মনিপুরে অস্ত্রাগার লুটের অস্ত্র কেএনএফের হাতে - Southeast Asia Journal
মনিপুরে অস্ত্রাগার লুটের অস্ত্র কেএনএফের হাতে
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

শান্তি আলোচনার কৌশলে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সন্ত্রাসীরা সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বিপুল আগ্নেয়াস্ত্রের মজুদ বাড়িয়েছে। গত বছর ভারতের মণিপুরে সহিংসতার সময় অস্ত্রাগার থেকে লুট হওয়া ছয় হাজার অস্ত্রের একটি অংশ ভারতের মিজোরাম হয়ে কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের হাতে পৌঁছেছে। পাহাড়ি এই সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর হাতে মিলিটারি গ্রেডের আগ্নেয়াস্ত্রও রয়েছে। ভারতের মিজোরাম ও মিয়ানমারে স্থানীয়ভাবে তৈরি আগ্নেয়াস্ত্রও কিনেছে এই সন্ত্রাসীগোষ্ঠী। সন্ত্রাসীরা প্রত্যেকটি অস্ত্র ২ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় কিনেছে। এসব ভারী আগ্নেয়াস্ত্র গত বুধ ও বৃহস্পতিবার বান্দরবানের দুটি ব্যাংকের তিনটি শাখায় ডাকাতি এবং আগ্নেয়াস্ত্র লুটপাটে ব্যবহার করা হয়। কুকি-চিন ছাড়াও পাহাড়ের আরও কয়েকটি সশস্ত্র সংগঠন ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের মজুদ বাড়িয়েছে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা ও পাহাড়ের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। পাহাড়কে অশান্ত রেখে চাঁদাবাজি, লুটপাট ও আধিপত্য বিস্তারই এসব সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর মূল উদ্দেশ্য বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

এদিকে, গতকাল বান্দরবানের রুমা ও থানচি এলাকা ছিল থমথমে। নিরাপত্তাহীনতার কারণে কিছু নারী ও শিশু এলাকা ছেড়ে গেছে। পাহাড়ে নিরাপত্তা জোরদার এবং ডাকাতির ঘটনায় জড়িত কেএনএফ সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে গতকাল শুক্রবার থেকে যৌথ সাঁড়াশি অভিযান শুরু করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। এই অভিযানে র‌্যাব-পুলিশের সঙ্গে সেনাবাহিনী ও বিজিবিকে মাঠে নামানো হয়েছে। অভিযানে লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারেও জোর তৎপরতা চালানো হচ্ছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, কেএনএফ নির্মূলে সেনাবাহিনী, র?্যাব, বিজিবি ও পুলিশের যৌথ অভিযান শুরু হয়েছে। সন্ত্রাসীদের দমনে পাহাড়ে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মতো সব ধরনের

কৌশল অবলম্বন করা হবে। অপরাধীদের শনাক্ত করতে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সম্মিলিত সাঁড়াশি অভিযানে কেএনএফ সন্ত্রাসীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। লুট করে নেওয়া ১৪টি অস্ত্রসহ তাদের আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার ও আস্তানা ধ্বংস করা হবে। সন্ত্রাসী নির্মূলে সব ধরনের পদক্ষেপ আমরা নেব।

র‌্যাবের তথ্য বলছে, গত বছর পাহাড়ে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালিয়ে র‌্যাব ৯৯ জনকে গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে জঙ্গি সংগঠন শারক্বীয়ার সদস্য ৮২ জন এবং কেএনএফ সদস্য ১৭ জন। তাদের কাছ থেকে চারটি বিদেশি পিস্তল, ৯টি এসবিবিএল বন্দুক, দুটি একনলা বন্দুক, ওয়াকিটকি ও বোমা এবং বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও নির্দেশিকা উদ্ধার করা হয়।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, কুকি-চিনের অত্যাচারের কারণে রুমা ও থানচি এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা অতিষ্ঠ। তারা বান্দবানের সুখ-শান্তি কেড়ে নিয়েছে। নতুন করে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কারণে আবারও ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে অনেক পরিবার। কেএনএফ শান্তি আলোচনার সব শর্ত ভঙ্গ করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। শান্তি আর সন্ত্রাস একসঙ্গে চলতে পারে না। এখন সময় এসেছে কেএনএফকে শক্ত হাতে দমন করার।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত কয়েক বছর ধরে কেএনএফ রুমা ও থানচির বিভিন্ন উপজাতিগোষ্ঠীর কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নিয়ে আসছে। এছাড়া এসব এলাকায় কোনো ব্যবসা করতে গেলেও তাদের

চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে তারা অপহরণ করে নিয়ে যায়। তখন মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হয়। এবার তারা চাঁদাবাজির পাশাপাশি ব্যাংক লুটও শুরু করেছে। এসব অর্থ দিয়ে তারা প্রতিবেশী দেশ থেকে অস্ত্র কেনে।

ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর, গত বছরের মে মাসে মণিপুরে জাতিগত সহিংসতার পর আগস্টে বিষ্ণুপুর জেলার নারানসেইনা গ্রামে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাটালিয়নের (আইআরবি) একটি ক্যাম্পে হামলা চালায় দুষ্কৃতকারীরা। ৪০টির বেশি গাড়িতে এবং হেঁটে এসে তারা অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে। গত বছর জাতিগত ও সম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হওয়ার পর বারবার অস্ত্রাগারে হামলা হয়।

ভারতের ইংরেজি দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমস জানিয়েছে, মোট চার হাজার অস্ত্র, পাঁচ লাখ রাউন্ড গুলিসহ বিপুল গোলাবারুদ লুট হয়। সরকারি সূত্রে বলা হয়েছিল, লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদের পরিমাণ আরও অনেক বেশি।

গত ২২ নভেম্বর ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে বলা হয়, ২০২৩ সালের ৭ জুন থেকে অস্ত্র উদ্ধারের কাজে নামে রাইফেলস এবং সেনা। কিন্তু এখনো পর্যন্ত লুট হওয়া ছয় হাজারের বেশি সরকারি আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে মাত্র দুই হাজার অস্ত্র উদ্ধার করা গেছে বলে জানিয়েছেন ভারতীয় সেনার পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান লেফেটেন্যান্ট জেনারেল রানাপ্রতাপ কলিতা। লুট হওয়া এসব অস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতেই রয়েছে বলে খবরে বলা হয়।

গত বছরের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধ পর্যালোচনা সভায় বলা হয়েছিল, ভারতের মণিপুরে অস্ত্র লুট হয়েছে। মণিপুরের সীমান্তের কাছাকাছি যেসব জেলা আছে, তাদের সতর্ক থাকতে হবে, যাতে এসব লুট হওয়া অস্ত্র সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে।

একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতের মিজোরাম, মণিপুর ও ত্রিপুরার পাহাড়ি অঞ্চলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্য রয়েছে। এর মধ্যে মণিপুর রাজ্যে অস্ত্র লুটপাটে সেখানকার কুকি চিন সদস্যরাও ছিল। সেই অস্ত্র মিজোরাম হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। বান্দরবানের মিজোরাম সীমান্তের অংশ অনেকটাই দুর্গম। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পুরোপুরি নজরদারিতে রাখা প্রায় অসম্ভব। এই সুযোগে বাংলাদেশের কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের মিজোরামে অবাধ যাতায়াত। বিশেষ করে বান্দরবান ও মিজোরামে থাকা বম জনগোষ্ঠীর ধর্ম-বর্ণ প্রায় একই হওয়ায় তাদের মধ্যে বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার বন্ধনও তৈরি হচ্ছে। সেখানকার সশস্ত্রগোষ্ঠী বাংলাদেশি কুকি-চিন সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বান্দরবানে চাঁদাবাজি ও লুটপাটের টাকা দিয়ে তারা অস্ত্র কিনে আনছে। লুটের অস্ত্রের পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে তৈরি আগ্নেয়াস্ত্রও তারা কিনছে। প্রতিটি আগ্নেয়াস্ত্র দুই হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। এসব আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে অপরাধ ঘটিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আবার অবাধে মিজোরামে চলে যাচ্ছে।

গোয়েন্দারা আরও বলছেন, ভারতের মনিপুরের মতো মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাজ্যগুলোতেও সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ হয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অত্যাধুনিক অনেক অস্ত্রও সশস্ত্রগোষ্ঠী লুট করেছে। সীমান্ত পেরিয়ে এসব অস্ত্রের একটি অংশ বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকার সন্ত্রাসীদের হাতে এসেছে। কুকি-চিন সন্ত্রাসী ছাড়াও পাহাড়ি অন্য সন্ত্রাসীগোষ্ঠী এসব অস্ত্র কিনে মজুদ বাড়িয়েছে।

২০২২ সালে কেএনএফ সেই সময় দাবি করেছিল, তাদের সামরিক শাখার শতাধিক সদস্য গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে পাড়ি জমান বছর তিনেক আগে। ২০২১ সালে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি দল ফিরে আসে। ২০২২ সালে তারা আত্মগোপনে চলে যায়।

একাধিক সূত্র বলছে, কেএনএফের সশস্ত্র সদস্যের সংখ্যা শুরুতে খুব বেশি ছিল না। ধীরে ধীরে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। পাশের দেশের সশস্র গোষ্ঠীর ইন্ধন, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণে তারা সহিংস হয়ে উঠে। চাঁদাবাজি ও লুটপাটের টাকায় সদস্য সংখ্যা ও অস্ত্রের মজুদ বাড়াতে থাকে। পাহাড়ে কেএনএফের আস্তানায় সমতলের নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার সদস্যরা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়। রুমা উপজেলার ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় কেএনএফের আস্তানা ছিল। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় র‌্যাব অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া ও কেএনএফের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার এবং তাদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেয়।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, জঙ্গিদের সঙ্গে কেএনএফের সম্পর্ক নিশ্চিত হওয়ার পর রুমা, থানচিসহ পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তখন দীর্ঘ সময় ওই অঞ্চলে পর্যটন বন্ধ থাকে। তখন নতুন করে বেশ কিছু সংখ্যক যুবককে তারা দলে ভেড়ায়। বর্তমানে কেএনএফে সদস্য এবং তাদের সহযোগীর সংখ্যা প্রায় এক হাজার।

পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত ছিলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব) এমদাদুল ইসলাম। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, কেএনএফের সঙ্গে হয়তো পাহাড়ের আর কোনো বড় সশস্ত্রগোষ্ঠীর সঙ্গে নতুন যোগাযোগ হয়েছে। বড় গোষ্ঠী চাইছে না এখনই শান্তি আলোচনায় যাক কেএনএফ। পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে সশস্ত্র এসব গোষ্ঠীর আধিপত্য কমে যাওয়ার শঙ্কায় এই পলিসি নিয়ে থাকতে পারে। কেএনএফের সশস্ত্র তৎপরতার সঙ্গে ভারতের মণিপুরের কুকিদের সঙ্গে স্থানীয় মেইতেইদের সঙ্গে চলমান সশস্ত্র বিরোধের মিল রয়েছে। এছাড়া মিয়ানমারের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারি বাহিনীর অব্যাহত সংঘাতে কেএনএফ অনুপ্রাণিত হতে পারে বলে মত এই নিরাপত্তা বিশ্লেষকের।

থমথমে থানচি-রুমা

দুটি ব্যাংকে হামলা, অস্ত্র লুট, অপহরণ ও গোলাগুলির ঘটনার পর বান্দরবানের থানচি ও রুমা থানার বিভিন্ন এলাকা শুক্রবারও পরিস্থিতি ছিল থমথমে। বিশেষ করে বৃহস্পতিবার রাতে থানচি থানা লক্ষ্য করে সন্ত্রাসীদের গুলিবর্ষণের পর মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, থানচি বাজারের বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ ছিল। আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে বান্দরবান সদরে চলে গেছে অনেক নারী ও শিশু। থানচি এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি ও পুলিশের সতর্ক পাহারা দেখা গেছে। পুলিশ বলছে, নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

ব্যাংকে নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ পুলিশের

সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। পাশাপাশি তল্লাশিচৌকি ও টহল জোরদারেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়। বান্দরবানের দুই উপজেলায় ব্যাংকে ডাকাতি, অস্ত্র লুট ও অপহরণের ঘটনার পর বৃহস্পতিবার থানাগুলোয় এই নির্দেশনা দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পার্বত্য এলাকায় পুলিশের পাশাপাশি বিজিবিও মোতায়েন করা হয়েছে।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।