তিনমাসে ১২০ ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশে পুশইন করেছে বিএসএফ, সবাই মুসলিম

তিনমাসে ১২০ ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশে পুশইন করেছে বিএসএফ, সবাই মুসলিম

তিনমাসে ১২০ ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশে পুশইন করেছে বিএসএফ
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

নিজাম আহমেদ (৪৮)। নিজাম আহমেদের ঠিকানা- পিতা- মৃত সেলিম উদ্দিন আহমেদ। গ্রাম-জামুগুরিটিই, পোষ্ট-ওতনাটিং, থানা-জামুগুরি, জেলা- ঘোলাঘাট, রাজ্য-আসাম, ভারত। নিজামের বাবা সেলিম উদ্দিন আহমেদ ভারতের আসাম ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড এপিবিএনে কনস্টেবল হিসাবে চাকরি করতেন। নিজাম আহমেদ পেশায় একজন গাড়িচালক। ২৫ মে সকাল সাড়ে ৭ টার দিকে স্থানীয় থানা পুলিশের একটি টিম তার বাড়িতে এসে জানায় যে থানায় যেতে হবে। পুলিশের কথা অনুযায়ী পুলিশের গাড়িতে করে থানায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। থানার ওসি তাকে জানায় যে এসপি অফিসে যেতে হবে। এ কথা শুনে নিজাম আহমেদ পুলিশকে হিন্দি ভাষায় বলেন, ‘হাম তো কয়ি ঝগড়া নেহি কিয়া। তো কিউ হামকো এসপি অফিস পে জানে হে।’ যথারীতি ওসির গাড়িতে করে এসপি অফিসে নেয়া হয়। সেখানে বেশ কিছু কাগজপত্রে নাম ঠিকানা ও আধার কার্ডের নম্বর লিখতে হয়। কাগজপত্রে আঙ্গুলের ছাপ নেয়া হয়। এরপর এসপি অফিসের সামনে দুইটি পাবলিক বাস অপেক্ষা করছিল। ওই বাসে আরও অনেক মানুষ ছিল। বাসে কোথায় যেতে হবে জানতে চাইলে নিজামকে এসপি হিন্দি ভাষায় বলেন, ‘এক জায়গা ছে যাও। আজ ছে যাও। কাল উহা পে কাগজে ভেরিফাইড হোগায়া।’ তার কথা বিশ্বাস করে সবাই ওই দুই গাড়িতে করে রওয়ানা দেয়। এরপর গাড়ি চলতে থাকে দুই দিন ধরে চলতে থাকে। গাড়ির জানালাও ঠিকমত তাদেরকে খুলতে দেয়া হয়নি। ২৭ মে রাত সাড়ে ১০ টার দিকে একটি জায়গায় গাড়ি থামিয়ে খাবার দেয়া হয়। এই দুই দিন গাড়িতে পানি ছাড়া কিছুই খেতে দেয়া হয়নি। খাবার দেয়ার পর তাদেরকে বিএসএফের একটি গাড়িতে তোলা হয়। গাড়ি চলতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে কুচবিহার জেলার সীমান্তবর্তী বিএসএফের একটি বিওপিতে গাড়ি এসে থামে। রাত তখন সাড়ে ১০ টা । গাড়ি থেকে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া দেখতে পান। সীমান্তের লাইটের আলোতে সব কিছুই তারা পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছিলেন। কাঁটাতারের বেড়ার ১৪ নম্বর গেট। তখন বাসের লোকজনের মত নিজামও বুঝতে পারেন যে তাদেরকে ‘বর্ডারে’ আনা হয়েছে। গাড়ি থেকে এক এক করে তাদেরকে নামার নির্দেশ দেয় বিএসএফের সদস্যরা। বিএসএফের এক সদস্য হিন্দি ভাষায় তাদেরকে বলেন, ‘যাব লাইট বুতা দেগা, তোম লোক দৌড়কে নিকাল যাও। আগার পিছা আয়েগা, তো ডাইরেক্ট শুট করুঙ্গা। আগে যাতে রাহো।’ সীমান্তের লাইট বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে নিজামসহ ২০/২৫ গেট দিয়ে ঢুকে জমি দিয়ে হাঁটতে থাকেন। ভোরের আলো ফোটার পর তারা বুঝতে পারেন যে এটা বাংলাদেশ। পরে লালমনিরহাটের সীমান্তবর্তী একটি স্কুল ঘরে আশ্রয় নেয়।

নিজাম আহমেদের মত ভারতের অন্তত দেড়শ নাগরিককে বাংলাদেশে পুশইন করে বিএসএফ। গত ৫ মে থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত বিজিবি সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ২ হাজার মানুষকে ভারতীয় বিএসএফ পুশইন করেছে। পুশইন করা নাগরিকদের মধ্যে ভারতীয় এবং মিয়ানমারের বাস্তচুত রোহিঙ্গাও রয়েছে।

এসব বিষয়ে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, সিলেট, খাগড়াছড়ি, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারীতে বিজিবির সংশ্লিষ্ট ব্যাটালিয়নগুলো বিএসএফের পুশইনের শিকার ভারতীয় নাগরিকদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যেমন-আধার কার্ড, ভারতের আয়কর সনদ, রেশন কার্ডসহ অনেকের জায়গা-জমির দলিলপত্রের ফটোকপি তাৎক্ষণিক তাদের কাছ সংগ্রহ করে। ভারতে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে তাদের যোগাযোগ করিয়ে দেয়া হয়।

এ ব্যাপারে বিজিবি সদর দপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ১২০ জন ভারতীয় নাগরিককে পুশইন করার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বিএসএফের পুশইনের শিকার সবাই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। অন্য কোনো ধর্মের বা উপজাতিদের কেউই পুশইনের শিকার হননি।

ভারতের আসামের মুরিগাঁও গ্রামের ৪৮ বছর বয়সী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক খায়রুল ইসলাম। খায়রুল বর্ণনা করেছেন যে কীভাবে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সদস্যরা কোনও সতর্কতা ছাড়াই এসেছিলেন। তিনি বলেন, ‘তারা আমাকে তুলে নিতে এসেছিল। আমি প্রতিরোধ করেছিলাম। আমি জিজ্ঞাসা করতে থাকি,  কেন আমাকে? আমি কী করেছি?  কিন্তু তারা কোনও উত্তর দেয়নি। তারা আমাকে চড় মেরেছিল।’

তিনি বলেন, তারা আমার হাঁটুর মাঝখানে লাঠি দিয়ে আঘাত করে। তারপর তারা আমার চোখ বেঁধে, হাত বেঁধে, আমাকে গাড়িতে তুলে দেয়। আমি চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়েছিলাম। আমি জানতাম না আমরা কোথায় যাচ্ছি। অবশেষে কেউ একজন আমার চোখের বাঁধন খুলে দিল। এটা বাংলাদেশ ছিল। কিন্তু আমি অবাক হয়েছি, বাংলাদেশের লোকেরা আমার সাথে সদয় আচরণ করেছে। তারা আমাকে খাওয়ায় এবং আমার আহত পায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।

বিজিবির সংশ্লিষ্ট সেক্টর ও ব্যাটালিয়নের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে পুশইন করা ভারতীয় নাগরিকদের বেশ কয়েকজনের নামের তালিকা জানা গেছে। তারা হলেন, আসামের মড়িগাঁও জেলার করুটিপাম গ্রামের জয়নাল আবেদীন, খান্দাখুপুরী গ্রামের খাইরুল ইসলাম, নখলা গ্রান্ট গ্রামের উফা আলী, জানপাড়া গ্রামের আবদুল লতিফ, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার তর্কিপুর গ্রামের নাজিম, কাজীশাহ গ্রামের মিনারুল শেখ, পাইক গ্রামের বশির আহমেদ, করিম হোসেন, সুমি বেগম, সুখীনা খাতুন, বর্ধমান জেলার মোস্তফা কামাল শেখ, চব্বিশপরগণা জেলার বালিহাটি গ্রামের আজিজুল আলী মন্ডল, ইয়ানুর আলী মণ্ডল, আজমিরা খাতুন, আসামের দরং জেলার শিমুলবাড়ী গ্রামের আলেব আলী, বড়বালা গ্রামের চন্দ্র বানু, নলবাড়ী জেলার ঘেট আল্লীয়া গ্রামের আব্দুল বারিক, সুনিতপুর জেলার ভৌতিরাখনাসুখ গ্রামের জমিলা খাতুন, ধুবরী জেলার নাইদুল গ্রামের দয়জন বিবি, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশপরগণা জেলার হরিহারপুর গ্রামের ফজের মন্ডল, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার কয়লাঘাট থানার এলুমিনিয়া ঘাটের হালিমা খাতুনসহ ১২০ জন।

এ ব্যাপারে বিজিবির মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, ভারতীয় বাহিনীর দ্বারা পুশইন নিয়মিত ঘটছে, যার মধ্যে ভারতীয় নাগরিক এবং রোহিঙ্গারাও রয়েছে-যা মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন। পুশইন চলছে। মাঝে মাঝে এটি কয়েক দিনের জন্য থেমে থাকে, কিন্তু প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে, বিএসএফ ভারতীয় নাগরিকদের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদেরও পুশইন করছে। এ ব্যাপারে আমরা বিএসএফের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। বিজিবির পক্ষ থেকে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয়েছে।

-ইত্তেফাক।