এলডিসি-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চীন, ভারতের সঙ্গে এফটিএ চুক্তির চিন্তা করছে সরকার - Southeast Asia Journal

এলডিসি-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চীন, ভারতের সঙ্গে এফটিএ চুক্তির চিন্তা করছে সরকার

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

স্বল্প আয়ের দেশের কাতার থেকে মধ্য আয়ের দেশে উত্তরণ পরবর্তীকালের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বৈদেশিক বাণিজ্যের দুই প্রধান অংশীদার চীন ও ভারতের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি- (এফটিএ) করার বিষয়টি বিবেচনা করছে সরকার।

চীন ইতিমধ্যে এফটিএ করার বিষয়ে বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছে। অন্যদিকে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে এফটিএর আদলে কম্প্রিহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (সেপা) করার বিষয়টি পর্যালোচনা করছে সরকার। এ লক্ষ্যে গবেষণা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট (বিএফটিআই)।

তবে ভারত ও চীনের সঙ্গে বাণিজ্যে বিপুল অসাম্য থাকায়, তাদের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার ফলে সরকার বিপুল রাজস্ব আয় হারাবে এবং এ দুই দেশের পণ্য বিনা শুল্কে প্রবেশাধিকার পেলে তা স্থানীয় উৎপাদকদের অসম প্রতিযোগিতায় ক্ষতির সম্মুখীন করবে, এসব বিষয়ও সরকারকে ভাবতে হচ্ছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানিকৃত পণ্য থেকে শুল্ককর বাবদ আদায় হয়েছে ৭৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। আদায়কৃত রাজস্বের বড় অংশই এসেছে চীন ও ভারত থেকে আমদানি করা পণ্য থেকে। ফলে বাংলাদেশ এফটিএ শুরু করলে বিপুল পরিমাণ রাজস্বও হারাতে হবে।

এসব বিষয় চিন্তা করে, অর্থনীতিবিদদের একাংশ এই বিবেচনায় যেসব দেশে বাংলাদেশের আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেশি, তাদের সঙ্গে প্রথমদিকে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার পরামর্শ দিচ্ছেন।

তবে তা সত্বেও দীর্ঘমেয়াদে রপ্তানি বাজারের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখার জন্য মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতেই সমাধান দেখছে সরকার।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বাংলাদেশ যাদের সঙ্গে এফটিএ চুক্তি করতে পারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এমন কিছু দেশ ও বাণিজ্য জোটের একটি তালিকা তৈরি করেছে। নিজস্ব বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন দপ্তরের মতামতের ভিত্তিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত একটি তালিকা তৈরি করেছে।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ ও তা মোকাবেলায় প্রস্তুতি গ্রহণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গঠিত বিভিন্ন সাব-কমিটির একটি হলো; সাব-কমিটি অন প্রিফারেন্সিয়াল মার্কেট অ্যাক্সেস অ্যান্ড ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা অগ্রাধিকারমূলক বাজারে প্রবেশ ও বাণিজ্য চুক্তি বিষয়ক উপ-কমিটি।

গত ৯ সেপ্টেম্বর ওই কমিটির সভায় আলোচ্য এফটিএ’র ওই তালিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এতে চীন ও ভারত ছাড়াও রয়েছে নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, আসিয়ান জোট, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরেশিয়ান ইকনোমিক ইউনিয়ন, দক্ষিণ আমেরিকার একটি বাণিজ্য সংঘ- মার্কাসুর।

এছাড়া বাণিজ্য সহযোগিতা সংক্রান্ত প্রটোকল স্বাক্ষরে বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া, যা বর্তমানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পর্যালোচনা করছে।

এব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিওটিও সেলের মহাপরিচাক মো. হাফিজুর রহমান বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী মার্কেট অ্যাক্সেস ধরে রাখার স্বার্থে আমাদের ধীরে ধীরে এফটিএতে যেতে হবে। এর অংশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে সেপা ও চীনের সঙ্গে এফটিএ কীভাবে করা যায়, কিংবা করা যায় কিনা- তা নিয়ে স্টাডি করা হচ্ছে। স্টাডি শেষে বোঝা যাবে, কোনটায় আমাদের সুবিধা হবে।

ভবিষ্যৎ বাজার সুবিধা নিশ্চিতে এফটিএ’তে জোরদান:
ইউরোপসহ যেসব দেশে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পায়, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর তা আর থাকবে না। ইউরোপের বাজারে জিএসপি প্লাসের আওতায় শুল্ক সুবিধা পেতে হলে ২৭টি আন্তর্জাতিক কনভেনশন মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। ফলে ওই সুবিধাও তখন পাওয়া যাবে কিনা- তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

এ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এফটিএ করার তাগিদ বাড়ছে সরকারের মধ্যে। ব্যবসায়ীরাও দীর্ঘদিন ধরেই এ দাবি জানিয়ে আসছেন, আর অর্থনীতিবিদরাও এফটিএ করার বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে আসছেন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সুত্র জানিয়েছে, এফটিএর পাশাপাশি অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা যাতে আরো বেশি সময় পর্যন্ত পাওয়া যায়, সে প্রচেষ্টাও অব্যাহত রাখা হয়েছে। এ লক্ষ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) গাইডলাইন অনুযায়ী, শ্রম আইন সংশোধনের প্রক্রিয়াও চালাচ্ছে শ্রম মন্ত্রণালয়। ৯ সেপ্টেম্বর সাব-কমিটির ওই সভায় এ ইস্যুটিও আলোচনায় আসে।

নীতি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা:
স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে বিশেষ কিছু পণ্যে আমদানি শুল্কের পাশাপাশি সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি, রেগুলেটরি ডিউটি এবং অন্যান্য নামে শুল্ককর আদায় করে থাকে। যদিও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিওটিও) নীতিমালা অনুযায়ী, ধীরে ধীরে ট্যারিফ রেট কমিয়ে আনার তাগিদ রয়েছে।

কিন্তু, গত কয়েক বছরে এতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়নি। ফলে হঠাৎ করেই চীন ও ভারতের মতো দেশের সঙ্গে এফটিএ হলে রাজস্ব হারানোর ধাক্কা, কীভাবে সামাল দেবে এনবিআর, তারও সুনির্দিষ্ট কোন কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদে আমাদের এফটিএতে যেতেই হবে। এজন্য প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। হঠাৎ করে রাজস্ব কমে যাওয়ার ঝাঁকুনি যাতে না লাগে, এজন্য ২০২৬ সালের মধ্যে ধীরে ধীরে শুল্ক হার কমিয়ে আনতে হবে। যে রাজস্ব লস হবে তা, আয়কর ও ভ্যাট আদায় বাড়ানোর মাধ্যমে পূরণ করতে হবে।’

এদিকে অর্থনীতিবিদরা এফটিএ স্বাক্ষরের আগে নীতি সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করছেন।

আন্তর্জাতিক বানিজ্য বিশ্লেষক ড. মোস্তফা আবিদ খান বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, উন্নয়নশীল দেশ হলে, একপাক্ষিক সুবিধা আমরা পাবো না। তখন আমরা কারো কাছে কিছু পেতে গেলে, তাকেও ছাড় দিতে হবে। কিন্তু, সার্বিকভাবে এফটিএ করার জন্য যে ধরনের বানিজ্য বা বিনিয়োগ সহায়ক নীতি দরকার, তা এখনো হয়নি। আমাদের রপ্তানি ঝুড়িতে কয়টি পণ্য আছে? ফলে হুট করেই এফটিএ হলে সুবিধাজনক হবে কিনা, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

একই মত দিয়েছেন দিয়েছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির এর সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) এর চেয়ারম্যান আবুল কাশেম খান। তিনি টিবিএস’কে বলেন, এফটিএ করার জন্য আমাদের বিদ্যমান নীতিমালা সংস্কার করা দরকার। এফটিএ হলে পলিসির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে রপ্তানি করেছে ৩৮.৭৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ। একই সময়ে আমদানি করে ৬৫.৫৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যার প্রবৃদ্ধি ছিলো ১৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

বাংলাদেশ ২০১৯-২০ অর্থবছরে চীনের বাজারে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানির বিপরীতে আমদানি করেছে ১১.৫৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য।

আর একই সময়ে ভারতের বাজারে ১২৬ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানির বিপরীতে আমদানি করেছে ৮২০ কোটি ডলারের পণ্য।