চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরে নৌ-বাণিজ্যে নতুন আশা, আখাউড়া-আগরতলা স্থলবন্দর দিয়ে ট্রানজিট পণ্যবাহী প্রথম জাহাজ যাচ্ছে ভারতে
![]()
নিউজ ডেস্ক
নানা আলোচনা-সমালোচনা শেষে ভারতকে দেয়া ট্রানজিট নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরে নৌ-বাণিজ্যে নতুন আশা। ভারত থেকে পরীক্ষামূলকভাবে গত ২১শে জুলাই ট্রানজিট পণ্য নিয়ে প্রথমবারের মতো ‘এমভি সেঁজুতি’ নামের একটি জাহাজ নোঙর করে চট্টগ্রাম বন্দরে। রড ও ডাল বোঝাই কনটেইনারগুলো দেশের সড়কপথ দিয়ে আখাউড়া-আগরতলা স্থলবন্দর হয়ে চলে যাবে ভারতের ত্রিপুরা ও আসামে। এতে করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যে পণ্য পরিবহন ব্যয় কমবে অর্ধেকের বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সাত ধরনের মাশুলের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি কনটেইনার থেকে ইলেকট্রিক সিলের মাশুল ছাড়া আয় করবে গড়ে ৪৮ থেকে ৫৫ ডলার (বাংলাদেশের মুদ্রায় চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা)। এর বাইরেও মাশুল পাবে বন্দর ও সড়ক বিভাগ।
২০১৮ সালের অক্টোবরে ভারতের দিল্লিতে উভয় দেশের সচিব পর্যায়ে এ ব্যাপারে চুক্তি হয়। ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ সংক্রান্ত এসপিও বা পরিচালন পদ্ধতির প্রক্রিয়ায় সই করেন। এই সইয়ের দেড় বছর পর পরীক্ষামূলকভাবে এখন শুরু হয়েছে পণ্য পরিবহন।
ট্রানজিট কিংবা ট্রানশিপমেন্টের পণ্য পরিবহনের জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। তবে সড়ক ও রেলপথে এখনও তৈরি হয়নি বাড়তি কোনো অবকাঠামো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের এই পণ্য পরিবহন অর্থনীতির জন্য সুখবর। তবে ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে চট্টগ্রাম বন্দর ও সড়কপথের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। তারা মনে করছেন, আরও মাশুল বাড়ানোর সুযোগও রয়েছে বাংলাদেশের। এ প্রসঙ্গে একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্টে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হচ্ছে, কোন খাতে কী পরিমাণ মাশুল উসুল করতে পারছি, সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে বেশি। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সবাই লাভবান হতে চাই। সামনে অনেক চুক্তিও আসবে। কিন্তু নিজেদের স্বার্থ বুঝতে হবে দ্ব্যর্থহীনভাবে।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার মোয়াজ্জেম হোসাইন বলেন, ‘দুই দেশের এমন ট্রানজিটকে স্বাগত জানাই আমি। তবে চট্টগ্রাম বন্দরে এখন স্ক্যানার আছে চাহিদার অর্ধেক। আবার সড়কপথেও টেকসই অবকাঠামো নেই। সড়কপথে পণ্যের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে গেলে দক্ষ পুলিশের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। ‘
যেভাবে যাবে ট্রানজিট পণ্য: ভারতের কলকাতা বন্দর থেকে মোট ২২১টি কনটেইনার পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসছে ‘এমভি সেঁজুতি’ জাহাজ। এর মধ্যে ট্রানজিট পণ্য চার কনটেইনার। এগুলো বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যাবে ভারতের আসাম ও ত্রিপুরায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে ভারতীয় হাইকমিশন জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরে নামার পর ট্রানজিট পণ্যগুলো প্রাইম মুভার ট্রেইলারে করে যাবে ভারতের আগরতলায় এসএম করপোরেশনের কাছে। সেখানে খালাসের পর রডের চালান যাবে পশ্চিম ত্রিপুরার জিরানিয়ায়। অন্যদিকে ডালের চালান আগরতলায় খালাস করে ভারতীয় ট্রাকে করে নেওয়া হবে আসামের করিমগঞ্জে জেইন ট্রেডার্সের কাছে। এমভি সেঁজুতি জাহাজের স্থানীয় এজেন্ট ম্যাঙ্গো লাইন লিমিটেড।
কী পাচ্ছে বাংলাদেশ: ট্রানজিট পণ্য পরিবহন বাবদ বিভিন্ন মাশুলের কথা উল্লেখ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনে গত ৫ জুলাই একটি চিঠি পাঠানো হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, প্রথম পরীক্ষামূলক চালানে ধার্যকৃত কোনো ফি নেবে না সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। তবে পরবর্তী প্রতিটি চালানে বন্দর, কাস্টম ও সড়ক বিভাগকে বিভিন্ন ধাপে আলাদা ফি দিতে হবে। ভারতীয় পণ্য পরিবহনের সময় সাত ধরনের ফি আদায় করবে বাংলাদেুশের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে প্রতি চালানে প্রসেসিং ফি ৩০ টাকা, প্রতি টনের জন্য ট্রানশিপমেন্ট ফি ৩০ টাকা, নিরাপত্তা মাশুল ১০০ টাকা, এসকর্ট মাশুল ৫০ টাকা, প্রশাসনিক মাশুল ১০০ টাকা, প্রতি কনটেইনারের স্ক্যানিং ফি ২৫৪ টাকা। সঙ্গে প্রযোজ্য হারে দিতে হবে ইলেকট্রিক সিলের মাশুল। ইলেকট্রিক সিল ছাড়া এর পরিমাণ ৪৮ থেকে ৫৫ ডলার। এর বাইরে বন্দর কর্তৃপক্ষ পাবে পণ্য ওঠা-নামার মাশুল, রিভার ফি ও পোর্ট ডিউটি। সড়ক বিভাগ আলাদাভাবে আদায় করবে সরকার নির্ধারিত টোল ও মাশুল। সব মিলিয়ে ২০ ফুট দীর্ঘ একটি কনটেইনার থেকে বাংলাদেশ কত টাকা আয় করবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (পরিবহন) এনামুল করিম বলেন, ট্রানজিট পণ্যের জন্য বিশেষ কোনো মাসুল নেই। অন্যান্য পণ্যের মতোই এসব পণ্যের মাসুল আদায় করব আমরা।
কেন ট্রানজিট প্রয়োজন ভারতের: অবস্থানগত সুবিধার কারণেই চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে চায় ভারত। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব এক হাজার ৬৮০ কিলোমিটার। অথচ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আগরতলার দূরত্ব মাত্র ২৪৮ কিলোমিটার। মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব এক হাজার ১৫০ কিলোমিটার হলেও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এ দূরত্ব মাত্র ৫৭০ কিলোমিটার। মিজোরামের রাজধানী আইজলের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ৬৫৫ কিলোমিটার হলেও কলকাতার দূরত্ব এক হাজার ৫৫০ কিলোমিটার। নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমারের সঙ্গে বন্দরের দূরত্ব ৮৮০ কিলোমিটার হলেও কলকাতার দূরত্ব এক হাজার ৪৫০ কিলোমিটার।
কলকাতা থেকে অন্যান্য রাজ্যের দূরত্বও চট্টগ্রামের তুলনায় গড়ে তিনগুণের বেশি। বর্তমানে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে কলকাতা বন্দর থেকে ফিডার জাহাজে করে পণ্য পরিবহন করতে হয়। এতে ভারত সরকারের সময় ও অর্থ দুটোই বেশি যাচ্ছে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহন শুরু হওয়ায় এখন ভারতের খরচ কমে যাবে অর্ধেকেরও বেশি।
অপেক্ষা ঘুচল এক দশকের: বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহনের বিষয়টি গত এক দশক ধরে খুব জোরালো হয়ে ওঠে। ২০১০ সালে ভারত জোরালোভাবে প্রস্তাবনা তুলে ধরে বাংলাদেশের কাছে। ট্রানজিটের সমতা যাচাই করে দেখতে ২০১২ সালে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি বিশেষ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ।
ট্রানজিট কিংবা ট্রানশিপমেন্টের অর্থনৈতিক সুবিধা কাজে লাগাতে সড়ক, রেল ও নৌ পথের বিদ্যমান অবকাঠামো ও ভবিষ্যৎ প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করে কিছু সুপারিশ করে এ ওয়ার্কিং কমিটি। তখন তারা চট্টগ্রাম বন্দরের সর্ববৃহৎ ক্ষমতাসম্পন্ন নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পুরোদমে চালু করা, মোংলা বন্দরের তিনটি জেটি দ্রুত ব্যবহার উপযোগী করা, পর্যাপ্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন এবং মোংলা-খুলনা রেলপথ দ্রুত নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করে। তাদের এ সুপারিশের ভিত্তিতে গত ছয় বছরে দুই বন্দরে কিছু নতুন অবকাঠামো হয়েছে। তবে সড়ক ও রেলপথে আসেনি কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন। তারপরও ধাপে ধাপে এগোতে থাকে আলোচনা।