সরকারের সাথে বৈঠকের পথ খুঁজছে কোনঠাসা ইউপিডিএফ!
নিউজ ডেস্ক
আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতা করে আসলেও বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সাথে প্রতিকূল সম্পর্ক ছিল প্রসীত বিকাশ খীসার নিয়ন্ত্রনাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’র (ইউপিডিএফ)। কিন্তু হঠাৎ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে অবস্থান, এমনকি দাবি আদায় নিয়ে বৈঠকে বসতেও চায় সংগঠনটি। এ ঘটনায় পাহাড়ে জন্ম দিয়েছে নতুন আলোচনার। হঠাৎ এ রকম প্রস্তাব কী পাহাড়ের সমস্যা সমাধানে নতুন পথ খুলবে? নাকি নতুন কৌশলে রাজনৈতিকভাবে মাঠে সক্রিয় হওয়ার পথ খুঁজছে সংগঠনটি?— এসব প্রশ্ন এখন সামনে আসছে।
পাহাড়ের রাজনীতিবিদদের মতে, সরকারের কাছে বৈঠকের প্রস্তাব দিয়ে নতুন করে কী কৌশল নিচ্ছে ইউপিডিএফ, সেটিও কিন্তু ভাবনার বিষয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংগঠনটি কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে। ভোটের রাজনীতিতে তাদের আধিপত্য যে জিইয়ে আছে তার প্রমাণ রেখেছে গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও।
১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠার পর থেকে যখন যে সরকার ক্ষমতা ছিল, সে সরকারের সাথে বৈরী সম্পর্ক বজায় রেখে আসছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের অনিবন্ধিত আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের আগমুহূর্ত পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধীতা করে আসছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক সংগঠনটি। এর আগে ১/১১ সরকারের বিরোধীতা এবং চারদলীয় জোটের সরকারের সাথে প্রতিকূল সম্পর্ক ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে সংগঠনটি। সরকারের সাথে দাবি আদায় নিয়ে বৈঠকে বসতেও চায় সংগঠনটি।
গত ৬ অক্টোবর জাতীয় পর্যায়ের দুটি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলে প্রচারিত সংবাদে ইউপিডিএফ মুখপাত্র অংগ্য মারমার বক্তব্যে একথা উঠে আসে। তবে এর আগে আরও একবার সরকারের সাথে সংলাপের জন্য ৮৭টি দাবি উত্থাপন করে সংগঠনটি। ২০২২ সালের ৯ জুন খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার চেঙ্গী ইউনিয়নের বড়কলক এলাকায় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলামের কাছে এসব দাবি সম্বলিত নথিপত্র হস্তান্তর করেন ইউপিডিএফ’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য উজ্জল স্মৃতি চাকমা। ওইদিনের দাবি হস্তান্তর অনুষ্ঠানেও অংগ্য মারমা উপস্থিত ছিলেন।
৮৭টি দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুর্বল দিকগুলো নিয়ে আলোচনা, ভূমি সমস্যা সমাধান, সমতল থেকে আসা পুনর্বাসিত বাঙালিদের সম্মানজনক প্রত্যাবর্তন, পাহাড়ে সংখ্যালঘুদের ওপর চাপিয়ে দেয়া উগ্রসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ বাতিলসহ মৌলিক দিকগুলো। এসব দাবি মেনে সংলাপে রাজি হলে ইউপিডিএফ পরবর্তী পর্যায়ে এগিয়ে আসবে বলে সেই সময়ে গণমাধ্যমে জানানো হয়। তবে দুই বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও এ নিয়ে কোন অগ্রগতি হয়নি।
এখানে বলে রাখা ভালো, উক্ত সময়ে খাগড়াছড়িসহ পাহাড়জুড়ে ইউপিডিএফ প্রায় সবখানেই কোনঠাসা অবস্থায় ছিলো। তবে ইউপিডিএফ’র আবার নতুন করে সরকারের সাথে বসার প্রস্তাব পাহাড়ে জন্ম দিয়েছে নতুন আলোচনা-সমালোচনার। ২০১৮ সাল থেকে রাজপথে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারা সংগঠনটির হঠাৎ এ রকম প্রস্তাব কী পাহাড়ের সমস্যা সমাধানে নতুন পথ খুলবে নাকি নতুন কৌশলে রাজনৈতিকভাবে মাঠে সক্রিয় হওয়া পথ খুঁজছে সংগঠনটি— এসব প্রশ্ন এখন সামনে আসছে। ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে স্বায়ত্তশাসন চেয়ে আসলেও টিভি সাক্ষাতকারে পরিষ্কার করেছেন তাদের চাওয়ার বিষয়টি। ‘এক দেশ-দুই আইন’ দাবি উত্থাপনের পর ইউপিডিএফ’র সাথে সরকারের বসার সুযোগ আছে কিনা— তা জানতে হয় আরও কিছুদিন সময় লাগবে বলে মনে করেন রাজনীতিবিদরা।
তবে পাহাড়ের প্রবীণ এক রাজনীতিবিদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা প্রতিকূলতা পার করে ঠিকে আছে সংগঠনটি। বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার ইউপিডিএফ নেতাকর্মীদের ওপর স্ট্রিম রোলার চালানোর পাশাপাশি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করতে অনেক চেষ্টা করেছিল। তারপরও ইউপিডিএফ পাহাড়ের বেশির ভাগ অংশে আধিপত্য বজায় রেখেছে। এতে করে সংগঠনটি ভীত ততটা দুর্বল নয়— তা প্রমাণিত। এখন সরকারের কাছে বৈঠকের প্রস্তাব দিয়ে নতুন করে কী কৌশল নিচ্ছে সেটিও কিন্তু ভাবনার বিষয়।
তিনি আরও বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংগঠনটি কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে। ভোটের রাজনীতিতে তাদের আধিপত্য যে জিইয়ে আছে তার প্রমাণ রেখেছে গেল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও। পানছড়ি, দীঘিনালা ও লক্ষ্মীছড়ির ১৯ টি কেন্দ্রে কোন ভোটারকে আসতে দেয়নি সংগঠনটি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে খুব নিখুঁত হবে তা অনুমেয়। সবকিছু ঠিক থাকলে ভোটের রাজনীতিতে যে ইউপিডিএফ অংশ নিচ্ছে তা পরিষ্কার।
এদিকে, গত ৫ আগষ্টের আগে সারাদেশে কোটাবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলন গড়ে উঠলেও ইউপিডিএফ নিয়ন্ত্রিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ সেসময় ৫ শতাংশ উপজাতি কোটা বহাল রাখার জন্য বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ, মানববন্ধনসহ নানা আন্দোলন করে। কিন্তু ৫ আগষ্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সুর পাল্টায় সংগঠনটি।
২০১৮ সাল থেকে প্রকাশ্যে রাজনীতির মাঠে কাজ করতে না পারলেও ৫ আগস্ট পরবর্তী স্বাচ্ছন্দ্যে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তারা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে ঢাকা ও চট্টগ্রামেও কার্যক্রম চোখে পড়ছে। ইউপিডিএফ’র রাজনৈতিক মতার্দশকে সমর্থন করে এমন বুদ্ধিজীবী ও বামপন্থী দলগুলোর সাথে আবারও সমন্বয় করছে। সবমিলিয়ে ইউপিডিএফ’র যে এখন রাজনৈতিক বসন্ত উদযাপন করছে তা স্পষ্ট। সরকারের সাথে বৈঠক প্রস্তাবের যদি কিঞ্চিত সাড়া মিলে তাহলে ফলাফল যায় আসুক রাজনীতির মাঠে কোমড় সোজা করে দাড়াঁবে ইউপিডিএফ।
২০১৮ সালের ১৮ আগষ্ট খাগড়াছড়ি জেলা সদরের স্বনির্ভর ও ধর্মপুরে ইউপিডিএফ ও তাদের প্রতিপক্ষের মধ্যে রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষে ৭জন নিহতের ঘটনায় অনেকটা আত্নগোপনে চলে যায় ইউপিডিএফ। বেশ কয়েকবছর ধরে তাদের কার্যক্রম অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে চেলে যায়। এর মধ্যে জেএসএস এর সাথে শুরু হয় নতুন করে বিরোধ।
পাহাড় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দলীয় আন্তকোন্দল, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক ভাবে কোনঠাসা হয়ে পড়া ইউপিডিএফ হঠাৎ করেই ৫ আগষ্টের পর ইউনূস সরকারের আনুকূল্য পেয়ে নতুন করে পাহাড়ে সশস্ত্র ও রাজনৈতিক ভাবে কোমড় সোজা করে দাঁড়াতে চাইছে।
সাম্প্রতিক সময়ে খাগড়াছড়িতে বেশ কয়েকটি অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্য ইউপিডিএফকে দায়ী করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানিয়েছে, যে ইউপিডিএফ গত বেশ কয়েকবছর ধরে প্রকাশ্যে আসার সাহস করতে পারে নি, ৫ আগষ্টের পর জেলা শহরের স্বনির্ভরে সেই ইউপিডিএফ তাদের অফিস খুলে প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। কথিত আছে, বিএনপি সরকারের আমলে পাহাড়ে ইউপিডিএফকে সবচেয়ে বেশী সুবিধা-সুবিধা পাইয়ে দেয়া সাবেক এক উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্যের ইশারায় ইউপিডিএফ পুনরায় জেলা শহরে নিজেদের কার্যক্রমে ফিরেছে।
খাগড়াছড়িতে সম্প্রতি চুরির দায়ে এক বাঙ্গালী যুবককে হত্যার ঘটনায় জেলা শহর, পানছড়ি, দীঘিনালা ও রাঙামাটি সৃষ্ট সহিংসতায় ইউপিডিএফ যখন সর্বমেহলে কোনঠাসা হয়ে পড়ে তখনই ওই সাবেক সংসদ সদস্য দ্বিতীয়বার ইউপিডিএফকে উদ্ধার করার ভুমিকা পালন করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায় খাগড়াছড়িতে মামুনকে হত্যা করেছে উপজাতি আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী দলের সদস্যরা। আর মামুনের স্ত্রীকে দিয়ে সদর থানায় মামলা করানো হয়েছে বাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনার মাধ্যমে মূলত খাগড়াছড়ির দুই পরিবারের রাজনৈতিক ক্ষোভ প্রকাশ্যে আসলো। সাবেক ওই এমপির সাথে সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল আলম, জাহিদুল আলমদের রাজনৈতিক দ্বন্ধ বহু পুরনো। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে খাগড়াছড়িতে এমপি থেকে শুরু জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সবাই তার সাথে সমন্বয় করে চললেও আলম পরিবারের সাথে শত্রুতা ছিলো প্রকাশ্যে। সরকার পতনের পর এবার আলম পরিবারের লোকজন কিংবা তাদের অনুসারীদের হামলা-মামলায় জড়ানোর কাজ করছেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় তার নির্দেশে মামুন হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রীকে দিয়ে আলম পরিবারের অনুসারী বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে মামলা করানো হয়। এতে করে সাবেক ওই এমপি রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নিলেন ঠিক-ই, কিন্তু যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরো পাহাজুড়ে অস্থিরতা, সেই ঘটনার প্রকাশিত ভিডিও উপজাতি সন্ত্রাসীদের স্পষ্ট দেখা যাবার পরও বাঙ্গালীদের নামে মামলা করার মাধ্যমে পাহাড়ের বাঙ্গালীদের আরেকবার ধাবিয়ে দিয়ে ইউপিডিএফকে সহজে ওই ঘটনা থেকে উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন তিনি।
এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে দুই প্রতিপক্ষ প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ ও সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস এর মধ্যকার সশস্ত্র সংঘাত বেড়েই চলছে। এতে করে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড় থেকে পাহাড়ে।
উল্লেখ্য, সেপ্টেম্বরে খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা ও রাঙামাটিতে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় চারজন নিহত হয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন শতাধিক। অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত ও লুণ্ঠিত হয়েছে শতাধিক ঘরবাড়ি ও দোকানপাট। এ সংঘাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফ’র দুই শতাধিক সদস্য অংশগ্রহণ করেছেন বলেও জানা যাচ্ছে। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও (সন্তু এবং লারমা)র পক্ষ হতে শুরু থেকেই সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর খাগড়াছড়ি এবং রাঙামাটির সহিংসতার ঘটনায় ইউপিডিএফকে দায়ী করা হয়।
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।