ভূমি দখলকে কেন্দ্র করে জেএসএসের অপপ্রচারে উত্তাল জুরাছড়ি, ঘটনা নিয়ে ভিন্ন মত স্থানীয়দের - Southeast Asia Journal

ভূমি দখলকে কেন্দ্র করে জেএসএসের অপপ্রচারে উত্তাল জুরাছড়ি, ঘটনা নিয়ে ভিন্ন মত স্থানীয়দের

পাহাড়ি ও বাঙ্গালীদের মধ্যে উত্তেজনা নিরসনে এগিয়ে আসে সেনাবাহিনী

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

ডেস্ক রিপোর্ট

পার্বত্য জেলা রাঙামাটি থেকে ৫৭ কিলোমিটারের দূরের উপজেলা জুরাছড়ি। সম্প্রতি একটি বসতবাড়ি নির্মানকে কেন্দ্র করে সেখানে স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙ্গালীদের মধ্যকার একটি ভুল বোঝাবুঝিকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সেখানকার পরিস্থিতি। সরকারী ভূমিকে দখলের পায়ঁতারা করছে একটি চক্র। আর পাহাড়ি-বাঙ্গালী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় এগিয়ে এসে ষড়যন্ত্রের বলি হতে হচ্ছে সেনাবাহিনীকে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি জেলার জুড়াছড়ি উপজেলা প্রকৃতির এক লীলাভূমি। যুগ যুগ ধরে এখানে বসবাস করছে পাহাড়ি ও বাঙালি। সম্প্রদায়িক হানাহানি বা পাহাড়ি-বাঙ্গালীদের মধ্যে কোন উত্তেজনা এখানে কখনোই দেখা যায় নি। ছিন্নমূল মানুষদের মধ্যে টিকে থাকার প্রতিযোগিতা চললেও তা কখনো বিভেদ বা সাম্প্রদায়িকতার রূপ নেয় নি এখানে।

তবে অতি সম্প্রতি এই উপজেলাতেই বেশ কয়েকটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে। সেই সাথে জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের। এরকমই একটি ঘটনা ঘটে গত ১৩ই জানুয়ারি শনিবার। সদরের ধামাই পাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে সরকারী জমিতে অস্থায়ী ঘর নির্মান করে বসবাস করা কয়েকটি বাঙ্গালী পরিবার সেদিন তাদের ঘরের একটা অংশ বর্ধিত করার উদ্যোগ নেয়। এতে বাঁধা দেয় কয়েকজন উপজাতি যুবক। এতেই বাঁধে মুল বিপত্তি।

যুগ যুগ ধরে এখানেই অস্থায়ী ভাবে বসবাস করে আসছে বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের লোকজন

জুরাছড়ির ধামাইপাড়া এলাকাবাসী জানান, ১৯৮৫ সালে জুরাছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জন্য স্থানীয় কল্প চাকমার কাছ থেকে ৩ একর ভূমি অধিগ্রহণ করে সরকার। নির্ধারিত অংশে হাসপাতাল গড়ে তোলা হলেও বাকি অংশে যুগের পর যুগ ধরে স্থানীয় কয়েকটি বাঙ্গালী পরিবার দোকান ও বসববাড়ি স্থাপন করে বসবাস করে আসছে। এছাড়াও বিভিন্ন পেশা ও প্রকৃতির লোকজন জায়গাটি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে থাকে। সেদিন নিজেদের বসতবাড়ি সংস্কার ও বর্ধিত করতে গেলে স্থানীয় চিহ্নিত জেএসএস (সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি) সদস্য হিমায়ন চাকমার নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন উপজাতি যুবক বাঁধা দেয়। এতে সেখানে দুপক্ষের মধ্যেই বাকবিতন্ডতা থেকে হাতাহাতি হয়। পরে আরো কয়েকজন জেএসএস সদস্য এসে বাঙ্গালী যুবকদের মারধর করে গুরুতর জখম করে।

আরো পড়ুন: রাঙামাটিতে বাঙ্গালি কিশোরীকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ চাকমা যুবকের বিরুদ্ধে

জানা যায়, এর নেপথ্যে রয়েছে রাঙামাটির জনৈক জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা। দীর্ঘদিন যাবত রাস্তার পাশের খাস জায়গা হিসেবে পড়ে থাকা ও সম্প্রতি কয়েক কোটি টাকা মূল্য হওয়ায় উক্ত জায়গার উপর নজর পড়ে তার। সেজন্য তিনি আগে থেকে সেখানে বসবাস করা বাঙ্গালীদের উচ্ছেদের জন্য স্থানীয় জেএসএস সদস্য হিমায়ন চাকমাকে টাকা-পয়সা দিয়ে সেখানে পাঠায়। হিমায়ন চাকমা ঘটনাস্থলে গিয়ে বাঙ্গালীদের হত্যা ও গুম করার হুঁমকি দিলেও স্থানীয়রা বিষয়টি সাধারণভাবেই সমাধানের চেষ্টা করেন। কিন্তু হিমায়ন চাকমা ও তার সঙ্গীরা ক্ষিপ্ত হয়ে বাঙ্গালীদের মারধর শুরু করে। এতে গুরুতর আহত হন একজন বাঙালি যুবক।

জেএসএস এর মারধরে আহত হন এক বাঙ্গালী যুবক

সংবাদ পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় যক্ষাবাজার আর্মি ক্যাম্পের একটি টহল দল। উক্ত টহল দল প্রথমেই উত্তেজনা সৃষ্টিকারী তৃতীয় পক্ষকে আলাদা করেন এবং ক্যাম্পে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে, জোন অধিনায়ক নিজে উক্ত স্থানে গিয়ে স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠদেরকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষে সমস্যাটি সমাধান করার জন্য অনুরোধ করেন।

এদিন যক্ষাবাজার আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে আসা ছয় জন ব্যক্তির সাথে কথোপকথন সাপেক্ষে জানা যায়, তাদের সবাইকে আঞ্চলিক স্বার্থান্বেষী দল জেএসএস ইন্ধন যুগিয়ে উক্ত স্থানে প্রেরণ করেন এবং তারা বিষয়টি না বুঝে ঘটনায় লিপ্ত হয়ে যান। তিনজন ব্যক্তির বিশেষ কোনো ভূমিকা না থাকায় কেন তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয় ক্যাম্প থেকে। অপর তিনজন ব্যক্তি, যারা মারামারি এবং উত্তেজনাকর বক্তব্য প্রদান করেন তাদেরকে বলা হয় আহত বাঙালি ব্যক্তির সাথে আলোচনা সাপেক্ষে বিষয়টি সমাধান করার জন্য। এই প্রেক্ষিতে, বয়োজ্যেষ্ঠদের উপস্থিতিতে চারটি পরিবার তাদের মনোমালিন্য সুরাহা করেন।

জানা যাচ্ছে, স্থানীয়দের পরামর্শে বিষয়টি সুরাহা করেও বিপদে স্থানীয় উপজাতিরা। জেএসএস এর আক্রোশে পড়ার ভয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তারা। অপরদিকে, একটি আঞ্চলিক স্বার্থান্বেষী মহল এর কারণে সত্য ঘটনা না জেনে, পাহাড়ি-বাঙ্গালী সাম্প্রদায়িকতার মিথ্যা প্রচারণায় স্তম্ভিত এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে জুড়াছড়িবাসী বাঙ্গালীরাও।

এর আগে, নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করার অপরাধে গত ১১ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে উপজেলা সদরের মোহনা আবাসিক ভবনে বসবাসকারী এক উপজাতি শিক্ষিকার বাইক পুড়িয়ে দিয়েছিলো জেএসএস সন্ত্রাসীরা।

এছাড়া, গত ২৯ সেপ্টেম্বর শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ধামাইপাড়া যক্ষাবাজার এলাকায় চাকমা সম্প্রদায়ের এক যুবকের বিরুদ্ধে স্থানীয় বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধি কিশোরীকে ধর্ষণচেষ্টার ঘটনাও ঘটেছিলো। এ ঘটনার পর অভিযুক্ত ধর্ষক সুনীল কুমার চাকমা (৪৬)কে আটক করে থানা পুলিশের নিকট হস্তান্তর করা হয় সেসময়।

জানা গেছে, রাঙামাটির জুরাছড়ি উপজেলা সদরের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সংলগ্ন এলাকাটি জেএসএস অধ্যুষিত। সেখানে গুটিকয়েক বাঙ্গালী বসতি রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে জেএসএস সেখানে নানা অপকর্ম করে আসলেও জেএসএস সন্ত্রাসীদের ভয়ে এসব বিষয়ে কেউ মুখ খোলেন না।

আরো পড়ুন: রাঙামাটির জুরাছড়িতে শিক্ষিকার বাইক পোড়াল জেএসএস সন্ত্রাসীরা

ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করার অজুহাতে এক উপজাতি শিক্ষিকার বাইক পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ধামাচাপা দিতেই নতুন করে ভূমি দখলের নাটক সাজিয়ে জেএসএস সন্ত্রাসীরা বাঙ্গালী ও সেনাবাহিনীকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে।

স্থানীয়রা বলছেন, যুগের পর যুগ জুরাছড়ির পাহাড়ি-বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের সহাবস্থান থাকলেও সম্প্রতি জেএসএস সন্ত্রাসীরা বেশ কয়েকটি অপকর্ম করে এলাকায় পাহাড়ি জনগনের মাঝে এক ধরনের অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। এসব অসন্তোষ কাটাতেই তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি-বাঙ্গালী জনগনের মাঝে বিরোধ সৃষ্টি করে সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে অপপ্রচার চালিয়ে পাহাড়িদের সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করছে জেএসএস।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জুরাছড়ি বাজারের এক চাকমা সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ী জানান, নির্বাচনের আগে থেকেই সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস জুরাছড়ি জুড়ে এক প্রকার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে রেখেছে। কেউ কিছু বললেই, তাকে গুম-খুনের ভয় দেখানো হচ্ছে। এলাকাটি জেএসএস অধ্যুষিত হওয়ায় কেউ প্রতিবাদও করছে না। ভূমি নিয়ে স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙ্গালীদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। তৃতীয় পক্ষের উসকানীতে জেএসএস এসব নাটক সাজাচ্ছে।

আরেক ব্যবসায়ী জানান, সেনাবাহিনীর যক্ষাবাজার ক্যাম্পের সদস্যদের টহলের কারণে সম্প্রতি কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে জেএসএস কে। যার কারণে এবার সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে একটি অপপ্রচার শুরু করেছে জেএসএস। তবে সেনাবাহিনীর জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ডের কারণে এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে সম্প্রীত উন্নয়ন হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সুরেশ কুমার চাকমা উক্ত বিবাদমান ভূমিটিকে হাসপাতালের সরকারী জায়গা বলে স্বীকার করলেও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ভয়ে বিস্তারিত কথা বলতে রাজি হন নি।