গহিন পাহাড়ে তৈরি যেসব অস্ত্র ব্যবহার করছে সন্ত্রাসীরা, ২৩ দিন চলবে অভিযান

নিউজ ডেস্ক
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সহিংসতা রোধে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে দেশব্যাপী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ব্লক রেইড, কম্বাইন্ড (যৌথ) ও কম্বিং (চিরুনি) অভিযান চালানো হচ্ছে।
৯ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা ২৩ দিন চলবে এই অভিযান। এরইমধ্যে কক্সবাজার রামু থানার ঈদগড়ে তুলাতুলি এলাকার গহিন পাহাড়ে অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
এর আগে গত ৩ ডিসেম্বর বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বিশেষ নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এরপরই এসব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সংস্থাটি জানায়, চক্রটি গহিন পাহাড়ে অবস্থান করে অস্ত্র তৈরি ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা পরিচালনাসহ ডাকাতি, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় করে আসছিল। তাদের তৈরি করা অস্ত্র দেশের বিভিন্ন সন্ত্রাসী চক্রের কাছে সরবরাহ করা হতো।
বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) ভোররাতে কক্সবাজারে রামু উপজেলার ঈদগড়ের পাহাড়ে ১৬ ঘণ্টার বেশি সময় অভিযান চালিয়ে ওই অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পায় র্যাব-১৫ একটি টিম। এ সময় ঘটনাস্থল বেশ কিছু অস্ত্র ও তৈরির সরঞ্জামাদিসহ চার কারিগরকে আটক করে পরে গ্রেফতার দেখানো হয়। তবে এ সময় র্যাবের এই অভিযান টের পেয়ে পালিয়ে যায় কারখানাটির মালিক ও অস্ত্র তৈরির প্রধান কারিগর মনিউল হক। এ ছাড়া গ্রেফতার চার জন হলো, সাহাব উদ্দিন (৪০), লাল মিয়া (৫৮), মাঈন উদ্দিন (৪৩) ও জাফর আলম (৪১)।
এ প্রসঙ্গে র্যাব-১৫ অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ে কারাখানা গড়ে তুলে অবৈধ অস্ত্র তৈরি করে বিভিন্ন অপরাধীর কাছে বিক্রি করে আসছিল। এলাকাটি দুর্গম পাহাড়ি হওয়ায় তাদের অপকর্ম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির বাইরে ছিল। তারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম শেষে পুনরায় পাহাড়ের আস্তানায় আত্মগোপনে চলে যেতো। এটি তাদের বংশ পরম্পরা ব্যবসা। আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছি, যারা গ্রেফতার হয়েছে, তাদের বাবা-চাচারাও এই অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল।
পাহাড়ে তাদের কারখানার অবস্থান ছিল, তাহলে পার্টির সঙ্গে তারা কীভাবে আর্থিক লেনদেন করতো, এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, তারা অত্যন্ত এক্সপার্ট। যদিও কারিগর হিসেবে এখানে পলাতক কারখানাটির মালিক ও অস্ত্র তৈরির প্রধান মনিউল হকের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। গ্রেফতার চারজনের তিনজনই কারিগর। তাদের একজন পল্লিচিকিৎসা কাজে রয়েছে, তিনি মূলত বাইরে পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করে লেনদেন করেন। বাকিরা পাহাড়ে কারখানায় অবস্থান করে। তাদের সব পথ জানা আছে। তারা এমন কিছু অস্ত্র তৈরি করে, ছোট ছোট শর্টগান, যেগুলো একসঙ্গে তিন-চারটি শরীরে বহন করে চলাচল করতে পারে।
লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন আরও বলেন, সন্ধান পাওয়া কারখানাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা আরও কয়েকজনের ব্যাপারে তথ্য দিয়েছে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা। এ ছাড়া পাহাড়ি এলাকায় আরও কয়েকটি অস্ত্র তৈরির কারখানা থাকার তথ্যও পেয়েছি। তাদেরও খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সহিংসতা রোধে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এর আগে ৯ ডিসেম্বর থেকে সারা দেশে শুরু হয়েছে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশের বিশেষ অভিযান। চিহ্নিত সন্ত্রাসী, অস্ত্র বিক্রেতা ও নির্বাচনে সহিংসতা চালাতে পারে, এমন সব রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের তালিকা ধরে চলবে এসব অভিযান। ২৩ দিনের টানা এই অভিযানে অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চল। সীমান্ত হয়ে অবৈধ অস্ত্রের প্রবেশ রোধে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে অবৈধ অস্ত্রপাচারের রুটগুলোয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশ থেকে র্যাব ৬৪২টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। এর সঙ্গে জড়িত ৩১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে বিজিবি ৪৯টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৫৭টি বিভিন্ন ধরনের বন্দুক উদ্ধার করে। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা মহানগর এলাকা থেকে ডিএমপির বিভিন্ন ইউনিট ৭৩টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে ১৯টি বিদেশি পিস্তল রয়েছে। অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় হওয়া ৪২টি মামলায় ৭১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ২০২২ সালে উদ্ধার হয়েছিল মোট ৫ হাজার ৮৭৯টি।
অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি, অপারেশন্স) আনোয়ার হোসেন বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশ নিয়মিত অভিযান করে থাকে। নির্বাচনের আগে সন্ত্রাসীসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে যারা, তাদের গ্রেফতারে অভিযান জোরদার করা হয়। নির্বাচন সামনে রেখে সারা দেশেই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান জোরদার করতে বলা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিদের দ্রুত গ্রেফতারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে দেশব্যাপী বিশেষ অভিযান চলমান রয়েছে। এ ছাড়া জেলা পুলিশ সুপাররা নিজ নিজ এলাকায় অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে ব্লক রেইড, কম্বাইন্ড ও কম্বিং অপারেশন পরিচালনা করতে পারেন।