আদিবাসী স্বীকৃতি দাবি,সংবিধানের অবমাননা - Southeast Asia Journal

আদিবাসী স্বীকৃতি দাবি,সংবিধানের অবমাননা

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

তাপস হালদার

৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস।১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘ এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।বিশ্বের প্রায় ৯০ টি দেশে ৩৭০ মিলিয়ন আদিবাসী দিবসটি পালন করে থাকে।বাংলাদেশে সাংবিধানিক ভাবে কোনো আদিবাসী জনগোষ্ঠী নেই।তারপরও প্রায় ৩০ লক্ষ ক্ষুদ্র-জাতিগোষ্ঠির জনগণ এবং একশ্রেণির স্বঘোষিত প্রগতিশীল মানুষ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে আদিবাসী দিবস পালন করে থাকে।

সাধারণত কোনও একটি নির্দিষ্ট এলাকায় অনুপ্রবেশকারী বা দখলদার জনগোষ্ঠীর আগমনের পূর্বে যারা বসবাস করতো এবং এখনও করে।যাদের নিজস্ব ও আলাদা সংস্কৃতি,রীতিনীতি ও মূল্যবোধ রয়েছে।যারা নিজেদের আলাদা সামষ্টিক সমাজ-সংস্কৃতির অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যারা সমাজে সংখ্যালঘু হিসেবে পরিগনিত হয়,তারাই আদিবাসী।ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে,বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে কখনোই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল না।প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ মর্গান বলেছেন,কোনো অঞ্চলে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাসকারী আদিমতম জনগোষ্ঠী যাদের উৎপত্তি,ছড়িয়ে পড়া এবং বসতি স্থাপন সম্পর্কে বিশেষ কোনো ইতিহাস জানা নেই,তারাই আদিবাসী।’কিন্তু বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ইতিহাস থেকে জানা যায়,তারা এই অঞ্চলের অকৃত্রিম ভূমিপুত্র বা আদিবাসী নয়।বরং সেসব অঞ্চলে তাদের অনেক আগেই বাঙালিরাই বসতি স্থাপন করেছে।বাংলাদেশে যারা আদিবাসী দাবি করছেন তারা কয়েকশো বছর আগে ভারত ও মায়ানমার থেকে এদেশে এসে বসতি স্থাপন করেছে।তাদের পূর্বপুরুষ কখনোই এদেশের ভূমিপুত্র ছিল না।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদন হয়।শান্তি চুক্তিতেও উপজাতি শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।তখনও কেউ নিজেদের আদিবাসী দাবি করেন নি।চুক্তির ‘ক’ ধারার ‘১’ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘উভয় পক্ষ পার্বত্য চট্রগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করিয়া এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিয়াছেন।’

বাংলাদেশের যেসব জনগোষ্ঠী নিজের হঠাৎ করে আদিবাসী দাবি করছে সেটা বেশিদিন ধরে শুরু হয়নি।পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর ২০০০ সাল থেকে আদিবাসী দাবিতে মাঠে নেমেছে।তারা দীর্ঘদিন নিজ নিজ পরিচয়ের স্বীকৃতিই দাবি করে আসছিল।এরকম হঠাৎ করে আদিবাসী দাবির ইতিহাস পৃথিবীতে নেই।বিশ্বে অস্ট্রেলিয়ার এবরিজিন,যুক্তরাষ্ট্রের রেড ইন্ডিয়ান,নিউজিল্যান্ডের মাউরি,দক্ষিণ আমেরিকার ইনকা সম্প্রদায় সুপ্রাচীন কাল থেকেই বিশ্বে আদিবাসী হিসেবে সুপরিচিত। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর যারা উপজাতি বলে পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করতো তারাও শান্তিচুক্তির পর থেকে আদিবাসী স্বীকৃতির দাবিতে উঠেপড়ে লেগেছে।

বাংলাদেশের জাতীয় চার মূলনীতির অন্যতম বাঙালি জাতীয়তাবাদ।সাংবিধানিক কাঠামোতে বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়া আর কোনও জাতিসত্তাকে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।কারণ হলো বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬(২)-এ বলা হয়েছে,‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।’অন্যান্য সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ২৩(ক) ধারায় সংস্কৃতি সংক্রান্ত একটি অনুচ্ছেদ সংযোজন করে বলা হয়,‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা,নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ,উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’

পার্বত্য শান্তি চুক্তির আগে এই অঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিবেশ চলাকালে জনসংহতির নেতারা কখনো নিজেদের আদিবাসী হিসেবে দাবি করেননি।এক্ষেত্রে তারা ছিলেন কিছুটা কৌশল।তারা কখনো নিজেদের ‘উপজাতি’ আবার কখনো ‘জুম্ম’ জাতি হিসেবে উল্লেখ করেন। হঠাৎ করেই ২০০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি বা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর লোকেরা নিজেদেরকে আদিবাসী দাবি করে বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালন শুরু করে।পরবর্তীকালে তারা দেশের সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্টীদের একত্রিত করে তাদেরকেও আদিবাসী আখ্যা দিয়ে সরকারের কাছে স্বীকৃতির দাবি জানায়।শুরু থেকে তাদের দাবি বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।কারণ আদিবাসী শব্দের অর্থ আদি বাসিন্দা।কিন্তু তারা কেউ এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা নন।

অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন,তাদেরকে আদিবাসী স্বীকৃতি দিলে সমস্যাটা কি?এই সমস্যাটা জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসি সনদ।সেখানে যে ৪৬ টি অনুচ্ছেদ রয়েছে,তারমধ্যে অনেকগুলো অনুচ্ছেদ বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব,অস্তিত্ব,কর্তৃত্ব ও আত্মপরিচয়ের উপর সরাসরি আঘাত।ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কিংবা উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী স্বীকৃতি দেওয়া হলে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশে নিজস্ব আইনে তারা ভূমি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারবে।ভূমির মালিক হবে তারাই।একই অধিকার বলে সমতলের উপজাতিরা ভূমির মালিক হবে।তাহলে যেসব ভূমির মালিক সরকার ও ব্যক্তিগত মালিকানায় আছে তা ফেরত দিতে হবে বা উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে তখন সকল সামরিক স্থাপনা সরিয়ে নিতে হবে এবং সেসব বাঙালি বসতি স্থাপন করেছে তাদেরকেও সরিয়ে নিতে হবে।যা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব,অখন্ডতার বিরুদ্ধে হুমকি হবে।

বাংলাদেশের সংবিধানের কোথাও আদিবাসী শব্দের স্বীকৃতি নেই।দেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র সম্প্রদায়,ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে বলা হয়েছে।বাংলাদেশের সংবিধানে পরিস্কার ভাবে বলার পর এনিয়ে অযথা বিতর্ক করে লাভ।যারা এসব করেন তারা নিজের সর্বার্থসিদ্ধি চরিতার্থ করতেই করে থাকেন।বিদেশি কিছু এনজিও,এদেশের কিছু স্বঘোষিত সুশীল এদের উস্কানি দিচ্ছে।তাদের ফাঁদে পা দিচ্ছে কিছু আদিবাসী নামধারী নেতা।তারা সরাসরি দেশের সংবিধানকে অবমাননা করছেন।এদের উদ্দেশ্য শুভ নয়,রাষ্ট্রের অস্থিরতা তৈরী করাই মূল উদ্দেশ্য।

লেখক:সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
ই-মেইল :haldertapas80@gmail