পাহাড় সেজেছে কাজু গাছে, মিলবে বাদাম ৩৬ মাসে - Southeast Asia Journal

পাহাড় সেজেছে কাজু গাছে, মিলবে বাদাম ৩৬ মাসে

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে কাজুবাদাম চাষ। পাবর্ত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ে গড়ে উঠছে নিত্য নতুন বাগান। আবাদের আওতায় আসছে আনাবাদি জমি। কয়েক বছর আগেও মাত্র দুই হাজার হেক্টর জমিতে কাজুবাদামের বাগান থাকলেও এখন তা বেড়ে হয়েছে পাঁট হাজার হেক্টর। দেশে এখন কাজুবাদামের বাগানও রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার।

চাষীরা বলছেন, দেশে উৎপাদিত কাজুবাদামের আকার বেশ বড় ও সুমিষ্ট। ভবিষ্যতে দেশ থেকে কাজুবাদাম রফতানির সম্ভাবনাও রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

পাহাড়ে যারা বাগান করছেন তাদের কারও বাগানের আকার ১০ একর আবার কারও ১০০ একর। কেউ কেউ যৌথভাবে কাজুবাদাম ও কফির বাগান করছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও কয়েক বছর আগে ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় চলছে প্রর্দশনী, দেওয়া হচ্ছে নানান সহায়তা। ২০২১ সালের জুনে শুরু হওয়া পাঁচ বছর মেয়াদী এই প্রকল্পটির কাজ ২০২৫ সালে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিফতরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘দেশে কাজুবাদামের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। পাহাড়ে এখন অনেকেই কাজুবাদাম ও কফি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। দেশে উৎপাদিত হওয়া কাজুবাদাম আকারে বেশ বড় ও সুমিষ্ট।’

তিনি বলেন, ‘তিন বছর আগে আমাদের প্রকল্প শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত পারফরমেন্স খুব ভালো। পাঁচ বছর পর থেকে কাজুবাদামের পূর্ণ ফল পাওয়া যায়। তিন বছর আগে যেসব চারা লাগানো হয়েছিল, সেখান থেকে এখন ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে। প্রকল্প শুরু হওয়ার পর যেসব বাগান করা হয়েছে সেগুলো থেকে পরিপূর্ণ উৎপাদন পাওয়া যাবে চার থেকে ছয় বছরের মধ্যে। সবমিলিয়ে কয়েক বছরের মধ্যেই কাজুবাদাম ও কফির উৎপাদন আরও বেশি দৃশ্যমান হবে।’

‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকল্প শুরুর আগে দেশে কাজু বাদামের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৫০০ টন। সেই উৎপাদন এখন বেড় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭০০ টনে। বর্তমানে কাজুবাদামের প্রায় ৫ হাজার বাগান রয়েছে, প্রদর্শনীর আওতায় ২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে কাজুবাদামের বাগান করা হয়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগেও দেশে বাগান রয়েছে। উদ্যোক্তারা প্রায় এক হাজার হেক্টর জমিতে বাগান করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘দেশে কাজুবাদামের চাহিদা প্রচুর। বাগানের বয়স দুই থেকে আড়াই বছর হওয়ার পর থেকেই উৎপাদন শুরু হয়। আগামী বছর থেকে দেশের বাগানগুলোতে কাজুবাদামের উৎপাদন শুরু হবে। আশা করা যাচ্ছে, কয়েক বছরের মধ্যেই ১০ থেকে ১২ হাজার টন বাদাম উৎপাদন করা যাবে। দেশে কাজুবাদামের চাহিদা রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার টন।’

তিনি আরও বলেন, ‘নতুন পুরাতন মিলে দেশে প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে এখন কাজুবাদামের বাগান রয়েছে, যা প্রকল্প শুরুর আগে ছিলে ২ হাজার ২০০ হেক্টর। ধীরে ধীরে বাগান বাড়ছে। পার্বত্য অঞ্চলে কাজুবাদামের চাষ হয়ে থাকে বেশি। পাহাড়ে এখন দুই লাখ হেক্টর জমি পতিত রয়েছে। আমাদের টার্গেট এখন সেই জমিতে কাজুবাদাম আবাদ করা। কাজুবাদামের বাগানের নিচে অর্থাৎ মাটিতে আমরা এখন আনারস ও জুম চাষ করছি।’

যা বলছেন চাষীরা
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইসারি ইউনিয়নে ১০০ একর জমিতে কাজুবাদামের বাগান করেছেন ওয়াজেদুল ইসলাম মবিন ও তার তিন বন্ধু। ‘কাজু অ্যান্ড কফি এগ্রো’ নামের ওই বাগানে এখন ১৪ হাজার কাজু বাদামের গাছ রয়েছে। ২০২১ সালে শুরু হওয়া বাগানটিতে গত বছর প্রথম ফুল এসেছিল। বাগানটি থেকে এ বছর প্রথম বাদাম পাওয়া যাবে।

বাগানের উদ্যোক্তা ওয়াজেদুল ইসলাম মবিন বলেন, ‘আমরা এখন একটি স্বপ্নের মধ্যে আছি। এ বছর বোঝা যাবে কী পরিমাণ ফল হয়। গত বছর বাগানে প্রথম ফুল এসেছিল। ফলন ভালো পাওয়ার জন্যে প্রথম বছরের ফুল কেটে দিয়েছিলাম। তবে কয়েকটি গাছের ফুল রেখেছিলাম। সেই গাছগুলো থেকে যে কাজু বাদাম পাওয়া গেছে, সেগুলো আকারে খুব বড় এবং সুমিষ্ট ছিল। আমরা উচ্চফলনশীল কম্বোডিয়ান এম-২৩ জাতের কাজু বাদাম আবাদ করেছি। সবমিলিয়ে আশা করিছি বাগানটি থেকে কাজুবাদামের ভালো ফলন পাওয়া যাবে, আমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কাজুবাদামের উন্নয়নে সরকারের একটি প্রকল্প রয়েছে। সেই প্রকল্প থেকে বেশ সহায়তা পেয়েছি। ১০০ একর জমিতে সাত হাজার গাছ নিজেরা লাগিয়েছি, আট হাজার গাছ প্রকল্পের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। সব মিলেয়ে এখন বাগানে ১৪ হাজার গাছ রয়েছে। প্রকল্প থেকে সোলার প্যানেল দেওয়া হয়েছে, তা দিয়ে বাগানে সেচ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কাজু বাদাম চাষ সম্ভাবনায়। আবার সরকারের পক্ষ থেকেও সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সবমিলিয়ে এখন অনেকেই কাজু বাদাম চাষে এগিয়ে আসছেন। ধীরে ধীরে পাহাড়ে কাজু বাদাম বাগানের প্রসার ঘটছে।’ মবিন আরও জানান, বাগানে শুধু কাজুবাদামই নয়, সেইসঙ্গে কফিও আবাদ করা যাচ্ছে। বাগানটিতে আট হাজার কফির চারা লাগানো হয়েছে। বাগানটি নিয়ে এখন তারা বেশ আশাবাদী।

একইভাবে রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলার নতুনপাড়ায় ৪০ একর জমিতে কাজুবাদামের বাগান গড়ে তুলছেন আসাদুল্লাহ হিল গালিব। তিনি বলেন, ‘২০২১ সালে বাগান শুরু করি। ৪০ একর জমির মধ্যে ৬০ শতাংশ জমিতে ইতোমধ্যে চারা লাগানো শেষ হয়েছে। বাকি ৪০ শতাংশ জমিতে এ বছর চারা লাগাব। ইতোমধ্যে প্রায় তিন হাজার চারা রোপন করেছি, এ বছর আরও আড়াই থেকে তিন হাজার চারা রোপনের লক্ষ্য রয়েছে। সব মিলিয়ে ৪০ একর জমিতে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার কাজুবাদামের চারা লাগানো সম্ভব হবে।’

জমির মালিকের সঙ্গে মুনাফা বণ্টনের শর্তে সাড়ে ২২ বছরের জন্য ওই জমিতে কাজুবাদামের চাষাবাদ চলছে বলেও জানান বাগান মালিক গালিব। তবে পাহাড় পরিষ্কা করে বাগান করতে বেশ বেগ পোহাতে হয়। কারণ পাহাড় প্রতিনিয়তই জঙ্গলে ভরে উঠে। আর পাহাড় পরিষ্কার করতেই বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করতে হয়েছে বলেও জানান তিনি।

আসাদুল্লাহ হিল গালিব বলেন, ‘গতবছর বাগানের গাছ থেকে কিছু ফল পাওয়া গেছে। চারা লাগানোর তিন বছর পর থেকে ফল আসে। চতুর্থ বছর থেকে মূলত উৎপাদন শুরু হয়। আশা করছি আগামী বছর থেকে ভালো ফলন পাওয়া যাবে। আর এ বছর অন্তত ২৫০ থেকে ৩০০ পোক্ত গাছে ফেব্রুয়ারিতে ফুল আসতে পারে। তা থেকে বেশ ভালো ফলন পাওয়া যাবে হয়তো।’

তিনি আরও বলেন, ‘কাজুবাদামের নিচের অংশ পাহাড়িরা যাকে টাম বিচি বলে অর্থাৎ যা কাঁচা কাজু বাদাম। এগুলো কয়েকবছর আগে ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হতো, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি। অর্থাৎ দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। মাঝে বেশকিছু কৃষক কাজু বাদাম চাষ থেকে সরে এসেছিল, বাগান কেটে ফেলেছিল। কিন্তু এখন আবার বাগান করতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।’

কাজুবাদামে চাষে সম্পৃক্ত এই উদ্যোক্তা আরও বলেন, ‘কাজুবাদামের একটি গাছ থেকে প্রথম অর্থাৎ তৃতীয় বছরে ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম ফল পাওয়া যায়। চতুর্থ বছর প্রতিটি গাছ থেকে এক থেকে দেড় কেজি ফল পাওয়া যায়। আর গাছের বয়স পূর্ণ হলে অর্থাৎ পাঁচ বছর থেকে ৫ থেকে ১৫ কেজি করে ফল পাওয়া যায়। এভাবে ৪০ থেকে ৪৫ বছর পর্যন্ত ফল দিতে সক্ষম কাজু বাদামের গাছগুলো। সবমিলেয় এটি একটি সম্ভাবনাময় ফসল। আর সরকারের পক্ষ থেকেও এখন কাজুবাদাম চাষে নানাভাবে সহায়তা করা হচ্ছে। আমাদের বাগানের ৪০ একর জমিতে ৪ টি পাহাড়। একটির সঙ্গে আরেকটি পাহাড় যুক্ত।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রকল্পের পক্ষ থেকে আমাকে সোলার পাম্প ও ট্যাংক দেওয়া হয়েছে। সার ও বীজ দিয়েও সহায়তা করা হয়েছে। বাকি তিনটি পাহাড়ের গাছগুলোতে সেচ কার্যক্রম চালাতে আরও সোলার পাম্প দেওয়া জন্য অনুরোধ জানাব। সব মিলিয়ে আমি কাজুবাদাম চাষকে সম্ভাবনাময় হিসেবেই দেখছি।

গালিব বলেন, ‘আর আমাদের পুরো জায়গাটি-ই পাহাড়। মাঝে পাহাড়, দুই পাশে পাহাড়। এতে করে দু’টি বড় ছড়া বা লেক’র মতো তৈরি হয়েছে। দুই পাহাড়ে সংযোগ হিসেবে একটি বাঁধ নির্মাণের সহযোগিতা পেলে বড় একটি লেক সৃষ্টি হবে। যেখান থেকে বাদাম গাছে পানি সরবরাহের পাশাপাশি হাঁস ও মাছ চাষের সুযোগ তৈরি হবে।’

জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় পার্বত্য অঞ্চলের তিন জেলার ২৫টি উপজেলাসহ অন্যান্য উপযোগী এলাকায় কফি ও কাজুবাদাম চাষ সম্প্রসারণ, উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রক্রিয়াজাত এবং বিপণনের মাধ্যমে কৃষকের আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং আর্থ সামাজিক অবস্থার টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য রয়েছে। প্রকল্পের উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে অনাবাদি জমি আবাদযোগ্য করা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের শুরুতে দেশে কাজুবাদাম চাষ হতো ১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে। প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে বর্তমানে প্রায় ৪ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ হচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চলে যেখানে আগে জুম চাষ হতো সেখানে এখন কাজুবাদাম ও কফি চাষ হচ্ছে।। উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ার ফলে পার্বত্য এলাকার মানুষ কাজুবাদাম ও কফি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কাজুবাদাম ও কফির আবাদ সম্প্রসারণের ফলে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। দেশে বর্তমানে কাজুবাদামের ২২টি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে উঠেছে। সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে এসব কারখানা স্থাপিত হয়েছে। প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপনের ফলে দেশে উৎপাদিত কাজুবাদামের বিপণন সহজ হচ্ছে। ভোক্তা পর্যায়েও দেশে কাজুবাদামের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। দেশে এখন কাজুবাদামের বাজার প্রায় ৭০০ কোটি টাকার। প্রতিবছর গড়ে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টন প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম আমদানি হয়।

কাজুবাদাম ও কফি চাষ সম্প্রসারণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপনের ফলে দেশে কর্মসংস্থানের সংযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করছে। বিএসআরএম ও কাজী গ্রুপসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রফতানির উদ্দেশ্যে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করছে। এ কারখানায় কাজ করছে প্রায় এক হাজার ২০০ শ্রমিক। এছাড়া অন্যান্য কারখানাগুলোতে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। শ্রমিকদের বেশিরভাগই নারী।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারীদের নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে ভূমিকা রাখছে কাজুবাদাম ও কফি চাষ। এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে উৎপাদিত কাজুবাদাম ও কফির মাধ্যমে দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এক বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় করা সম্ভব বলে মনে করছেন কৃষিসংশ্লিষ্টরা।

সারাবাংলা অনলাইন