উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তে ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শঙ্কা
নিউজ ডেস্ক
রাখাইন রাজ্যে চলমান সঙ্ঘাতে ফের বড় ধরনের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঝুঁকিতে উখিয়া টেকনাফ সীমান্ত এলাকা। মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে অসংখ্য রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছেন। এ দিকে টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে তৎপর সীমান্তবর্তী কয়েক শ’ দালাল। এ অবস্থায় তাদের প্রতিরোধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে নাফ নদীতে টহল জোরদার করেছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড।
সূত্র মতে, রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে নিয়মিত টহলের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত বিজিবি। এ ছাড়া সীমান্তবর্তী এলাকা, সড়ক ও উপসড়কে রয়েছে পুলিশের অতিরিক্ত টহল ও নজরদারি। তারপরও থেমেই নেই সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ। সীমান্তের অরক্ষিত ও দুর্গম পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ করার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। পাশপাশি বিজিবি ও কোস্টগার্ডের অভিযান প্রতিদিনই চলছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীর সাথে বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মির চলমান সঙ্ঘাতে বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনায় উদ্বেগ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে আরো দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি।
সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও কোস্টগার্ড অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এমনটি দাবি করলেও দালালদের সহায়তায় অন্তত ২০টি পয়েন্ট দিয়ে টেকনাফে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে।
রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের দায়িত্ব পালনে ঘাটতি রয়েছে বলে দাবি করে বলেন, নতুন করে যেসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে তারা স্থানীয় আত্মীয় স্বজনদের বাসা বাড়ি ও গোপনে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে বিভিন্ন ভাড়া বাসায় অবস্থান করছে। আবার কিঙ্কু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের আটকে কোনো অভিযান চোখে পড়েনি। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আরো দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এই প্রতিবেদকের সাথে কয়েকজন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীর কথা হলে তারা জানায়, প্রথমে মিয়ানমারের দালালদের সাথে তারা চুক্তি করে। চুক্তি হয়ে গেলে রোহিঙ্গাদের টেকনাফে অবস্থানরত দালালদের মোবাইল নম্বর দেয়। নম্বরটি তারা বিদেশে অবস্থানরত পরিবারের সদস্যদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। পরে বিদেশ থেকে টেকনাফে অবস্থানরত দালালদের সাথে যোগাযোগ করে দিনক্ষণ ও অর্থ লেনদেনের বিষয়টি ঠিক করে। টেকনাফকেন্দ্রিক দালালদের ফোন পেলেই রাতে সুযোগ বুঝে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা অনুপ্রবেশ করে।
মাঝে মধ্যে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও তাদের পুশব্যাক করা হয়। সুযোগ বুঝে তারা ফের অন্য ঘাট দিয়ে অনুপ্রবেশ করে। এ জন্য মাথাপিছু ৩০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে এক লাখ টাকা পর্যন্ত চুক্তি হয়।
টেকনাফ মডেল থানার ওসি তদন্ত আব্দুল্লাহ আল মানুন জানান, কিছু কিছু জায়গা দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়টি শুনেছি। এই ঘটনায় সম্পৃক্ত দালালদের শনাক্ত করতে পুলিশের গোয়েন্দা টিম মাঠে কাজ করছে। এমন অপকর্মে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
দালালদের হাত ধরে সীমান্তে অন্তত ২১টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটছে। পয়েন্টগুলো হলো- টেকনাফ সীমান্তের দমদমিয়া, জাদিমুড়া, কেরুনতরী, বরইতলী, নাইট্যং পাড়া, হ্নীলা চৌধুরীপাড়া, মৌলভীপাড়া, নাজিরপাড়া, নয়াপাড়া, শাহপরীরদ্বীপ, মেরিন ড্রাইভের খুরের মুখ, মুন্ডার ডেইল, মহেষখালীয়াপাড়া, তুলাতুলি, হাবির ছড়া, জালিয়াপাড়া গোলারচর, শাপলাপুর ও বান্দারবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, তুমব্রু, ঘুমধুম।
সীমান্তে রোহিঙ্গা পাচারে দালাল চক্র গড়ে উঠেছে স্বীকার করে নৌ-পুলিশের টেকনাফ স্টেশন ইনচার্জ তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, মিয়ানমারে চলমান সঙ্ঘাতের সুযোগে কিছু দালাল চক্রের রোহিঙ্গা পারাপারের বাণিজ্য গড়ে তোলার খবর আমরা শুনেছি। বিভিন্ন সময় অনুপ্রবেশের সংবাদ এলেও জনবল ও নৌযান না থাকায় আমরা তৎক্ষণাৎ অভিযানে নামতে পারি না।
কক্সবাজারের টেকনাফের কোস্টগার্ড স্টেশন কমান্ডার এইচ এম লুৎফুল লাহিল মাজিদ বলেন, মিয়ানমারে চলমান সঙ্ঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে নাফ নদীর সীমান্ত দিয়ে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। দালাল চক্র যেন সক্রিয় হতে না পারে, সে কারণে আমাদের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। জেলে সমিতির সভাপতিদের ডেকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, কাউকে যেন এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হতে দেখা না যায়।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ করতে সংশ্লিষ্ট এলাকার ওসিদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সীমান্তে দালাল দমনে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি পুলিশ জিরো টলারেন্স ভূমিকায় রয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে উখিয়ার আঞ্জুমান পাড়া এবং টেকনাফের নাফ নদী দিয়ে উল্লেখযোগ্য রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল বাংলাদেশে। সঙ্ঘবদ্ধ দালাল চক্র প্রথম দিকে মাছ ধরা নৌকা এবং ট্রলার দিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিল। তবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোর অংশ হিসেবে নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়েছে। দিন যত গড়াচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সঙ্কট ততই গভীর হচ্ছে। দীর্ঘ সাত বছর কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পরেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উদ্বাস্তু হয়ে পালিয়ে আসা প্রায় ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নাগরিকদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো প্রক্রিয়া আলোর মুখ দেখছে না।