এক যুগ পর যৌথ নদী কমিশনের বৈঠককে অগ্রগতি হিসেবে দেখছে ভারত–বাংলাদেশ
![]()
নিউজ ডেস্ক
কোনো না কোনো কারণে দীর্ঘ ১২ বছর বন্ধ থাকার পর কোনো স্বীকৃত বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা নতুন করে শুরু হওয়াটাই অগ্রগতির লক্ষণ। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) ৩৮তম বৈঠককে দুই দেশের পানি মন্ত্রণালয় ও কূটনৈতিক মহল এভাবেই ব্যাখ্যা করছে। ভারতের রাজধানীতে সম্প্রতি জেআরসির তিন দিনের বৈঠক শেষে দুই দেশের সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগে এই বৈঠক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ইতিবাচক দিকটি বেশি করে উন্মোচিত করেছে।
ভারতের জলশক্তি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জেআরসির বৈঠক প্রসঙ্গে বলেন, ‘১৯৭২ থেকে শুরু করে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৩৮ বছরে জেআরসির বৈঠক হয়েছে মোট ৩৭ বার। এরপর দীর্ঘ এক যুগের বিরতি। কোনো না কোনো কারণে এই ১২ বছর জেআরসির বৈঠক বসেনি। অবশেষে গত ২৩ থেকে ২৫ আগস্ট ৩৮তম বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হলো। আমাদের কাছে তো বটেই, বাংলাদেশও বন্ধ বৈঠক নতুনভাবে শুরুর বিষয়টির গুরুত্ব মেনে নিয়েছে।’
ওই কর্মকর্তা বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, বৈঠক হওয়াটাই একটা অগ্রগতি। অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, অববাহিকা ব্যবস্থাপনা, পলিমাটি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী ও তার পানির গতিপ্রবাহ ঠিক রাখা, নদীর তীর রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সহমত হয়ে একযোগে এগোনো প্রভৃতি বিষয় বৈঠকে না বসলে সম্ভব হতে পারে না। বন্ধ থাকা জেআরসির আলোচনা নতুনভাবে শুরু হওয়াকে এই আলোকেই দেখতে হবে।
বাংলাদেশের মনোভাবও একই রকম। এটা ঠিক, তিস্তা এখনো অধরা। দীর্ঘ ১২ বছর বৈঠক না হওয়ায় তিস্তা চুক্তি অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। প্রতিবেশী এই দেশের কূটনীতিকেরা মনে করছেন, আলোচনা শুরু হওয়াটাই ইতিবাচক। বাংলাদেশের এক সূত্রের কথায়, ‘তিস্তা নিয়ে ভারত সরকারের বাধ্যবাধকতা আমরা বুঝি। কিন্তু এটাও বুঝি, চুপ থাকলে চলবে না। এবারের জেআরসির বৈঠকে তিস্তার থমকে থাকা বলটা তাই গড়ানো গেছে। ১২ বছর পর নতুনভাবে তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন ও যৌথ ব্যবস্থাপনায় আগ্রহ সঞ্চার করা গেছে। ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশই স্বীকার করেছে, জেআরসির পরবর্তী বৈঠকগুলো বোঝাপড়া অনুযায়ী বছর বছর যাতে অনুষ্ঠিত হয়, সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকবে। এটা অবশ্যই অগ্রগতি।’
কুশিয়ারা থেকে সেচের জন্য ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহারের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। ভারতীয় জলশক্তি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে গুরুত্বের সঙ্গে এই অন্তর্বর্তীকালীন অনুচুক্তির খসড়ার কথা লেখা হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বোঝাপড়া অনুযায়ী শেখ হাসিনার সফরে ওই অনুচুক্তি সই হওয়ার কথা। সিলেটের পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে সেচের জন্য ওই পানি অত্যন্ত জরুরি বলে বাংলাদেশের পক্ষে বৈঠকে স্বীকার করা হয়েছে। বাংলাদেশের এক সূত্রের কথায়, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিকতার খাতিরে ত্রিপুরার সাবরুম শহরবাসীদের পানের জন্য ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি দিতে আগেই রাজি হয়েছিলেন। কুশিয়ারার সম্ভাব্য পানি প্রত্যাহার সমঝোতা দুই দেশের সম্পর্কের দৃঢ়তারই পরিচয়।’ ওই সূত্রটি বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় সুসম্পর্ক এই পারস্পরিক দেওয়া–নেওয়ার ভিত।’
দেওয়া–নেওয়ার এই প্রয়োজনীয়তার অন্য একটি দিক এবারের জেআরসি বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ। এবারের বৈঠকে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন ও যৌথ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আরও আটটি নদী চিহ্নিত হয়েছে। সেগুলো হলো মহানন্দা, সারি–গোয়াইন, হাওড়া, সোমেশ্বরী, জাদুকাটা, জালুখালী–ধামালিয়া, ঢলাই ও পিয়াইন। এই নদীগুলোর মধ্যে মহানন্দা পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি–জলপাইগুড়ি হয়ে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। তারপর আবার বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। সারি–গোয়াইন নদী মেঘালয় দিয়ে সিলেটে মিশেছে সুরমায়।
কয়লাখনি ও সিমেন্ট কারখানার দূষণ সহ্য করতে হচ্ছে এই নদীকে। এবারের বৈঠকে অভিন্ন নদীগুলোর দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। সোমেশ্বরী, জালুখালি–ধামালিয়া, জাদুকাটা ও পিয়াইন নদীও বাংলাদেশে ঢুকেছে মেঘালয় থেকে। ফেনীর মতো ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছে হাওড়া ও ঢলাই নদী। বাংলাদেশে এসে হাওড়া মিশেছে তিতাস নদীতে, ঢলাই মিশেছে মনুতে। পানিবণ্টন চুক্তির কাঠামোর মধ্যে আগের নদীগুলোর সঙ্গে এই আটটি নদীও যুক্ত হচ্ছে। আপাতত এই নতুন নদীগুলোর পানি প্রবাহসহ যাবতীয় তথ্য–উপাত্ত দুই দেশ একে অন্যের সঙ্গে আদান–প্রদান করবে। নতুন এই আট নদীর খুঁটিনাটি বিষয় জেআরসির নদী বিশেষজ্ঞরা (টেকনিক্যাল কমিটি) বিবেচনা করবেন।
অভিন্ন ৫৪টি নদ–নদীর মধ্যে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে পূর্ণ হবে। তিস্তা চুক্তি থমকে আছে। সে কারণে থমকে আছে ফেনী চুক্তিও। কুশিয়ারার পানি প্রত্যাহার নিয়ে বোঝাপড়া আসন্ন। এই ৪টি নদীর বাইরে যৌথ ব্যবস্থাপনা ও পানিবণ্টনের আওতায় রয়েছে মনু, মুহুরী, দুধকুমার, ধরলা, খোয়াই ও গোমতী। সব মিলিয়ে আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে ১০টি নদী। তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আরও ৮টি। ভারতের জলশক্তি মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র প্রথম আলো বলেন, ‘এটা অবশ্যই অগ্রগতি। এভাবে একদিন সব অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন ও সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা চূড়ান্ত হবে। সে জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর জেআরসির বৈঠকে বসার ওপর দুই দেশই জোর দিয়েছে। দুই দেশ প্রতিবছর বৈঠকে সম্মতও হয়েছে।’
বাংলাদেশের এক সরকারি সূত্রের কথায়, ‘আলাপ–আলোচনা থেকেই বোঝা যায় সমস্যা ও তার সমাধানে সদিচ্ছার প্রকাশ কতটা। প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে এবারের বৈঠকে সেই সদিচ্ছার ছবি ভালোভাবে ফুটে উঠেছে।’