পাহাড়ি সড়ক টেকসইকরণে ২৪৯ কোটি টাকার কাজে ধীরগতি
![]()
নিউজ ডেস্ক
২০১৭ সালের ১৩ জুন পাহাড় ধসে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়কের একটি অংশ সম্পূর্ণ ধসে সারা দেশের সঙ্গে রাঙ্গামাটির সড়ক যোগাযোগ বন্ধ ছিল নয়দিন। একই সময় রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কেরও বিভিন্ন স্থান ধসে যান চলাচল বিঘ্নিত হয়েছিল। পাহাড় ধসের ওই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল রাঙ্গামাটি সড়কের। সে ক্ষতের চিহ্ন শুকায়নি। ঝুঁকিপূর্ণ সড়কগুলো দিনে দিনে তৈরি হচ্ছে ‘মরণ ফাঁদে’। সড়কের ঝুঁকি এড়াতে ২০২০ সালে সড়কের পাশে ২৪৯ কোটি টাকার একটি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের প্রকল্প নেয়া হয়েছে। কিন্তু দুই বছর মেয়াদি প্রকল্পের বর্ধিত সময় চলতি বছরের জুনে শেষ হলেও ভৌতকাজের অগ্রগতি মাত্র ৪৫ শতাংশ বলে জানিয়েছে সওজ। নির্মাণকাজ ধীরগতিতে হওয়ায় প্রকল্প মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ালেও নির্ধারিত সময়ে কাজ বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, সড়কের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণকাজ চলছে ধীরগতিতে। যে কারণে দুই বছরের প্রকল্প তিন বছরে ঠেকেছে। কিন্তু প্রতি বর্ষা মৌসুমে ফের ঝুঁকিতে পড়ে পাহাড়ি সড়কগুলো। এ বছরও কয়েক দিনের বৃষ্টিতে সড়কের পাঁচ-সাত স্থানে নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা নিরাপদ পরিবহন চলাচলে বর্ধিত সময়ের মধ্যে নির্মাণকাজ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন।
জেলার নানিয়ারচর উপজেলার বাসিন্দা ঝিল্লোল মজুমদার জানান, দুই বছর আগে নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো নয়। রাঙ্গামাটি-নানিয়ারচর সড়কের বেশির ভাগ স্থানে এখনো আরসিসি রিটেইনিং ওয়ালের কাজ শেষ হয়নি। বাকি কাজগুলো পরের বিষয়। একদিকে নির্মাণকাজে ধীরগতি, আরেকদিকে নির্মাণসামগ্রী রাখায় সড়ক সংকুচিত হয়ে যানবাহনের স্বাভাবিক চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গিয়েছে, রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের বেশকিছু স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকে আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতি রাখা রয়েছে, বৃষ্টিতে ভিজে রডে ধরেছে মরিচা। বেশকিছু ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে নির্মাণসামগ্রী দেখা গেলেও এখনো পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয়নি। আবার কোথাও পাইলিং শেষে রিটেইনিং ওয়ালের কাজ ধরা হয়েছে, কোথাও অর্ধেক সম্পন্ন হয়েছে। কয়েকটি স্থানে রিটেইনিং ওয়াল তোলা হলেও ফাঁকা স্থানে মাটি কিংবা বালি ভরাট হয়নি। এছাড়া সড়কের কিছু অংশ ধসে সরু হয়ে গেছে।
বরইছড়ি-ঘাগড়া সড়কেরও প্রায় একই দশা। বেশকিছু জায়গায় নির্মাণকাজের যন্ত্রপাতি, পাহারাদার শ্রমিকদের দেখা গেলেও কাজ বন্ধ রয়েছে। একই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি ও বগাছড়ি-নানিয়ারচর সড়কেও।
সওজ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের অক্টোবরে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, রাঙ্গামাটি-বান্দরবান, রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি (খাগড়াছড়ি) ও বগাছড়ি-নানিয়ারচর—এ চারটি সড়কের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে আরসিসি (রিইনফোর্সড সিমেন্ট কংক্রিট) রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। পাহাড়ি সড়কে ভাঙন-ধস ঠেকাতে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় গৃহীত ২৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ের মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সড়কের ঝুঁকি কেটে যাবে। প্রকল্পটির অধীনে চারটি সড়কে ১৫১ স্থান ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এর মধ্যে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে ৪৯টি, রাঙ্গামাটি-বান্দরবান সড়কে ৪০ ও রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি-নানিয়ারচর সড়কে ৬২টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। চারটি প্যাকেজে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্মাণকাজের কার্যাদেশ পায়।
সওজ সূত্র জানায়, দুই বছর মেয়াদি (২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছর) প্রকল্পটি বর্ধিত সময়ে কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় প্রকল্প মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে আরো এক বছর (২০২২-২৩ অর্থবছর)। জেলার চারটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের ২৪২ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার অংশের (৫ হাজার ৪৭০ মিটার) সমপরিমাণ রিটেইনিং ওয়াল তৈরির কাজ চলছে। ৫ মিটার, ৬ ও ৭ মিটার—এ তিনটি পদ্ধতিতে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ হচ্ছে। দুই অর্থবছরে প্রকল্পের ভৌতকাজ সম্পন্ন হয়েছে ৪৫ শতাংশ আর আর্থিককাজ সম্পন্ন হয়েছে ৩৮ শতাংশ। সে হিসেবে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাঝে এরই মধ্যে প্রায় ৯৫ কোটি টাকা অর্থ ব্যয় হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পটি গ্রহণের শুরু থেকেই কভিড পরিস্থিতি ও নির্মাণসামগ্রীর দরে ঊর্ধ্বগতির কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কার্যত শ্লথগতিতে নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করায় প্রকল্প অগ্রগতি বর্ধিত সময়েও দৃশ্যমান হয়নি। এখন প্রকল্প মেয়াদ বাড়ালেও বর্ধিত সময়ে কাজের পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রাঙ্গামাটি ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী নেজাম উদ্দিন মিশু জানান, রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি সড়কে আমার প্যাকেজের কাজ পাহাড়ি এলাকায় হওয়ায় মাটি ও বৃষ্টিপাতের সমস্যায় নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করতে বেগ পেতে হচ্ছে। এর পরও আমরা চেষ্টা করছি। এ সড়কে আমার ৩১ জায়গায় রিটেইনিং ওয়ালের কাজের মধ্যে ১৯টি জায়গায় কাজ ধরা হয়েছে। আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স-এনডিইর প্রজেক্ট ম্যানেজার মো. মমতাজ বণিক বার্তাকে জানান, প্রকল্পের চারটি প্যাকেজের দুটি প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছেন তারা। প্যাকেজ-১ রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে ৪৫-৫০ শতাংশ কাজ হয়েছে। প্যাকেজ-৪ ঘাগড়া-বরইছড়ি সড়কে ৬৫-৭০ শতাংশ কাজ হয়েছে।
সওজ অধিদপ্তর রাঙ্গামাটির উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফারহান জানান, প্রকল্পের মূল কাজ পাইলিং শেষ পর্যায়ে। এখন আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের কাজ বাকি। বেশকিছু স্থানে রিটেইনিং ওয়ালের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
প্রকল্পের অগ্রগতি প্রসঙ্গে সওজ অধিদপ্তর রাঙ্গামাটির নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদ আল নূর সালেহিন জানান, চারটি প্যাকেজের অধীন তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে প্রকল্পের ৪৫ শতাংশ ভৌতকাজ ও ৩৮ শতাংশ আর্থিক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে তাগাদা দেয়া হয়েছে বর্ধিত সময়ের মধ্যে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার জন্য।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধসে পাঁচ সেনাসদস্যসহ ১২০ জনের প্রাণহানি ঘটে। এ সময় সড়কের বিভিন্ন স্থানে ধসের কারণে সারা দেশের সঙ্গে রাঙ্গামাটি জেলার টানা নয় দিন সড়ক যোগাযোগ বন্ধ ছিল। এরপর ২০২০ সালে আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল প্রকল্পটি গ্রহণের আগে অর্থবছরে ১ কোটি টাকা ব্যয়ে সাময়িকভাবে পাহাড়ি সড়ক রক্ষায় একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটির অধীনে সড়কের বিভিন্ন স্থানে কাঠের বল্লি, টিন ও মাটি দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক রক্ষায় কাজ করা হয়। তবে এটি টেকসই হয়নি, সড়কের বেশকিছু স্থানে সংস্কার-পরবর্তী ভাঙন দেখা দিয়েছিল।