গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে উত্তপ্ত বান্দরবান, হুমকিতে পর্যটন শিল্প
 
                 
নিউজ ডেস্ক
গোষ্ঠীভিত্তিক দ্বন্দ্বে জেরে বান্দরবানে একের পর এক উত্থান হয়েছে নতুন নতুন আঞ্চলিক সংগঠনের। নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে গুম, খুন, চাঁদাবাজিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষেও লিপ্ত হচ্ছে এ সংগঠনের সদস্যরা। ফলে স্থানীয়দের মাঝে দেখা দিয়েছে উৎকণ্ঠা। অবনতি হচ্ছে ব্যবসা বাণিজ্য এবং পিছিয়ে যাচ্ছে পর্যটন শিল্পসহ আর্থসামাজিক উন্নয়ন।
জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে পাহাড়ের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি শান্ত করার লক্ষ্যে আঞ্চলিক সংগঠন জন সংহতি সমিতির (জেএসএস) সঙ্গে শান্তি চুক্তি করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর দীর্ঘদিন পাহাড়ে শান্তি বজায় থাকলেও গোষ্ঠীভিত্তিক দ্বন্দ্বের জেরে পার্বত্য অঞ্চলে একের পর এক উত্থান হয়েছে নতুন নতুন আঞ্চলিক দলের।
গেল এক দশকে বান্দরবানে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে জেএসএস সংস্কার, ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক মগ লিবারেশন পার্টি ও কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক সংগঠনের। আর এসব সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে জড়িয়ে পড়ছে গুম, খুন, চাঁদাবাজিসহ ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে। শুধু তাই নয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হতেও পিছপা হচ্ছে না তারা।
গত ১২ মার্চ পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন কেএনএফের হামলায় প্রাণ হারায় সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট মাস্টার অফিসার নাজিম উদ্দিন। আহত হয় আরও দুই সেনা সদস্য। এরপর থেকে উত্তপ্ত হয়ে উঠে রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার পরিবেশ।
এমন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ১৪ মার্চ থেকে এ তিন উপজেলায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে প্রশাসন। আর এসব কারণে ভয়, উৎকণ্ঠা ও শঙ্কায় দিন যাপন করছে পাহাড়ে বসবাসকারীরা।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি জেলা পরিষদের সদস্য বাশৈসিং মার্মা বলেন, পাহাড়ে গোলাগুলি, খুন ও অপহরণের কারণে আমরা খুব আতঙ্কে আছি। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদে সরে গেছে। আমরা এ অশান্তি চাই না। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, দ্রুত যেন এ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায়।’
দুর্গম পাহাড়ের কয়েকজন বাসিন্দা জানায়, পাহাড়ের পরিস্থিতি খুবই খারাপ, আতঙ্কে পাড়ার মানুষ নিজেদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে সীমান্ত পথে অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। যারা পাহাড়ে আছে তারাও লুকিয়ে লুকিয়ে কোনো রকম দিন যাপন করছে। চারদিকে বিপদের আশঙ্কা। নিরাপদে কোথাও চলাফেরা করা যাচ্ছে না।
এদিকে তিন উপজেলায় নিষেধাজ্ঞার পর থেকে থমকে গেছে জেলার পর্যটন শিল্প। এ নিষেধাজ্ঞা চলমান থাকলে বড় ধরনের লোকসানের আশঙ্কা পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের।
শহরের আরণ্য হোটেলের মালিক জসিম উদ্দিন বলেন, ‘দীর্ঘদিন মহামারি করোনা ভাইরাসের পর কিছুটা সচ্ছল হতে যাচ্ছিল বান্দরবানের পর্যটন শিল্প। কিন্তু পরবর্তীতে পাহাড়ে যৌথ বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযানের কারণে একের এক নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ফলে পুনরায় থমকে গেছে পর্যটন শিল্প। আমরা চাই দ্রুত এ সমস্যা সমাধান হয়ে বান্দরবানে পর্যটক আসার পরিবেশ ফিরে আসুক।’
তবে পাহাড়ের এ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য গোষ্ঠীভিত্তিক দ্বন্দ্ব, অরক্ষিত সীমান্ত, অপ্রতুল সেনা ক্যাম্প ও অস্ত্রের অবাধ সরবরাহকে দায়ী করছেন বান্দরবান সদর উপজেলার চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর।
তিনি বলেন, ‘পাহাড়ে এখন আমরা কেউ নিরাপদে নেই। কখন কার ওপর হামলা হয় সব সময় সেই ভয়ে আছি। পাহাড়ের ভেতরে ব্যবসায়ীরা যেতে পারছে না। তাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করছে সন্ত্রাসীরা। তাই দ্রুত পাহাড়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে চিরুনি অভিযান চালিয়ে অবৈধ অস্ত্র জব্দের পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারলে পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে।’
এ বিষয়ে বান্দরবান জেলার পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘পাহাড়ে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় পুলিশের পক্ষ থেকে তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। আমরা সার্বক্ষণিক সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় কাজ করে যাচ্ছি।’
নিজেদের ভেতকার কোন্দল ও ভাতৃঘাতী সংঘাতে গেল দুই বছরে বান্দরবানে প্রাণ হারিয়েছে ২৩ জন। পাহাড়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধে জোরালো পদক্ষেপ না নিলে দ্বন্দ্ব সংঘাত বাড়বে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
