সক্রিয় শতাধিক দালাল, সমুদ্রপথে রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়ায় পাচার
নিউজ ডেস্ক
কক্সবাজারের টেকনাফের সমুদ্র উপকূল দিয়ে রোহিঙ্গা নাগরিকদের মালয়েশিয়ায় পাচারের কাজে সক্রিয় রয়েছে শতাধিক দালাল। বর্তমানে রোহিঙ্গা নাগরিকদের বড় একটি অংশ অবস্থান করছেন মালয়েশিয়ায়। সেখানের কিছু দালালের সঙ্গে বড় অঙ্কের চুক্তি করে টেকনাফের রোহিঙ্গাদের পাঠাচ্ছে এখানকার দালালরা। আসছে শীতের মৌসুম ঘিরে এসব মানবপাচারকারী সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কারণ শীতের মৌসুমে সমুদ্র শান্ত থাকে। এই সময়ে সহজে রোহিঙ্গাদের পাচার করা যায়। জীবনের ঝুঁকি জেনেও চার-পাঁচ লাখ খরচ করে অবৈধপথে অহরহ মালয়েশিয়ায় যাচ্ছেন রোহিঙ্গারা। তবে মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গাদের উদ্ধার ও দালালদের গ্রেফতার করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে কোনোভাবেই পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না।
তিন দিনে পাচারকালে অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা নাগরিককে উদ্ধার
গত তিন দিনে সাগরপথে পাচারকালে অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা নাগরিককে উদ্ধার এবং অন্তত ১০ জন দালালকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সর্বশেষ মালয়েশিয়ায় পাচারের উদ্দেশে জড়ো করা ২০ জনকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। উদ্ধার লোকজনের মধ্যে আট জন বাংলাদেশি আর ১২ জন রোহিঙ্গা নাগরিক। এ ঘটনায় মানবপাচারে জড়িত এক নারীসহ তিন দালালকে আটক করা হয়। গত মঙ্গলবার গভীর রাতে টেকনাফ উপজেলার সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ লম্বরী এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের উদ্ধার করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজারের সুমুদ্র উপকূল দিয়ে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় মানবপাচারে জড়িত অন্তত ১০০ দালালকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়ায় মালয়েশিয়ায়
রোহিঙ্গা নাগরিক ও তাদের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শীতের মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই দালালরা সমুদ্রপথে মানবপাচার চালিয়ে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে রোহিঙ্গাদের একটি বড় একটি দল সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় যাত্রা শুরু করেছে। দালালরা পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়ায় তিন-চার লাখ টাকা নিয়ে রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়ায় পাঠাচ্ছে। কোনও কোনও দালাল এ সুযোগে সেন্টমার্টিনের পূর্ব-দক্ষিণ উপকূলে মিয়ানমারের চামিলা গ্রামের বন্দিশালায় রোহিঙ্গাদের আটকে মুক্তিপণ আদায় করে। এমন ঘটনা আছে, মালয়েশিয়ায় কিংবা ইন্দোনেশিয়ায় পাঠানোর কথা বলে সাগরে কয়েকদিন ঘুরিয়ে কক্সবাজার সৈকতে নামিয়ে দিচ্ছে দালালরা। তবু ঝুঁকিপূর্ণ পথে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন বা যাওয়ার চেষ্টা করছেন রোহিঙ্গারা।
টেকনাফের বাসিন্দা আবদুর গফুর বলেন, ‘সাগর শান্ত থাকায় মানবপাচারকারীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দালালরা প্রথমে রোহিঙ্গাদের পাহাড়ে জড়ো করে। সুযোগ বুঝে সাগরপথে নৌকায় তুলে দেয়। গত কয়েকদিনে আমার এলাকার বেশ কিছু দালাল ১০০ মানুষ পাচার করেছে। যারা বিভিন্ন ক্যাম্পের রোহিঙ্গা ছিলেন। এমনকি দালালরা মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আনছেন। গত শুক্রবার মিয়ানমার থেকে আসার পথে মারা যাওয়া এক রোহিঙ্গা নারীকে সমুদ্র উপকূলে পুঁতে রাখে। পরে লাশটি উদ্ধার করে পুলিশ।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ উপকূল দিয়ে শতাধিক রোহিঙ্গা নাগরিককে পাচার করেছে দালালরা। এখানে কয়েকজন জনপ্রতিনিধির সহযোগিতায় বেশ কিছু দালাল এই কাজে জড়িত। এসব ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জেনেও নীরব বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কক্সবাজার আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) এক কর্মকর্তা বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের একটি গ্রুপ সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় গেছে বলে জেনেছি। কয়েকটি ক্যাম্পের মাঝিরা বলেছেন, আরেকটি গ্রুপ মালয়েশিয়ায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের পাচাররোধে কাজ শুরু করেছি আমরা। মেরিন ড্রাইভ উপকূলে নজর রাখা হচ্ছে। দালালদের পেলেই গ্রেফতার করা হবে।’
সমুদ্রের যেসব পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের পাচার করা হয়
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেশিরভাগ দিন রাতের আঁধারে টেকনাফের মহেশখালীয়া পাড়া, তুলাতলী, লম্বরী, রাজার ছড়া, নোয়াখালী পাড়া, বড় ডেইল, কচ্ছপিয়া, মাথাভাঙা, শামলাপুর, বাহারছড়া, পশ্চিম পাড়া, নাইট্যং পাড়া, কেরুনতলী, বড়ইতলী, পুরাতন ও দক্ষিণ লম্বরী পয়েন্ট দিয়ে মানবপাচার চলছে। সমুদ্রের এসব ঘাট দিয়ে টেকনাফের আবদুল আলী, মো. সাইফুল, মো. রেদোয়ান, কেফায়েত উল্লাহ, সৈয়দুল হক, দিলদার মিয়া, মো. ইলিয়াছ ও মো. জুবায়ের রোহিঙ্গা নাগরিকদের পাচার করছেন। এর মধ্যে বাহারছড়া ইউনিয়নের নোয়াখালী পাড়া দিয়ে সবচেয়ে বেশি পাচারের ঘটনা ঘটছে। গত সোমবার পাচারের উদ্দেশ্যে ক্যাম্প ছাড়া এক রোহিঙ্গা নারী মারা গেলে লাশ মাটিতে পুঁতে রাখা হয়। খবর পেয়ে লাশটি উদ্ধার করে পুলিশ।
এই এলাকার এক মেম্বার জানিয়েছেন, নোয়াখালী পাড়া ঘাটে রোহিঙ্গাদের রাতে জড়ো করা হয়। পরে ছোট নৌকায় করে বঙ্গোপসাগরের গভীরে নিয়ে যাওয়া হয়। সমুদ্রের মাঝেই তাদের মালয়েশিয়াগামী বোটে তুলে দেওয়া হয়। এই কাজে প্রত্যেক রোহিঙ্গার কাছ থেকে এক থেকে তিন লাখ টাকা করে নেওয়া হয়।
কয়েকদিন আগে উখিয়া রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির থেকে মালয়েশিয়া পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে দালালেরা মাছ ধরার একটি ফিশিং ট্রলারে ওঠান শতাধিক রোহিঙ্গাকে। টানা ১০ দিন রোহিঙ্গাবোঝাই ট্রলারটি গভীর সাগরের এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করে। গত সোমবার ভোরে রোহিঙ্গাদের নামিয়ে দেওয়া হয় উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের ইনানী সৈকতে। এরপর রোহিঙ্গারা এদিক-সেদিক ছুটতে থাকেন। সকাল ৯টার দিকে স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ইনানীর বিভিন্ন গ্রামে অভিযান চালিয়ে ২৬ জন রোহিঙ্গাকে আটক করেন। অন্য রোহিঙ্গারা পাহাড়ে আত্মগোপন করেন। গা ঢাকা দেয় দালালরা।
ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-২২ সালে ৮ হাজার ৩১২ রোহিঙ্গা শরণার্থী সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাদের মধ্যে ৫৮৯ জনের সলিলসমাধি হয়েছে। নিখোঁজও হয়েছেন অনেকে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
কেন যাচ্ছেন রোহিঙ্গারা?
রোহিঙ্গাদের ভাষ্যমতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে শরণার্থীশিবিরে ছোট্ট জায়গায় ছয় থেকে আট জনের পরিবারকে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব পরিবারে অর্থ উপার্জনকারী সদস্য থাকেন মাত্র একজন। তাই উপার্জনক্ষম ব্যক্তি পরিবার চালাতে গিয়ে একধরনের চাপে থাকেন। স্থানীয় পর্যায়ে তাদের কাজের স্বীকৃত ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) থেকে যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা এখন ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকায় নেমে এসেছে। তাই পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে মুক্তির আশায় অনেকেই অভিবাসনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, ‘ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা অনিরাপদ। খাদ্যের অভাবে কষ্টে জীবন পার করছেন। এই কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি পেতে তারা যেদিকে সুযোগ পাচ্ছেন সেদিকে পালাচ্ছেন। অনেকে উন্নত জীবনের আশায় সাগরপথে মালয়েশিয়ায় যাচ্ছেন। এই যাত্রা কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জেনেও চুপ করে আছে। কারণ রোহিঙ্গারা মারা গেলেও কারও কিছু যায় আসে না।’
যা বলছে পুলিশ
পুলিশ জানায়, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সমুদ্রপথে মানবপাচারের ঘটনায় কক্সবাজারে এক হাজার ১৩৪ মালয়েশিয়াগামীকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা। এসব ঘটনায় উখিয়া ও টেকনাফ থানায় ১২০০ জনকে আসামি করে ৮৫টি মামলা হয়েছে। ৫০৮ দালালকে আটক করা হয়েছে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেন, ‘সামনে শীতকাল। টেকনাফে মানবপাচারকারীরা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। যেসব দালাল মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত, তাদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু হবে। রোহিঙ্গাদের পাচাররোধে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত আছে এবং থাকবে।’
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘সমুদ্রপথে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িতদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাদের ধরতে অভিযান চালানো হবে। এ ছাড়া আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জনসচেতনতা বাড়াতে কাজ করছি।’
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।