৃহদায়তনের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের ভূমিপুত্র বলে প্রতিষ্ঠিত করার এক হীন চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে।
যদিও নৃ-তাত্ত্বিক ও জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাস বিশ্লেষণে দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত যে বাংলাদেশে বসবাসরত কোনো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী এদেশের আদিবাসী নয়। বরং তারা পার্শ্ববর্তী কিংবা বিভিন্ন দূরবর্তী স্থান থেকে দেশান্তরী হয়ে এদেশের নানা স্থানে অভিবাসিত হয়ে ক্রমে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বসবাস করে আসছে; কিন্তু কোনোক্রমেই বাংলাদেশে বসবাসকারী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, খাসিয়া কিংবা কুচ রাজবংশীয় সাঁওতালরা এদেশের আদিবাসী হতে পারে না।
২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৬১তম অধিবেশনে আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করলে ১৪৩টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে, ৪টি দেশ বিপক্ষে, ১১টি দেশ ভোট দানে বিরত এবং ৩৪টি দেশ অনুপস্থিত থাকে। ভোট দানে বিরত থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিরুদ্ধে ভোট দেয়া দেশগুলো হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় খুব সোচ্চার ও পৃষ্ঠপোষক দেশগুলোর বেশিরভাগই কিন্তু নিজ দেশের জন্য আইএলও কনভেনশন ১০৭, ১৬৯ ও জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক চার্টারের সিগনেটরি বা ভোটদানকারী নয়। এ থেকেই নিজ দেশের আদিবাসীদের জন্য তাদের নিজেদের অবস্থান এবং অন্যদেশের ‘আদিবাসীদের’ জন্য কুম্ভিরাশ্রু বর্ষণের মতলব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। উল্লিখিত চারটি দেশ শুধু ইউএন চার্টারের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে তাই নয়, বরং অধিবেশনে তাদের প্রতিনিধিরা এই চার্টারের প্রবল সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়েছে।
নিম্নে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্রের কিছু অনুচ্ছেদ নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
অনুচ্ছেদ-৩: আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার বলে তারা অবাধে তাদের রাজনৈতিক মর্যাদা নির্ধারণ করে এবং অবাধে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মপ্রয়াস অব্যাহত রাখে।
অনুচ্ছেদ-৪: আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার উপভোগের বেলায়, তাদের অভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় বিষয়ে তথা স্বশাসিত কার্যাবলীর অর্থায়নের পন্থা ও উৎস নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের স্বায়ত্তশাসন বা স্বশাসিত সরকারের অধিকার রয়েছে।
অনুচ্ছেদ-৫: আদিবাসী জনগণ যদি পছন্দ করে তাহলে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের পূর্ণ অধিকার রেখে তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক, আইনগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান অক্ষুন্ন রাখা ও শক্তিশালীকরণের অধিকার লাভ করবে।
অনুচ্ছেদ-৬: আদিবাসী ব্যক্তির জাতীয়তা লাভের অধিকার রয়েছে।
অনুচ্ছেদ-১৯: রাষ্ট্র আদিবাসীদের প্রভাবিত করতে পারে এমন আইন প্রণয়ন কিংবা প্রশাসনিক সংক্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পূর্বে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি নেয়ার জন্য তাদের প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে আন্তরিক সদিচ্ছার সাথে আলোচনা ও সহযোগিতা করবে।
উপরের অনুচ্ছেদগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পেলে বাংলাদেশের ভেতর কমপক্ষে ৪৫টি স্বায়ত্তশাসিত বা স্বশাসিত অঞ্চল ও সরকার ব্যবস্থার সৃষ্টি হবে। এসব অঞ্চলে সরকার পরিচালনায় তারা নিজস্ব রাজনৈতিক কাঠামো, জাতীয়তা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, আইনপ্রণয়ন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পাবে। এসব অঞ্চলের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের অধিকার ও কর্তৃত্ব ক্ষু্ন্ন হবে। প্রকাশ্যে বলা না হলেও এই আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বতন্ত্র জাতীয়তার মধ্যে লুকানো রয়েছে স্বাধীনতার বীজ। এই ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের ভূমির উপর যে অধিকারের কথা বলা হয়েছে তা আরো ভয়ানক। যেমন, অনুচ্ছেদ-১০: আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে তাদের ভূমি কিংবা ভূখন্ড থেকে জবরদস্তিমূলকভাবে উৎখাত করা যাবে না। আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে তাদের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি ছাড়া কোনভাবে অন্য এলাকায় স্থানান্তর করা যাবে না এবং ন্যায্য ও যথাযথ ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে সমঝোতা সাপেক্ষে স্থানান্তর করা হলেও, যদি কোন সুযোগ থাকে, পুনঃরায় তাদেরকে সাবেক এলাকায় ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
অনুচ্ছেদ-২৬: ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তাদের ঐতিহ্যগতভাবে মালিকানাধীন, দখলীয় কিংবা অন্যথায় ব্যবহার্য কিংবা অধিগ্রহণকৃত জমি, ভূখন্ড ও সম্পদের অধিকার রয়েছে।
২৬: ৩. রাষ্ট্র এসব জমি, ভূখন্ড ও সম্পদের আইনগত স্বীকৃতি ও রক্ষার বিধান প্রদান করবে। সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রথা, ঐতিহ্য এবং ভূমি মালিকানা ব্যবস্থাপনা মেনে সেই স্বীকৃতি প্রদান করবে।
অনুচ্ছেদ-২৭: রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে যৌথভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আইন, ঐতিহ্য, প্রথা ও ভূমি মালিকানাধীন ব্যবস্থাপনার যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান করবে।
অনুচ্ছেদ-২৮: ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি, ভূখন্ড ও সম্পদ যা তাদের ঐতিহ্যগতভাবে মালিকানাধীন কিংবা অন্যথায় দখলকৃত বা ব্যবহারকৃত এবং তাদের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি ছাড়া বেদখল, ছিনতাই, দখল বা ক্ষতিসাধন করা হয়েছে এসব যাতে ফিরে পায় কিংবা তা সম্ভব না হলে, একটা ন্যায্য, যথাযথ ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পায় তার প্রতিকার পাওয়ার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার রয়েছে।
২৮: ২. সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী স্বেচ্ছায় অন্য কোন কিছুতে রাজি না হলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে গুণগত, পরিমাণগত ও আইনি মর্যাদার দিক দিয়ে সমান ভূমি, ভূখন্ড ও সম্পদ অথবা সমান আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বা অন্য কোন যথাযথ প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
অনুচ্ছেদ-৩০: ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বেচ্ছায় সম্মতি জ্ঞাপন বা অনুরোধ ছাড়া ভূমি কিংবা ভূখন্ডে সামরিক কার্যক্রম হাতে নেয়া যাবে না।
অনুচ্ছেদ-৩২: ২. রাষ্ট্র আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি, ভূখন্ড ও সম্পদের উপর প্রভাব বিস্তার করে এমন কোনো প্রকল্প অনুমোদনের পূর্বে, বিশেষ করে তাদের খনিজ, পানি কিংবা অন্য কোনো সম্পদের উন্নয়ন, ব্যবহার বা আহরণের পূর্বে স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি গ্রহণের জন্য তাদের নিজস্ব প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে আলোচনা ও সহযোগিতা করবে।
উপর্যুক্ত অনুচ্ছেদগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী আদিবাসী স্বীকৃতি পেলে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশে নিজস্ব আইনে নিজস্ব ভূমি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মুষ্টিমেয় চিহ্নিত উপজাতিরা দাবি করছে ঐতিহ্য ও প্রথাগত অধিকার বলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল ভূমির মালিক তারা। একই অধিকার বলে সমতলের উপজাতীয় অধ্যুষিত এলাকার সকল ভূমির মালিকানা সেখানকার উপজাতীয়রা দাবি করবে। সেখানে যেসব ভূমি সরকারি ও ব্যক্তিগত মালিকানায় (আদিবাসী নয়) রয়েছে তা ফেরত দিতে হবে বা তার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এমনকি উপজাতীয়রা রাজি না হলে সমতল থেকে সমপরিমাণ সমগুরুত্বের ভূমি ফেরত দিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যেহেতু ঐ গোষ্ঠী সকল সামরিক স্থাপনা সরিয়ে নেয়ার দাবি জানাচ্ছে, সে কারণে সেখান থেকে সকল সামরিক স্থাপনা সরিয়ে নিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও অন্যান্য উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় যেসব বাঙালি বসতি স্থাপন করেছে তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। ইউএনডিপিসহ কিছু বৈদেশিক সংস্থা ইতোমেধ্যে প্রকাশ্যে এ দাবি তুলেছে।
ঘোষণাপত্রের ৩৬ অনুচ্ছেদটি আরও ভয়ানক। অনুচ্ছেদ-৩৬: ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর, বিশেষত্ব যারা আন্তর্জাতিক সীমানা দ্বারা বিভক্ত হয়েছে তারা অন্য প্রান্তের নিজস্ব জনগোষ্ঠী তথা অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংক্রান্ত কার্যক্রমসহ যোগাযোগ, সম্পর্ক ও সহযোগিতা বজায় রাখার ও উন্নয়নের অধিকার রয়েছে।
বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল উপজাতি জনগোষ্ঠীর মূল আবাস ভারত ও মিয়ানমার। সেখানে এখনো তাদের মূল জনগোষ্ঠী রয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশে তাদের খন্ডিত অংশ যদি আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পায় তাহলে ভারতের সমগ্র সেভেন সিস্টার্স রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা এবং মিয়ানমারের বিপুল এলাকা আদিবাসী ল্যান্ড স্বীকৃতি পাওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে। একই সাথে সীমান্তের উভয় পাড়ের অভিন্ন জনগোষ্ঠী যদি অভিন্ন রাজনৈতিক, সরকার কাঠামো কিংবা স্বাধীনতার দাবি তোলে তা আঞ্চলিক সমস্যায় রূপ নেবে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উল্লিখিত অধিকারসমূহ নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ বিশেষভাবে ভূমিকা রাখতে পারবে যা ৪২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। পূর্ব তিমুর, দক্ষিণ সুদান স্বাধীন করণে জাতিসংঘের ভূমিকা বিশ্বের দেশপ্রেমিক জনগণকে আতঙ্কিত করেছে। অধুনা পশ্চিম পাপুয়া নিউগিনিতেও জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
দেশের সংবিধানেও আদিবাসী বলে কোন শব্দ নেই। আদিবাসী ধারনাটি বিদেশ থেকে আসা এবং খুবই সাম্প্রতিক ভাবনা। বহুকাল থেকে পাহাড়িরা নিজেদের উপজাতি, পাহাড়ি বা জুম্মা জাতি ইত্যাদি নানা নামে পরিচিত করে এসেছে। বৃটিশরা তাদের নানাভাবে উল্লেখ করে এসেছে কিন্তু আদিবাসী বলে নাই। ইংরেজি Indigenous শব্দের মনগড়া বাংলা আদিবাসী করে নিয়েছে। অথচ ইন্ডিজেনাস শব্দের বাংলা তরজমাঃ দেশী,দৈশিক, দেশজ, স্বদেশী,স্বদেশজাত। আদিবাসী বললে ইতিহাসগত ভাবে কে আগে এসেছে তার শাব্দিক অর্থ এসে যায়। কিন্তু তারা বলে না, আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জীবনধারা ইত্যাদি বিবেচনায় আদিবাসী।
এই ভাষাগত অর্থে বা শাব্দিক অর্থে তারা’ উপজাতি ‘কে বর্জন করতে চায়। ‘উপ’ মানে অবনমন, নিচু,সেকেন্ডারী তাই ‘উপজাতি চলবে না। অথচ ‘উপজাতি বলতে রাষ্ট্রের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ভিন্ন একটা গোষ্ঠী এমন ধারনা বা পরিচিতি তারা মানে না। কিন্তু সরকারের দেওয়া ‘উপজাতি কোটায়’ চাকরি নিতে পিছপা হন না তারা। উপজাতি সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র, উপজাতি কাঠ ব্যবসায়ী, উপজাতি মৎসজীবি নামে নানান ধরনের সংগঠন আছে। আদিবাসী শব্দ কে আপাতত দৃষ্টিতে নিরীহ গোবেচারার মতো মনে হলেও তার অন্তর্নিহিত অর্থ ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সামাজিক এবং রাষ্ট্রের প্রায়োগিক ক্ষমতা বিবেচনায় নিলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্য পূর্ণ। এটা সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়।। এমনকি এদেশের অনেক বুদ্ধিজীবি, সংস্কৃতি কর্মী এবং সবজান্তা বাম নেতাদের কাছে কোন বিষয়ই নয়। যে মূহুর্তে সরকার জাতিসংঘের ঐ রেজুলেশনে স্বাক্ষর করবে সরকার স্বীকার করে নিলো তারাই ঐ এলাকার ভূমিপুত্র এবং ঐ এলাকার যাবতীয় সম্পদের উপর আদিবাসীর অধিকার নিরংকুশ। সরকার তাদের সম্মতি ছাড়া ঐ এলাকায় রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে কোন রকম সৈন্য চলাচল, কোন স্থাপনা নির্মান, রাস্তা ঘাট তৈরী কিছুই করতে পারবেন না। ঐ এলাকায় তারা চাইলে যে কোন রেজুলেশন পাস করে নিতে পারবে।
আদিবাসী বলার সাথে সাথে বাঙালীরা ঐ এলাকায় বহিরাগত, অনুপ্রবেশকারী হিসাবে তাদের দ্বারা চিহ্নিত হবে। তখন ৩০ লক্ষ প্রানের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিচয় বানে ভেসে আসা বাঙালী। অথচ সম্প্রতি ভারতের সাঁওতাল কন্যা রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী নিজেও নিজেকে ট্রাইবাল বলেছেন, ভারতের তাবৎ মিডিয়ার বচনেও তাই। কোথাও আদিবাসী পরিচয় নেই।
এদিকে, এবার আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসকে সামনে রেখে দিবসটি উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আয়োজিত টকশো-তে আদিবাশী শব্দটি ব্যবহার না করতে অনুরোধ জানিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রনালয়। গত ১৯ জুলাই ২০২২ মন্ত্রনালয়ের টিভি-২ শাখার উপসচিব শেখ শামছুর রহমান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে এ অনুরোধ জানানো হয়।
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত টিভি-২ শাখা, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা এর ১৫.০০.০০০০.০২৪.১৮.১৮৩.১৪.৫৯৬ নম্বর স্মারক মূলে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ছোট ছোট সম্প্রদায়/ গোষ্ঠীকে উপজাতি/ ক্ষুদ্র জাতিসত্তা/ নৃ-গোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ০৯ আগস্ট – ২০২২ তারিখ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত টকশোতে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার না করার বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে প্রচারের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
এর আগে, বাংলাদেশে বসবাসকারী ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমে ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার বন্ধ চেয়ে ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর তথ্য অধিদফতর থেকে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তাদের (পিআরও) কাছে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ক্ষুদ্র সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা বা নৃ-গোষ্ঠী বলে অভিহিত করা হয়েছে। দেশে বসবাসরত বিভিন্ন উপজাতীয় সম্প্রদায়কে কোনো অবস্থাতেই ‘উপজাতি’র পরিবর্তে ‘আদিবাসী’ হিসেবে উল্লেখ না করার বিষয়ে সংবিধানে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যমে সংবিধান পরিপন্থী ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার বন্ধে জনসংযোগ কর্মকর্তাদের নিজস্ব অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালনের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট সরকারি তথ্য বিবরণীতে ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার পরিহার করার অনুরোধ করেছিল সরকার।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট ও গণমাধ্যম হতে সংগৃহীত।