বনবিভাগের ডাকে সেনাবাহিনীর সাড়া: পাহাড়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে হেলিকপ্টার থেকে ছিটানো হলো বীজ
নিজস্ব প্রতিবেদক
সাঙ্গু-মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনাঞ্চল দেশের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বান্দরবান পার্বত্য জেলার থানচি ও আলীকদম উপজেলায় অবস্থিত। এটি ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্য হটস্পটের অংশ। ১৮৮০ সালে সাঙ্গু-মাতামুহুরী বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর আয়তন প্রায় ৭৪,০০০ হেক্টর। এটি পার্বত্য অঞ্চলের সর্বপ্রথম সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত বনাঞ্চল, যা দেশে একমাত্র কুমারী (ভার্জিন) বনাঞ্চল হিসেবেও পরিচিত। এই বনাঞ্চলের মধ্যে রয়েছে শঙ্খ বা সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর উৎপত্তিস্থল। সাঙ্গু সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে রয়েছে সাঙ্গু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। ২০১০ সালে সাঙ্গু ও মাতামুহুরী বনাঞ্চলের ২৩৩১.৯৮ হেক্টর এলাকা নিয়ে এই অভয়ারণ্য সৃষ্টি করা হয়, যা সরকার কর্তৃক ঘোষিত দেশের মোট ২৩টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের মধ্যে নবম বৃহত্তম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য।
সম্প্রতি, দেশের এই অন্যতম প্রাকৃতিক বনাঞ্চল পার্বত্য জেলা বান্দরবানের সাঙ্গু ও মাতামুহুরী রিজার্ভ সংরক্ষণে সেখানে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে বীজ ছিটানোর উদ্যোগ নেয় বন বিভাগ। সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সহায়তায় হেলিকপ্টারের মাধ্যমে বন বিভাগ এই দু’টি রিজার্ভ বনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের বীজ ছিটাবে। ব্রিটিশ আমলে সর্বপ্রথম রিজার্ভ ফরেস্টে বীজ ছিটানোর কথা শোনা গিয়েছে।
সূত্র জানায়, বৃহৎ এই বনাঞ্চলে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে বীজ ছিটানোর জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সহায়তা চায় বান্দরবানের লামা বনবিভাগ, আর এতে সাড়াও দেয় সেনা ও বিমানবাহিনী।
এরই ধারাবাহিকতায়, আজ বেলা ১১টায় সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সহযোগিতায় হেলিকপ্টারে করে সীডবল ছিটানো হয়েছে মাতামুহুরী ও সাঙ্গু সংরক্ষিত বনাঞ্চলে। চাম্পাফুল, পুতিজাম, ঢাকিজাম, কালোজাম, গামার, কড়ই, জারুল, হারগাজা ইত্যাদি প্রজাতির বীজ ছিটানো হয়। এই প্রথমবারের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামে হেলিকপ্টারের সাহায্যে সীডবল নিক্ষেপের মাধ্যমে বনায়ন করলো লামা বন বিভাগ। যা মুজিব শতবর্ষ ও সুবর্ণ জয়ন্তীর উপহার হিসেবে কালের স্বাক্ষী হয়ে থাকবে।
সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের আওতাধীন বান্দরবান রিজিয়ন কমান্ডর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জিয়াউল হক আজ মঙ্গলবার (৩১ আগষ্ট) সকালে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।
এ সময় তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জীব-বৈচিত্র্য দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্র্যের অনেক প্রজাতি ইতোমধ্যে আমাদের পরিবেশ থেকে হারিয়ে গেছে। বহু উদ্ভিদ ও প্রাণী বিরল তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে বৃক্ষ ও বনাঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব হ্রাস, জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং সর্বোপরি দেশের উন্নয়নের মূলধারা অব্যাহত রাখতে হলে ব্যাপকহারে বনায়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরী। একই সাথে জনসাধারণকে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন করা এবং বনাঞ্চল সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করা একান্ত অপরিহার্য।
তিনি আরও বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযােগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি আত্মনির্ভরশীল, উন্নত ও টেকসই, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সােনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তারই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমগ্র বাংলাদেশে টেকসই পরিবেশ উন্নয়নের অংশ হিসেবে সবুজায়ন ও বনায়ন কর্মসূচীর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে এবং তা বাস্তাবায়ন করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলি আমাদের দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য একান্ত অপরিহার্য। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মােকাবেলা, পরিবেশ রক্ষা ও একটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এই ধরনের বনায়ন কর্মসূচীর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আজকের এই বনায়ন কর্মসূচীতে ৪৮০ কেজি বিরল ও বিলুপ্ত প্রজাতির বীজ ছিটানাে হয়েছে, যা জীব-বৈচিত্র সংরক্ষণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। তবে শুধুমাত্র সরকারি পর্যায়ে নয় ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও বেশি বেশি করে গাছ লাগানাের জন্য তিনি সবাইকে আহবান জানান।
লামা বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এস এম কায়সার জানিয়ছেন, হেলিকপ্টারের মাধ্যমে উপর থেকে বীজ ছিটানাে হলে এতে বীজের অঙ্কুরােদগম কেমন হবে তা একটি পরীক্ষার বিষয়। অধিকাংশ বীজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তবে কিছু পরিমাণ বীজও যদি অঙ্কুরােদগম হয় তাও বনাঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য সহায়ক হবে।
এসময় চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোহাম্মেদ আব্দুল আউয়াল সরকার, বান্দরবান বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ ফরিদ মিঞা, লামা বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এস. এম. কায়চার সহ সেনাবাহিনী ,বনবিভাগ ও সরকারী বিভিন্ন উর্ধতন কর্মকর্তার উপস্থিত ছিলেন।
আয়োজকের জানান, বিট্রিশ আমলের পর এই প্রথম রির্জাভ বন এলাকা রক্ষায় এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রিজাভ বনের যেসব এলাকায় গাছের সংখ্যা কম এসব এলাকাতেই হেলিকপ্টার থেকে বীজ ছিটানো হয়েছে বলে বন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
জানা যায়, সাঙ্গু ও মাতামুহুরী রিজার্ভের যেসব এলাকায় গাছের সংখ্যা কম সেসব এলাকায় বিভিন্ন প্রজাতির গাছের বীজ ছিটানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর আগে এই উদ্যোগের বিষয়টি মন্ত্রণালয়সহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছিল। বর্তমানে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর সহায়তায় বান্দরবান ও লামা বন বিভাগের নিজস্ব উদ্যোগে এ কাজটি করা হচ্ছে। বিভিন্ন প্রজাতির গাছের বীজের মধ্যে চাপালিশ, গর্জন, চম্পাসহ দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষ থাকবে। এ প্রজাতির অনেক বৃক্ষ এখন রিজার্ভ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মূলত রিজার্ভ রক্ষার জন্য বন বিভাগ এই উদ্যোগ নিয়েছে। এটি সফল হলে পরবর্তী সময়ে আরো বড় পরিসরে এ ধরনের কার্যক্রম চালানো হবে।
এছাড়া আলীকদম উপজেলার আলীকদম-পোয়ামুহুরী সড়কে লামা বন বিভাগ ও বিএটিবি’র বনায়ন প্রকল্পের আওতায় বিস্তীর্ণ সাঙ্গু রির্জাভ এলাকায় ফলজ, বনজ ও সৌন্দর্য্য বর্ধনকারী বিভিন্ন প্রজাতির চারা রোপন করা হবে। বিএটিবি’র বনায়ন প্রকল্পের আওতায় সড়ক সৌন্দর্য্য বর্ধনে লামা বন বিভাগকে ৫৫ হাজার চারা দেয়া হয়।
উল্লেখ্য পরিবেশ বিপর্যয়, চোরাকারবারির উৎপাত, অপরিকল্পিত জুম চাষ সহ নানা কারণে প্রাকৃতিক এই রিজাভ ফরেস্ট এখন অনেকটাই উজার হতে বসেছে।