কাশ্মির স্বাধীনতা আন্দোলনের শীর্ষ নেতার সাথে ভারতের গোপন সমঝোতা

কাশ্মির স্বাধীনতা আন্দোলনের শীর্ষ নেতার সাথে ভারতের গোপন সমঝোতা

কাশ্মির স্বাধীনতা আন্দোলনের শীর্ষ নেতার সাথে ভারতের গোপন সমঝোতা
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা হিসেবে পরিচিত ইয়াসিন মালিক। তিনি বর্তমানে নয়াদিল্লির তিহার জেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন। একসময় সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতীক ছিলেন, পরে অহিংস প্রতিরোধের পথ বেছে নেন। তবে গত আগস্টের শেষে দিল্লি হাইকোর্টে ৫৯ বছর বয়সী মালিক এক চাঞ্চল্যকর হলফনামা দাখিল করেছেন। এই হলফনামা ভারতের রাজনীতিতে তোলপাড় তুলেছে। তার দাবি, তিনি বছরের পর বছর ধরে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ‘গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ’ হিসেবে কাজ করেছেন।

৮৪ পৃষ্ঠার হলফনামায় মালিক দাবি করেছেন, ১৯৯০-এর দশক থেকে, যখন কাশ্মিরি যুবকদের সশস্ত্র বিদ্রোহ তুঙ্গে, তখন থেকে তিনি সঙ্ঘাত নিরসনের জন্য ভারত সরকারের শীর্ষ কর্তৃপরে সাথে যুক্ত ছিলেন। তার এই দাবির পরিপ্রেেিত প্রশ্ন উঠেছে তিনি কি শুরু থেকেই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার গোপন সহযোগী ছিলেন?

মালিক জানান, তিনি একাধিক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান, এমনকি কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) সদস্যদের সাথেও সাাৎ করেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, কাশ্মিরের শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে ভারত সরকার অনুমোদিত ব্যাক-চ্যানেল কূটনীতির অংশ হিসেবে এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বহুবার তাঁর শ্রীনগরের বাসভবনে এসেছিলেন।

সবচেয়ে চমকপ্রদ দাবিগুলোর মধ্যে একটি হলো: ২০০৬ সালে পাকিস্তানের জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তাইয়েবার প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ সাঈদের সাথে তার বৈঠকটি তার নিজস্ব উদ্যোগ ছিল না, বরং সাঈদকে অস্ত্র ছাড়তে রাজি করানোর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) আয়োজন ছিল। শ্রীনগরের মাইসুমার বাসিন্দা ইয়াসিন মালিক ১৯৮৭ সালের বিতর্কিত স্থানীয় নির্বাচনের পরই ক্ষুব্ধ হয়ে পাকিস্তানে সামরিক প্রশিণ নিতে যান। ফিরে এসে তিনি জম্মু ও কাশ্মির লিবারেশন ফোর্সের (জেকেএলএফ) কমান্ড গ্রহণ করেন এবং ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বেশ কয়েকটি প্রাণঘাতী হামলার নেতৃত্ব দেন।

তবে কাশ্মিরকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তিনি পাকিস্তানের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৯০ সালে গ্রেফতারের পর তাকে তিহার জেলে রাখা হয় এবং পরে দিল্লির উপকণ্ঠে একটি গেস্টহাউজে স্থানান্তর করা হয়। ইয়াসিন মালিক দাবি করেন, সেখানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্র শেখরসহ ভারতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রায় প্রতিদিন তার সাথে দেখা করতেন এবং সশস্ত্র বিদ্রোহ থেকে সরে আসার জন্য অনুরোধ করতেন।

মালিক দাবি করেন, ১৯৯৪ সালে তাকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয় একটি নিশ্চিত বোঝাপড়ার ভিত্তিতে। সেই বোঝাপড়ার অংশ হিসেবে তিনি প্রকাশ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহ ত্যাগ করে মহাত্মা গান্ধীর প্রচারিত অহিংস উপায়ে কাশ্মিরের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার ঘোষণা দেন। প্রায় ২৫ বছর ধরে তিনি অহিংস বিােভের নেতৃত্ব দিয়েছেন। যদিও সশস্ত্র লড়াই তাকে কাশ্মিরি জনগণের কাছে এক আপসহীন নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

২০১৯ সালে কাশ্মিরের পুলওয়ামায় সন্দেহভাজন বিদ্রোহীদের আত্মঘাতী হামলার পর ইয়াসিন মালিকের জীবনে নাটকীয় মোড় আসে। তাকে গ্রেফতার করা হয়, তার দল জেকেএলএফ নিষিদ্ধ হয় এবং তার বিরুদ্ধে বহু পুরনো মামলাগুলো (যেমন-১৯৮৯ সালে রুবাইয়া সাঈদ অপহরণ, ১৯৯০ সালে ভারতীয় বিমানবাহিনীর চার সদস্যকে হত্যা এবং পাকিস্তানের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ) পুনরায় চালু করা হয়।

বর্তমানে জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে মৃত্যুদণ্ডে উন্নীত করার জন্য আদালতে আবেদন করেছে। এর জবাবেই মালিক হলফনামা দাখিল করে দাবি করেছেন, সরকার ২৫ বছর ধরে তার প্রতি এই বোঝাপড়ার সম্মান দেখিয়েছিল যে অহিংস পথে থাকলে তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনা হবে না। তার মতে, এনআইএ এখন তাকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে ফাঁসানোর জন্য অভিযোগগুলোকে বিকৃত করছে।

মালিকের হলফনামা থেকে আরো জানা যায়, তিনি ২০১৬ সালে বিদ্রোহী নেতা বুরহান ওয়ানি হত্যার পর কাশ্মির উপত্যকায় সৃষ্ট জনপ্রিয় বিদ্রোহ দমনে ভারত সরকারকে সহায়তা করেছিলেন। তিনি দাবি করেন, সরকারের সম্মতিতেই তিনি সে সময়কার প্রবীণ স্বাধীনতাপন্থী নেতা সৈয়দ আলী শাহ গিলানির সাথে দেখা করে বিােভ কর্মসূচি সাময়িকভাবে স্থগিত করার অনুরোধ করেন, যার ফলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়।

তিনি ২০০০ সালে ভারতীয় শিল্পপতি ধীরুভাই আম্বানির সাথে গোপন ব্যাক-চ্যানেল আলোচনায় জড়িত থাকার বিষয়টিও প্রকাশ করেন। আম্বানি ওই সময় কাশ্মির সঙ্ঘাতের কারণে তার গুজরাটের তেল শোধনাগার প্রকল্পের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। এ ছাড়া ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর আমলে তিনি একটি ভারতীয় পাসপোর্ট পেয়েছিলেন এবং বিদেশে ভ্রমণের বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপকে অবহিত করতেন বলেও দাবি করেন।

জম্মু ও কাশ্মিরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ইয়াসিন মালিকের এই নতুন তথ্যের আলোকে তাকে ‘সহানুভূতিশীল দৃষ্টিতে’ দেখার জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কাছে চিঠি লিখেছেন। মুফতি তার এক নিবন্ধে আফজাল গুরুর ফাঁসির ঘটনার সাথে মালিকের মামলার তুলনা করে বলেন, ভারত রাষ্ট্র সাময়িক ল্য অর্জনের জন্য মানুষকে ব্যবহার করে এবং পরে তাদের আর প্রয়োজন না থাকলে বর্জন বা শাস্তি দেয়।

তবে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আজাই সাহনি মনে করেন, মালিকের এই তথ্য ফাঁস তার সততা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। সাহনি বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে হত্যা ও সন্ত্রাসের মামলা আছে। তিনি হয়তো সরকারের কারও কাছাকাছি ছিলেন। সে কারণেই তাকে মুক্ত থাকতে দেয়া হয়েছিল। আপনি রাষ্ট্র দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছেন বলেই যে আপনি একজন সৎ ব্যক্তি, তা কিন্তু নয়। বরং উল্টোটা যদি আপনার সততা থাকত, তবে রাষ্ট্র আপনাকে ব্যবহার করতে পারত না।

অন্য দিকে সাংবাদিক ও লেখক বিক্রম জিত সিং, যিনি ১৯৯০-এর দশকে কাশ্মির সঙ্ঘাত কভার করেছেন, তিনি মালিকের দাবিগুলোকে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ বলে মনে করেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এমন পরিস্থিতিতে প্রতিপরে সাথে সেতুবন্ধন তৈরির জন্য এ ধরনের উপাদান ব্যবহার করে থাকে, এটি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।