পার্বত্য শান্তিচুক্তির দুই যুগ: পাহাড়ে থেমে নেই অস্ত্রের ঝনঝনানি
মনির হোসেন, বান্দরবান থেকে ফিরে
পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৪ বছর পূর্তি হচ্ছে কাল। ইতোমধ্যে চুক্তির ৭২টি ধারার ৪৮টিই পূর্ণাঙ্গ এবং ১৫টির আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। ৯টি ধারা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষার হার বৃদ্ধিসহ পাহাড়িদের জীবনযাত্রার মানে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু শান্তিবাহিনীর আদলে সশস্ত্র ৪টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে।
এগুলো হলো- জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), জেএসএস সংস্কার, ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)।
প্রতিনিয়ত খুন, ধর্ষণ, অপহরণ ও চাঁদাবাজির মতো অপরাধ করে চলেছে এসব গ্রুপ। সর্বশেষ মঙ্গলবারও রাঙ্গামাটিতে এক জেএসএস সদস্যকে গুলি করে হত্যা করেছে অপরপক্ষ। ২০১৩ সালের পর সরকারি দল আওয়ামী লীগের ৫ নেতাকে হত্যা করা হয়। চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৭১টিই সরকারের বাস্তবায়নের কথা।
পাহাড়িদের বাস্তবায়নের কথা শুধু একটি। আর তা হলো, তারা অস্ত্র জমা দেবেন। কিন্তু তারা একটি কাজই করেননি। এখনো বাংলাদেশ ভেঙে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার কথা তারা প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছেন। পাহাড়িদের অভিযোগ, দীর্ঘ প্রায় ২৪ বছর হলেও চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ বাস্তবায়ন না করে তাদের ঠকানো হয়েছে।
জানা গেছে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ এক দশমাংশ ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। তিন জেলার মোট আয়তন ৫ হাজার ৫০০ বর্গমাইল। কিন্তু জনসংখ্যা মাত্র ১৬ লাখ। অর্থাৎ আয়তন দেশের মোট আয়তনের ১০ শতাংশ কিন্তু জনসংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ। এরমধ্যে ৮ লাখ বাঙালি আর বাকি ৮ লাখ ১৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ের অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে পাহাড়ের সব উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যন্ত। শান্তিচুক্তির আগে রাস্তা ছিল ২ হাজার ৮০৩ কিলোমিটার। বর্তমানে তা ৭ হাজার ৯৪৯ কিলোমিটার। হাসপাতাল ক্লিনিকের সংখ্যা ছিল ২৪টি। বর্তমানে তা ২৭০টিতে উন্নীত হয়েছে। কলকারখানা ছিল ১৩৫টি। বতর্মানে উন্নীত হয়েছে ২২৩টিতে। রাস্তা, অসংখ্য ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়নে একটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। হাইস্কুল ও কলেজের সংখ্যা ১১টি থেকে প্রায় ৫শয়ে উন্নীত হয়েছে। প্রতিটি পাড়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। শিক্ষার হার দুই থেকে বেড়ে বর্তমানে প্রায় ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে। এর মধ্যে চাকমা জনগোষ্ঠীর শিক্ষার হার ৭৫ ভাগ।
জানা গেছে, স্বাধীনতার পর পাহাড়িদের সংগঠন শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রামে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে দেশের পার্বত্য অঞ্চলের অপার সম্ভাবনাময় তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। শান্তিচুক্তির আগে ২৪ বছরে শান্তিবাহিনীর হাতে নিরাপত্তা বাহিনীর ৩৪৩ জন মারা যান। এছাড়া এ সময় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ২৩৮ জন এবং এক হাজার ৫৫ জন বাঙালিকে হত্যা করেছে শান্তিবাহিনী। এ সময় বিভিন্ন সংঘর্ষে নৃগোষ্ঠীর ১৮১ জন এবং ৬৮৭ জন বাঙালি আহত হয়েছে। একই সময় অপহরণ করা হয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ২৭৪ জন এবং ৪৬৪ বাঙালিকে। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনী ১৬শর বেশি অস্ত্র, সাড়ে ৩শর বেশি গ্রেনেড, ৭০টি মর্টার, ১৫টি মাইন এবং সাড়ে ৪ লাখের বেশি গোলাবারুদ উদ্ধার করে। ২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সরকারি দলের ৫ নেতাকে হত্যা করেছে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)।
পাহাড়ে রক্তাক্ত পরিস্থিতির অবসানে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জেএসএসের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের উপস্থিতিতে সরকারের পক্ষে চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং জেএসএসের পক্ষে সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) চুক্তিতে সই করেন। শান্তিচুক্তিতে বলা হয়, পাহাড়িরা অস্ত্র সমর্পণ করবে, সন্ত্রাস ও অপরাধ বন্ধ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। চুক্তিতে পাহাড়িদের আদিবাসী নয়, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
চুক্তি অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শান্তিবাহিনীর ৭৩৯ সদস্যের প্রথম দলটি সন্তু লারমার নেতৃত্বে শেখ হাসিনার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে। একই বছর ১৬ ও ২২ ফেব্রুয়ারি চার দফায় শান্তিবাহিনীর মোট ১ হাজার ৯৪৭ সদস্য অস্ত্র সমর্পণ করেন। এছাড়া ছয় দফায় ১২ হাজার ৩২২ পরিবারের ৬৩ হাজার ৬৪ শরণার্থী দেশে ফিরে আসেন। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ৬ মে স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন সংশোধন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন সংসদে পাশ হয়।
ওই বছর ১৫ জুলাই গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে খাগড়াছড়ির তৎকালীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য কল্প রঞ্জন চাকমাকে প্রথম পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে পাহাড়ে ভিন্ন চিত্র। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৪টি আঞ্চলিক দল শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সহযোগিতা না করে আবার গড়ে তুলেছে সশস্ত্র সংগঠন। প্রকৃতপক্ষে সরকার আন্তরিক থাকলেও আঞ্চলিক এ রাজনৈতিক দলগুলোর বিরূপ মনোভাব, বিশেষত ভূমি ইস্যু ও তাদের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি, সশস্ত্র গ্রুপ পরিচালনা, আইনশৃঙ্খলার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন এবং সরকারি যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধা দিয়ে শান্তিচুক্তির অবশিষ্ট প্রক্রিয়াধীন বিষয়গুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি করছে।
চুক্তির পর এ পর্যন্ত ২৪ বছরে পাহাড়িদের ৪ সংগঠন আক্রমণ চালিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ১৬ সদস্য, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৪৮০ জন এবং ১৯০ জন বাঙালি হত্যা করেছে। এ সময় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৬৬০ জন এবং ৬৫০ জন বাঙালি আহত হয়েছেন। অপহরণ করা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৯১০ জন এবং ৩৮৪ জন বাঙালি। এছাড়া ২০০৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৩ হাজারের বেশি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় প্রায় আড়াই লাখ গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে নিরাপত্তা বাহিনী।
১৯৯৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সরকার সন্তু লারমাকে চেয়ারম্যান করে ২২ সদস্যের পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করে। ১৯৯৯ সালের ১২ মে এ পরিষদের কার্যক্রম শুরু হয়। সরকার বলছে, শান্তিচুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিবরণী থেকে জানা গেছে, চুক্তির মোট ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টির পূর্ণ বাস্তবায়ন, ১৫টির আংশিক বাস্তবায়ন এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া তিন পার্বত্য জেলায় হস্তান্তরযোগ্য পৃথকভাবে ৩৩টি দপ্তরের মধ্যে এ পর্যন্ত রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদে ৩০টি, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে ৩০টি এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে ২৮টি দপ্তর হস্তান্তর করা হয়েছে।