আন্তর্জাতিক সহায়তা চাহিদার ৫০ শতাংশের কম, ভয়াবহ সংকটের মুখে রোহিঙ্গারা

আন্তর্জাতিক সহায়তা চাহিদার ৫০ শতাংশের কম, ভয়াবহ সংকটের মুখে রোহিঙ্গারা

আন্তর্জাতিক সহায়তা চাহিদার ৫০ শতাংশের কম, ভয়াবহ সংকটের মুখে রোহিঙ্গারা
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

চলতি বছর মার্চে বাংলাদেশ সফরে আসেন জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস। সফরের অন্যতম লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক মঞ্চে রোহিঙ্গা সমস্যাকে জোরালোভাবে তুলে ধরা। এ সময় তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পও পরিদর্শন করেছেন। তার সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এছাড়া সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সাধারণ পরিষদ হলে উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা। সম্মেলনে অন্তত ৭৫টি দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেন বলে জানিয়েছিল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। এছাড়া বিভিন্ন সময় পররাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিভিন্ন প্লাটফর্মে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান ও মানবিক সহায়তা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে আসছেন। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের ডাকে সাড়া নেই। উল্টো চলতি বছর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা মিলেছে চাহিদার অর্ধেকেরও কম।

আন্তর্জাতিক সহায়তা ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলো এখন শুধু খাদ্য বা চিকিৎসাসেবার ঘাটতিতে নয়, বরং পুরো জনগোষ্ঠী অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংকটে পড়েছে। জাতিসংঘের মানবিক কার্যক্রম সমন্বয় সংস্থার (ওসিএইচএ) ফাইন্যান্সিয়াল ট্র্যাকিং সার্ভিসের (এফটিএস) হিসাব অনুযায়ী, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় ২০২৫ সালের জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের আওতায় মোট ৯৩ কোটি ৪৫ লাখ ডলার সহায়তা দরকার ছিল। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত পাওয়া গেছে মাত্র ৪৬ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। যা প্রয়োজনের মাত্র ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় সহায়তার অর্ধেকেরও বেশি (প্রায় ৪৭ কোটি ডলার) এখনো ঘাটতি রয়ে গেছে। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের আওতায় রোহিঙ্গাদের জন্য প্রয়োজন ছিল ৮৫ কোটি ২৪ লাখ ডলার। কিন্তু পুরো বছরে পাওয়া গিয়েছিল মাত্র ৫৪ কোটি ৬৬ লাখ ডলার। যা মোট প্রয়োজনের ৬৪ দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় চলতি বছর আন্তর্জাতিক সহায়তা বেশ কমে এসেছে।

আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন, আশ্রয় ও শিক্ষাসহ প্রায় সব মানবিক খাতে তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সহায়তা এভাবে কমতে থাকলে শিগগিরই রোহিঙ্গা সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে, যা বাংলাদেশের জন্য বড় ঝুঁকিও তৈরি করবে।

মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রায় ১২ লাখের বসবাস এখন বাংলাদেশে। তারা মূলত কক্সবাজার ও ভাসানচরের আশ্রয় শিবিরে শরণার্থী জীবনযাপন করছে। তাদের খাদ্য, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের বেশির ভাগ আসে আন্তর্জাতিক সহায়তা থেকে। সে সহায়তা কমে আসায় রোহিঙ্গা শিবিরগুলো এখন জটিল মানবিক সংকটে পড়েছে। দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানবিক তহবিল কমছে। নতুন যুদ্ধ, দুর্যোগ ও নতুন বিষয়ে মনোযোগ দেয়াসহ—সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে মানবিক সহায়তা কমে এসেছে। ফলে এখন অনেক দাতা সংস্থা সরে যাচ্ছে। এতে রোহিঙ্গা শিবিরে খাবার, পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, আশ্রয় সবকিছুর ওপরই বাজেট কাটছাঁট চলছে। মৌলিক প্রয়োজনীয় পণ্য যেমন শিশুদের দুধ, টয়লেট পরিষ্কার রাখার উপকরণ, এমনকি ওষুধও নিয়মিতভাবে আসছে না।

lead-inside

বিশ্লেষকদের মতে, দাতা সংস্থাগুলো যদি দ্রুত সাহায্য বাড়াতে না পারে তবে এ জনগোষ্ঠীকে দীর্ঘস্থায়ী সংকটের সামনে দাঁড়াতে হবে একেবারে অসহায় অবস্থায়। আর সহায়তার হার যদি নিম্নগামী হতেই থাকে তাহলে কক্সবাজারের হাজারো তাঁবুর নিচে জন্ম নেয়া শিশুরা ভয়াবহ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে। যেখানে খাবার, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ জীবন ধারণের মৌলিক প্রয়োজনীয়তার নিশ্চয়তা থাকবে না।

আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সংকট নতুন ও গভীর ঝুঁকির দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখন যেমন সহায়তা কমেছে, সামনে তা আরো কমবে। এর মধ্যেই নতুন করে রোহিঙ্গাদের আগমন পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। প্রথম এবং সবচেয়ে তাৎক্ষণিক ঝুঁকি হলো অর্থনৈতিক চাপ, যেটা বাংলাদেশের ওপর বাড়বে। এছাড়া বেঁচে থাকার তাগিদে রোহিঙ্গারা অনির্ধারিত কাজের দিকে ঝুঁকবে, শিবিরের বাইরে ছড়িয়ে পড়বে। অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা বাড়বে। চোরাচালান ও মাদক পাচারে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আরো বড় উদ্বেগ হলো উগ্রপন্থার ঝুঁকি। সহায়তা কমে গেলে এবং হতাশা বাড়লে রোহিঙ্গা তরুণদের একটি অংশ উগ্র বা সহিংস গোষ্ঠীর প্রতি আরো বেশি আকৃষ্ট হয়ে উঠতে পারে।’

চলতি বছর প্রয়োজনীয় তহবিলের ৫০ শতাংশ কমে যাওয়ার ফলে এরই মধ্যে অনেক খাতে সেবা অর্ধেকে নেমে এসেছে। অনেকগুলো স্বাস্থ্য কেন্দ্র বন্ধ অথবা সীমিত সেবা দিতে বাধ্য হয়েছে। প্রসূতিসেবা, অপারেশন, শিশুর জরুরি চিকিৎসা—প্রতিটি ক্ষেত্রে সংকট চলছে। ক্যাম্প ১৫-এর ইউনিসেফ পুষ্টি কেন্দ্রে প্রতিদিন ৩০০ শিশুকে গুরুতর অপুষ্টির পরীক্ষা করতে হচ্ছে, আর গত বছর থেকে অপুষ্ট শিশুর সংখ্যা বেড়েছে ১১ শতাংশ। নবজাতকরা জন্ম নিচ্ছে এমন পরিবেশে যেখানে স্যালাইন, ভিটামিন এ, রেডি টু ইউস থেরাপিউটিক ফুড—সবকিছুরই সংকট।

শুধু শিশুরাই নয়, গর্ভবতী নারীদের অবস্থাও খারাপ। রেশন কমে যাওয়ায় অনেক পরিবারের নিয়মিত খাবার এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে। মায়েরা প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার পাচ্ছেন না, এমনকি নিরাপদ প্রসবের উপকরণও নেই। যার ফলে কম ওজন নিয়ে জন্মানো নবজাতকের সংখ্যা বাড়ছে। অনেক শিশু জন্মের প্রথম সপ্তাহ থেকেই গুরুতর পুষ্টিহীনতার ঝুঁকিতে পড়ছে।

শুধু খাদ্য বা স্বাস্থ্য নয়—আশ্রয় শিবিরের প্রতিদিনের জীবনচক্রও সংকটে। নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের অভাব দেখা দিয়েছে। অনেক জায়গায় সাবান ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ন্যূনতম উপকরণ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ত্রিপল–ও বাঁশের অস্থায়ী ঘরগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, ঘূর্ণিঝড় বা বৃষ্টিতে সেগুলো ভেঙে পড়ার আশঙ্কা আছে। শিক্ষা খাতেও কাটছাঁট হওয়ায় কমিউনিটিভিত্তিক শেখার সুযোগ কমছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, তহবিল না বাড়লে সামনে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। যার প্রভাব শুধু রোহিঙ্গাদের ওপর নয়—কক্সবাজার অঞ্চল ও স্থানীয় অর্থনীতির ওপরও পড়বে।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।

মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে শরণার্থীদের নিয়ে প্রায় আট বছর ধরে কাজ করছেন সাংবাদিক তানভিরুল মিরাজ রিপন। তিনি বলেন, ‘শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টিসহ সবখানেই সহায়তা প্রায় বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। এর তাৎক্ষণিক ফল হয়তো দেখা যাবে না, কিন্তু পরে এটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নেবে। শিক্ষা বন্ধ হয়ে গেলে শুধু শেখার ঘাটতি নয়, দক্ষতার সামগ্রিক গুণগত মানেও বড় ধরনের বৈষম্য তৈরি হবে। তখন শিবিরের তরুণদের সঙ্গে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে।’

তিনি আরো বলেন, ‘২০১৭ সালে পাঁচ-ছয় বছর বয়সী যে শিশুরা এসেছিল, তারা এখন কিশোর বা তরুণ। কোনো দক্ষতা অর্জনের সুযোগ না পাওয়ায় তারা বড় সংখ্যায় বেকার হয়ে উঠছে। যেসব চরমপন্থী গ্রুপ সক্রিয় আছে তারাই আবার নতুন করে সুযোগ খুঁজবে পরিস্থিতির ফায়দা নিতে। রোহিঙ্গাদের দক্ষ করে তোলার জন্য যে সীমিত কিছু ট্রেনিং ছিল, তা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তারা কোনো স্কিলড হিউম্যান রিসোর্সে পরিণত হতে পারছে না। বিপরীতে মাদক বাণিজ্যকারীরা এ জনগোষ্ঠীকে খুব সহজে টার্গেট করতে পারবে। তাই সহায়তা নেমে গেলে সামাজিক প্রভাব হবে ভয়াবহ।’

মানবিক সহায়তার নিম্নমুখিতা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা উদ্বেগ জানিয়ে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় দাতারা এরই মধ্যে সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে সহায়তা তুলনামূলকভাবে আরো কমে আসবে। তখন ২০১৭ সালের আগের মতো সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা থাকবে। বিশ্ব ধীরে ধীরে রোহিঙ্গা ইস্যু ভুলে যাবে—এটাই সবচেয়ে বড় ভয়। এতে শুধু আশ্রয় শিবিরের রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগই বাড়বে না, বরং তাদের ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও বাড়বে।

– বণিক বার্তা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *