পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ নিয়ে তৎপর হচ্ছে পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো
নিউজ ডেস্ক
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০’ জারি করেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে ১৯০০ সালের ১ মে থেকে এই শাসনবিধি কার্যকর হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্যাঞ্চলে রাষ্ট্রীয় প্রচলিত আইন অকার্যকর। দেশের সাংবিধানিক বিধিবিধান তোয়াক্কা না করে চলছে এই তথাকথিত শাসনবিধি বা মৃত আইন। এই কারণেই একই দেশে দুইটি আইন বিদ্যমান।
ব্রিটিশ কর্তৃক প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি বা পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন (চিটাগং হিল ট্র্যাক্ট ম্যানুয়েল ১৯০০) কে আইন হিসেবে ২০১৪ ও ২০১৬ সালে পৃথক দুই মামলার রায় দেয় সুপ্রীম কোর্টের পুর্ণ বেঞ্চ। তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালে রাঙামাটি ফুডস প্রোডাক্ট লি. এর এক মামলায় হাইকোর্ট বেঞ্চ পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিকে ডেড ল বা অকার্যকর আইন বলে রায় দেয়। এ রায়ের ফলে ১৯৯৭ সালের ২-রা ডিসেম্বরের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অংশ পার্বত্য জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদসহ এবং শাসনবিধির সৃষ্ট প্রথাগত প্রতিষ্ঠানসমূহ সংকটের মুখে পড়েছিল।
এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা হলে সুপ্রীমকোর্ট ২০১৬ সালে ২২ নভেম্বর শাসনবিধিকে একটি কার্যকর ও বৈধ আইন বলে রায় দেয়। অন্যদিকে সুপ্রীম কোর্ট বিচারধীন ওয়াগ্গাছড়া টি স্টেট অপর এক মামলার ২০১৪ সালে ২ ডিসেম্বর রায় দেয়। দুটি রায়ই শাসনবিধিকে কার্যকর বলে রায় দেয়।
এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে সুপ্রীম কোর্টে বাঙ্গালীদের পক্ষে রিভিউ করেন খাগড়াছড়ি জেলার বাসিন্দা আব্দুল আজিজ আখন্দ ও আব্দুল মালেক। একাধিক আপিল শুনানির পর পরবর্তীতে রায়টি উচ্চ আদালত বাতিল করে মৃত আইন হিসেবে রায় দেয়। মৃত আইন হিসেবে রায়টি পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় শক্তিকে মজবুত করে। শাসনবিধিকে আইন হিসেবে বলবৎ করার জন্য আঞ্চলিক দলগুলো সম্প্রতি বিশেষ তৎপর হয়ে উঠেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় উপজাতি হেডম্যান-কার্বারীদের দিয়ে জনসমাগম করার মাধ্যমে রায়টি বলবৎ রাখার প্রচেষ্ঠা করছে আঞ্চলিক সশস্ত্র দলগুলো।
জানা যায়, গত ৯ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের পূর্ন বেঞ্চে এই আইনকে মৃত আইন মর্মে ঘোষণা সংক্রান্ত রিভিউ শুনানি শুরু হয়েছে। পূর্ন বেঞ্চে প্রধান বিচারপতি সহ মোট আট জন বিচারপতি উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে। আগামী ১৬ মে ২০২৪ বৃহস্পতিবার মামলাটির চূড়ান্ত শুনানি হবে বলে জানানো হয়েছে। এই রায়টি চূড়ান্তভাবে বাতিল হলে পাহাড়ের জোরজুলুম ও বৈষম্যের হেডম্যান-কার্বারী ও সার্কেল চীপ প্রথার অবসান হবে। সাথে প্রথাগত অধিকারের দোহাই দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমগ্র ভূমির মালিকানা দাবিও অবসান হবে। তাই এই রায়টি বলবৎ রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে আঞ্চলিকদলগুলো।
এরই ধারাবাহিকতায়, চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস রেগুলেশন ১৯০০ বাতিল, রাজা-হেডম্যান-কার্বারি পদবি বিলোপ এবং পাহাড়িদের প্রথাগত অধিকার হরণের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে ও প্রতিবাদে আগামী ১৫ মে (বুধবার) খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলায় আধাবেলা সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন পাহাড়ের আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট- ইউপিডিএফ।
সোমবার (১৩ মে) রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির বিভিন্ন স্থানে ইউপিডিএফ ও তার সহযোগি গণসংগঠনসমূহ এবং সচেতন নাগরিক সমাজ ও সাজেক কার্বারি এসোসিয়েশনের অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে অবরোধ কর্মসূচির ঘোষনা দেয়া হয়। একই দিন খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর, পানছড়ি বাজার, দীঘিনালা, মহালছড়ি, গুইমারা, মানিকছড়ি, লক্ষ্মীছড়ি ও রামগড় এবং রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, কুদুকছড়ি, সাজেক, কাউখালি, নানিয়াচর ও লংগদুতে সমাবেশগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়ি জনগণ তথা স্থায়ী বাসিন্দারা ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের মাধ্যমে কিছুটা হলেও প্রথাগত অধিকার ভোগ করে আসছে। কিন্তু সরকার এই অধিকারকে সুরক্ষা না দিয়ে উল্টো আদালতের মাধ্যমে আইনটি বাতিল বা অকার্যকর করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।
সিএইচটি রেগুলেশন বাতিলের ষড়যন্ত্র বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বক্তারা আরও বলেন, আইনটি না থাকলে রাজা হেডম্যান, কার্বারীর পদবিও বিলুপ্ত হয়ে যাবে, তাদের আর কোনো ক্ষমতা থাকবে না। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ এ ষড়যন্ত্র মেনে নেবে না, তারা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
এদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন সার্কেল চীফ এই নিয়ে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছেন। তাদের নেতৃত্ব রয়েছেন চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়। সূত্র বলছে, পার্বত্য বাঙ্গালীরা নেতৃত্বহীন হওয়ার কারণে শাসনবিধির লাভ-ক্ষতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। আদালত রায়টি যদি বলবৎ করে এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে পাহাড়ে।
উল্লেখ যে, পার্বত্য শাসনবিধি (১৯০০) এমন একটি মৃত আইন যেটি এ অঞ্চলের সরকার ও বাঙ্গালীদের ভূমি অধিকার খর্ব করে এবং এ অঞ্চলের নিরাপত্তাবাহিনীর কার্যক্রমের উপর প্রভাব ফেলে। তথাকথিত শাসনবিধির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সবধরনের ভূমির মালিক উপজাতিরা। এই মৃত আইনের ক্ষমতাবলে হেডম্যান-কার্বারী ও সার্কেল চীফের সৃষ্টি। প্রথাগত ভূমি অধিকার উপজাতীয়দের এ অঞ্চলের সব ভূমির উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে। এই শাসনবিধিকে আইন হিসেবে রায় বলবৎ করলে অচিরেই পার্বত্য চট্টগ্রামের সবধরনের ভূমির নিয়ন্ত্রণ হারাবে রাষ্ট্র।