রামগড়ের পাতাছড়া গণহত্যার ৩৮ বছর আজ, মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি

রামগড়ের পাতাছড়া গণহত্যার ৩৮ বছর আজ, মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি

রামগড়ের পাতাছড়া গণহত্যার ৩৮ বছর আজ, মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

১৯৮৬ সালের আজকের এইদিন (১৩ জুলাই), খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড়ে পাহাড়ের তৎকালীন সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল শান্তিবাহিনীর হাতে গণহত্যার স্বীকার হন পাতাছড়ার ডাকবাংলা এলাকার বেশ কয়েকজন নিরীহ বাঙ্গালী মুসলিম জনতা। ঘটনাচক্রের ৩৮ বছর আজ। সেদিনের বিভীষিকাময় স্মৃতি এখনও ভুলতে পারেনি ডাকবাংলা পাড়ার বাসিন্দারা। তৎকালীন শান্তিবাহিনীর একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসীর এলোপাতাড়ি গুলি ও অগ্নিসংযোগে সেদিন নিহত হয়েছিল ৫ শিশুসহ ৭ জন। কয়েকদিন পর ঘটনাস্থলের খুব কাছ থেকে আরও একজনের মরদেহ উদ্ধার করেছিল স্থানীয়রা। একই বছরের ১৩ আগস্ট বাড়ির পাশের টিলায় গরু চরাতে গেলে স্বজনদের সামনে থেকে মো. আদম ছফি উল্লাহ নামে একজনকে ধরে ফেনী নদীর পিলাক ঘাটের ওপারে নিয়ে যায় শান্তিবাহিনীর সদস্যরা। পরবর্তীতে তার লাশ না পাওয়া গেলেও সন্ত্রাসীরা তাকে কেটে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলো বলে জানায় ভারত ফেরত উপজাতি শরণার্থীরা।

প্রথমদিনের ঘটনায় নিহতদের গণকবরে ঠাঁই হলেও পরবর্তীতে নিহতদের কপালে তাও জুটেনি। নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর পরপর এমন হামলায় ভয়ে পালিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল ২ শতাধিক পরিবার। কয়েক বছর পর নিজেদের বাস্তুভিটায় ফেরার চেষ্টা করলেও তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রশাসন ফিরতে দেয়নি। ফেরা হয়নি গত ৩৮ বছরেও।

কয়েক বছর আগে শান্তিবাহিনীর হাতে সেদিন নির্মমভাবে নিহতদের স্বজন ও এলাকাবাসী ডাক বাংলা এলাকায় গণকবরটি সংস্কার করে গণকবর ও গণহত্যার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরে টানিয়েছেন একটি সাইনবোর্ড। সরকারী ভাবে গণকবরটিতে স্বীকৃতিসহ গণহত্যায় নিহতদের পরিবারকে সরকারীভাবে ক্ষতিপূরণ, দোষীদের বিচার ও নিজ ভূমিতে ফেরার ব্যবস্থা করতে সরকারের কাছে দাবী জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

রামগড়ের পাতাছড়া গণহত্যার ৩৮ বছর আজ, মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি

আর গণহত্যা দিবস উপলক্ষ্যে পাতাছড়া জামে মসজিদ সংলগ্ন গণকবরের সামনে সকালে একত্রিত হন সেদিন নিহত হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা। কান্না আর আহাজারিতে মূহূর্তেই ভারী হয়ে উঠে পরিবেশ। কারো বাবা, কারো মা, কারো ভাই কিংবা বোন চোখের সামনে নির্মম ভাবে হত্যার স্বীকার হয়েছিলো সেদিন, তাইতো আজ ৩৮ বছর পরেও কলিজার টুকরা স্বজনের কবরের পাশে উপস্থিত প্রিয়জনরা। গণহত্যা দিবসের প্রতিটি বছরে এসে গণকবরের পাশে ফজরের নামাজের পর দোয়া ও মোনাজাতের আয়োজন করে নিহতের স্বজন ও স্থানীয় যুবকরা।

রামগড়ের পাতাছড়া গণহত্যার ৩৮ বছর আজ, মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি

প্রত্যক্ষদর্শীদের চোখে ১৯৮৬ সালের ১৩ জুলাই

মো. নাসির উদ্দিন নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ঘটনার দিন মাগরিবের কিছু সময় আগে হঠাৎ করে একদল অস্ত্রধারী শান্তিবাহিনীর সদস্য বাড়িতে ঢুকে পড়ে। কিছু বুঝে উঠার আগে এলোপাঁতাড়ি গুলি ছুঁড়ে। এ সময় গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় কেউ কাউকে উদ্ধারে এগিয়ে আসতে পারেনি। সন্ত্রাসীরা গুলি করতে করতে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। আমার (নাসির) ছোট ভাই আবুল কাশেমকে আগুনে নিক্ষেপ করে। এ সময় আমাকেসহ নিয়ে মা বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করে। মায়ের কোলে একবছর বয়সী ছোট বোন আনোয়ারা থাকলেও ভুলে আরেক বোন মনোয়ারাকে বাড়ির ভেতর রেখে আসেন। মনোয়ারাকে আনতে মা বাড়ির ভেতর গেলে সন্ত্রাসীরা মাকে গুলি করে এবং ছোট বোন আনোয়ারাকে মায়ের কুল থেকে কেড়ে নিয়ে আগুনে নিক্ষেপ করে। আর মনোয়ারাকে মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে খুন করে। পরেরদিন আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সহ গিয়ে মরদেহগুলো উদ্ধার করে রাস্তার পাশে গণকবরে দাফন করি।

ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী নজরুল ইসলাম জানান, ১৩ জুলাই সকালে পাতাছড়ার ডাকবাংলা গ্রামে বাইরে থেকে কিছু অপরিচিত লোকজন আসে। স্থানীয় এক পাহাড়ীর বাড়িতে তারা কাজে এসেছেন বলে জানান। আসরের পরপর যখন হামলা শুরু হয় তখন তাদেরকেও সন্ত্রাসীদের সাথে দেখার কথা জানান নজরুল। বাড়িতে ঢুকে মা ছবুরী খাতুনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে এবং বোন রেহানা আক্তারকে আগুনে নিক্ষেপ করে হত্যার কথা ভুলতে পারেনি এখনও।

রামগড়ের পাতাছড়া গণহত্যার ৩৮ বছর আজ, মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি

পাতাছড়ার বাসিন্দা ও তৎকালীন আনসার সদস্য মো. মমতাজ মিয়া জানান, ৩৪ বছর অতিবাহিত হলেও নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত গণহত্যার কোন নথিতে উল্লেখ নেই। স্বজন হারানোর কষ্ট বুকে চেপে জীবন রক্ষায় সেদিন কোন মতে একটি কবরে স্বজনদের রেখে চলে যেতে হয়েছিল নিরহ গ্রামবাসীদের।

গণহত্যায় নিহত হয়েছিলেন যারা

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে সেদিন পাতাছড়া ডাকবাংলা পাড়া গণহত্যায় নিহত হয়েছিলেন, আবুল খায়েরের স্ত্রী হালিমা বেগম(৫৫), মেয়ে মনোয়ারা বেগম(৬), ছেলে আবুল কাশেম(৫), আনোয়ারা বেগম(১), ছায়েদুল হকের স্ত্রী ছবুরী খাতুন ও মেয়ে রেহানা রেহানা আক্তার। লাল মিয়ার মেয়ে মফিজা খাতুন। ১৯৮৬ সালের ১৩ জুলাই নিহতদের সবাইকে পাতাছড়া এলাকায় গণকবর দেওয়া হয়। পরেরদিন ১৪ জুলাই মো. সাত্তার নামে একজনের গলাকেটে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। একই বছরের ১৩ আগস্ট মো. আদম ছফি উল্লাহ নামে একজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুম করা হয়।

গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী, নিহতদের স্বজন ও স্থানীয়দের দাবি, ১৯৮৬ সালের ১৩ জুলাই নিহতদের গণকবর সংরক্ষণের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ববর্তী সময়ে তিন পার্বত্য জেলায় সংগঠিত বিভিন্ন গণহত্যার নথিপত্রে রামগড়ের পাতাছড়া গণহত্যার ঘটনা প্রকাশ করা হোক। এছাড়া বাস্তুভিটাহীন পরিবারগুলোকে নিজ ভূমি ফেরত পাঠানোসহ প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণসহ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার দাবী তাদের।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।