বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় জরিপ চালাবে নরওয়ের জাহাজ: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা

বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় জরিপ চালাবে নরওয়ের জাহাজ: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা

বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় জরিপ চালাবে নরওয়ের জাহাজ: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সহযোগিতায় নরওয়ের সামুদ্রিক গবেষণা জাহাজ ” আর ভি ড. ফ্রিডথজফ ননসেন” বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমায় ‘ফিশারিজ রিসোর্সেস অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভে’ পরিচালনা করবে। চলতি বছরের ২১ আগস্ট থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ জরিপ চলবে বলে মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।

তিনি বলেন, নরওয়ে একটি মাছপ্রধান দেশ। বাংলাদেশের মাছের যে গুরুত্ব কিংবা এক্ষেত্রে যে সমস্যা সেটি তারা গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করে।

উপদেষ্টা জানান, বঙ্গোপসাগর হতে আহরিত মৎস্যসম্পদ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং কর্মসংস্থানসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমা, যার আয়তন প্রায় ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার, যা জৈবিক ও অজৈবিক সম্পদে (Living and non-living resources) সমৃদ্ধ। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে বিশাল সম্ভাবনাময় এ খাত দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

তিনি আরও বলেন, “R.V. Dr. Fridtjof Nansen” হচ্ছে জাতিসংঘের পতাকাবাহী সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ ও ইকোসিস্টেম গবেষণায় একটি অত্যাধুনিক জাহাজ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রণে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) এর সহযোগীতায় Norwegian এ গবেষণা জাহাজটি সামুদ্রিক গবেষণা ও সার্ভে ক্রুজ পরিচালনা করে। বাংলাদেশের আমন্ত্রণে ১৯৭৯ সালে সর্বপ্রথম এবং ১৯৮০ সালে দ্বিতীয়বার এ জাহাজটি বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় গবেষণা ও সার্ভে ক্রুজ পরিচালনা করে। তৃতীয়বার, FAO এবং Institute of Marine Research (IMR), Norway কর্তৃক ০২-১৭ আগস্ট ২০১৮ পর্যন্ত উক্ত জাহাজ দ্বারা বঙ্গোপসাগরে ১ টি মৎস্যসম্পদ ও ইকোসিস্টেম গবেষণা ও জরিপ ক্রুজ পরিচিালিত হয়। উক্ত জরিপে উপকূলীয় ২০-২০০ মিটার পানির গভীরতায় বিদ্যমান ছোট আকারের পেলাজিক (Small Pelagic) মৎস্যসম্পদের মজুদ নিরুপনের পাশাপাশি দেশের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক এলাকায় (EEZ) প্রায় ২২০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত জলসীমায় ইকোসিস্টেম গবেষণা এবং জলপ্রবাহের অবস্থা, উদ্ভিদ ও প্রাণিকণার উপস্থিতি, পেলাজিক ও মেসোপেলাজিক মাছের প্রাচুর্যতা, প্লাস্টিক দূষণ ও খাদ্য নিরাপত্তা, এবং মাছের পুষ্টিগুণ বিষয়েও জরিপ ও গবেষণা পরিচালিত হয়েছিল। মৎস্য সম্পদের মজুদ নিরুপন করা এবং ইকোসিস্টেমের সার্বিক অবস্থা নিরীক্ষণের জন্য সামুদ্রিক জলসীমায় মাছের জরিপ এবং ইকোসিস্টেম নিরীক্ষণ একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের অনুরোধে, FAO কর্তৃক অনুমোদিত ২০২৫ সালের জরিপের সময়সূচীতে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় উক্ত জরিপ সম্পাদনের সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ২১ আগষ্ট হতে ২১ সেপ্টেম্বর। উক্ত কার্যক্রমে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থার ১৩ জন National Scientiest সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মোট ২৬ জন গবেষক অংশগ্রহণ করবেন। এ লক্ষ্যে ২০ আগস্ট ২০২৫ তারিখে দেশের ১৩ জন গবেষক শ্রীলঙ্কার কলম্বো পোর্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। বাংলাদেশের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক এলাকায় প্রায় ৩২ দিন ব্যাপী গবেষণা ক্রুজ শেষে গবেষকদল আগামী ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করবেন।

ফরিদা আখতার জানান, গবেষণা জাহাজ “R.V. Dr. Fridtjof Nansen এর মাধ্যমে উক্ত জরিপ কার্যক্রম সম্পাদনের ফলে উপকূলীয় এবং গভীর সমুদ্রে বিদ্যমান ছোট আকারের পেলাজিক (Small Pelagic) ও মেসোপেলাজিক মাছের আপেক্ষিক প্রাচুর্যতা ও মজুদ নির্ধারণসহ ইকোসিস্টেমের সার্বিক অবস্থা নিরুপন করা হবে, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে টেকসই আহরণের সীমা নির্ধারণের পাশাপাশি গভীর ও আন্তর্জাতিক সমুদ্র অঞ্চলে বাণিজ্যিক মৎস্যসম্পদের অনুসন্ধান ও আহরণে বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।

তিনি আরও বলেন, একচ্ছত্র অর্থনৈতিক এলাকায় এবং এর বাইরের আন্তর্জাতিক সমুদ্র অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিষয়াদী যেমন-Oxyzen Minimum Zone (OMZ), কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মহাসাগরের তাপমাত্রা, সমুদ্রের পানির এসিডিটি পরিমাপ পূর্বক উক্ত বিষয়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব নিরীক্ষণ করা হবে। এই তথ্য ভবিষ্যতের অভিযোজন কৌশল নির্ধারণে সহায়ক হবে। সাম্প্রতিক সময়ে জেলিফিশ মৎস্য আহরণে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে জেলিফিশসহ অন্যান্য অযাচিত প্রজাতির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সম্পর্কে অধ্যয়ন ও গবেষণার ক্ষেত্র উন্মোচিত হবে। উক্ত জরিপে এদের শনাক্তকরণ, বিতরণ এবং আহরণের ঘনত্ব নির্ধারণ করার পরিকল্পনা অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।

অন্যদিকে, মাইক্রোপ্লাস্টিক কণিকা সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। এগুলো মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর শরীরে জমে দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে এবং মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাকেও প্রভাবিত করতে পারে। এই জরিপে মাইক্রোপ্লাস্টিক ও সামুদ্রিক আবর্জনার উপস্থিতি ও প্রভাব বিশ্লেষণ করা হবে। সামুদ্রিক মাছ ও প্ল্যাঙ্কটনে মাইক্রোপ্লাস্টিকের বিষাক্ততা ও রাসায়নিক পদার্থ চিহ্নিত করা হবে। এতেকরে সামুদ্রিক পরিবেশ রক্ষায় নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ সহজ হবে।

ফরিদা আখতার বলেন, ২০১৬ সাল থেকে মৎস্য অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে গবেষণা জাহাজ “আর.ভি. মীন সন্ধানী” দ্বারা বঙ্গোপসাগরের মহীসোপান এলাকায় (১০-২০০ মিটার গভীরতা) ধারাবাহিক জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে- চিংড়ি ও তলদেশীয় মাছের প্রজাতিগত বিন্যাস (Species composition), ভৌগোলিক বিস্তার (Geographical distribution), আপেক্ষিক প্রাচুর্যতা (Relative abundance) নির্ধারণ চলমান রয়েছে। এ পর্যন্ত জরিপের মাধ্যমে ৪৫৮ প্রজাতির মাছ ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি এবং অন্যান্য সামুদ্রিক প্রজাতি সনাক্ত হয়েছে। ২০১৬ সাল হতে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পরিচালিত মোট ৪৪ টি সার্ভে ক্রুজ হতে প্রাপ্ত তথ্য এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও আর্টিসানাল ল্যান্ডিং তথ্য বিশ্লেষণপূর্বক মজুদের ২টি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। উক্ত প্রতিবেদনে ২ টিতে ৮টি গুরুত্বপূর্ণ স্টকের বিস্তারিত বিশ্লেষণ এবং সকল ধরণের ফিনফিশ ও চিংড়ির মজুদ সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা প্রদান করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, সমুদ্রে এক্যুয়াস্টিক সার্ভে এর মাধ্যমে ছোট আকারের পেলাজিক (Small Pelagic) মাছের মজুদ নিরূপণে প্রয়োজনীয় আধুনিক সরঞ্জামাদি (ফিশিং গিয়ার, সায়েন্টিফিক সোনার ও ইকো-সাউন্ডার) “আর. ভি. মীন সন্ধানী” জাহাজের সক্ষমতায় সীমাবদ্ধতা রয়েছে। একইসাথে, “আর. ভি. মীন সন্ধানী” এর পক্ষে ২০০ মিটারের অধিক গভীরতায় সকল মৌসুমে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হয় না বিধায়, টুনা ও অন্যান্য পেলাজিক মৎস্য জরিপ ও মজুদ নিরূপণ এবং ইকো-সিস্টেম সার্ভের জন্য উপযুক্ত বড় আকারের জরিপ জাহাজ (All weather vessel) প্রয়োজন। সে আলোকে, ২০১৮ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)-কে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুরোধের প্রেক্ষিতে “R.V. Dr. Fridtjof Nansen” জরিপ ও গবেষণা জাহাজ এর মাধ্যমে দেশের সামুদ্রিক জলসীমায় ফিশারিজ ও ইকোসিস্টেম জরিপ পরিচালনা করা হয়।

উপদেষ্টা জানান, “R.V. Dr. Fridtjof Nansen” এর ২০২৫ সালের জরিপ বাংলাদেশের সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই জরিপ থেকে প্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য বাংলাদেশের মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ, টেকসই আহরণ, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজন, এবং সামুদ্রিক পরিবেশ রক্ষায় জাতীয় নীতি প্রণয়নে সরাসরি সহায়তা করবে। এছাড়া এটি বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করবে। সমুদ্রের বিভিন্ন গভীরতা ও পরিবেশ অনুযায়ী আবাসস্থলের মানচিত্র তৈরি করা হবে, যা প্রজাতি সংরক্ষণ ও মৎস্য ব্যবস্থাপনায় সহায়ক হবে। আমরা আশা করি, এর মাধ্যমে গভীর সমুদ্রের সম্ভাবনা উন্মোচিত হবে, টেকসই মৎস্য আহরণের পথ সুগম হবে এবং সামুদ্রিক পরিবেশ রক্ষায় বৈজ্ঞানিক তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ হবে।

ব্রিফিংয়ে নরওয়ে দূতাবাসের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।