একটি সফল সেনা অভিযান ও সাধারণ পাহাড়ীদের জিম্মি করে অপপ্রচার! - Southeast Asia Journal

একটি সফল সেনা অভিযান ও সাধারণ পাহাড়ীদের জিম্মি করে অপপ্রচার!

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

মো. সাইফুল ইসলাম

পাহাড়ে সক্রিয় চারটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন। পাহাড়ি ভূমি দখল, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, অস্ত্র ব্যবসা, অপহরণ বাণিজ্য এবং এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে জড়িত এসব সন্ত্রাসী সংগঠন।বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের খবরে জানা যায়, বছরে প্রায় ৪শ’ কোটি টাকা চাঁদা তোলে তারা। চাঁদার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে প্রায়ই সংঘাতের সৃষ্টি হয়। প্রাণ হারায় সাধারণ মানুষ। নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে প্রতিদিনই সম্প্রসারিত হচ্ছে সংগঠনগুলো। এদের মূল উদ্দেশ্য হলো পাহাড়কে অস্থিতিশীল রাখা। এতে শান্তিপ্রিয় পাহাড়িরা ভয়ানক আতঙ্ক ও উদ্বেগ-উৎকন্ঠার মধ্যে রয়েছেন।

এই চার সংগঠনের অন্যতম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। এই সংগঠন ভেঙে জেএসএস-সংস্কার নামের আরেকটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। অন্যদিকে শান্তিচুক্তি বিরোধী দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক দল (ইউপিডিএফ)। ইউপিডিএফও দ্বিখণ্ডিত হয়। এই দলগুলোই সক্রিয়ভাবে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে।

এসব সংগঠনের সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজি, অপহরণ করে অর্থ আদায়, পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে শান্তি বিনষ্টসহ নানা ধরনের অপকর্মে লিপ্ত। এছাড়া ধর্মের নামেও নানা অপকর্ম করছে। দেশে-বিদেশে নানা ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। বছরের পর বছর এসব চাঁদাবাজ ক্যাডারদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে পাহাড়ের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। স্থানীয় হাটে-বাজারে সামান্য কলা বিক্রি করতে গেলেও এসব সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতাদের চাঁদা দিতে হয়। সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করলে সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর উপর দোষ চাপায়। এমনকি তারা সেনাবাহিনীর পোশাক পরেও অপকর্ম চালায়। চার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হয়ে কথিত এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীও নানা অপপ্রচারে লিপ্ত।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেনাবাহিনীর কারণে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো মাথাচাড়া দিতে পারে না। নিজেদের ইচ্ছেমতো অপরাধের রাজত্ব কায়েম করতে পারে না। তাই তারা পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে কাজ করা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দিনরাত নানা অপপ্রচার করেই চলছে। যেখানে সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কাজ করে, সেখানে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে সন্ত্রাসীরা অপকর্ম করে সেনাবাহিনীর উপরই দোষ চাপায়। অথচ সেনাবাহিনী থাকার কারণে পাহাড়ে সকল ধর্মের মানুষ সহাবস্থান করতে পারছে।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, শান্তিরক্ষা মিশনে শান্তি, শৃঙ্খলা বজায় ও আর্ত-মানবতার সেবায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদান সবচেয়ে বেশি। অথচ ধর্মের নামে নানা স্পর্শকাতর ষড়যন্ত্র করে সেনাবাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন করতে প্রতিনিয়ত নানা অপপ্রচারে লিপ্ত এসব সন্ত্রাসীরা। এজন্য তারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিদিনই নতুন নতুন অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চলের যেসব এলাকা থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ক্যাম্প প্রত্যাহার করেছে, সেসব এলাকায় কিয়াংঘর তৈরি করে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো জায়গা দখল করছে। একপর্যায়ে সেই কিয়াংঘর পুড়িয়ে ফেলে সেনাবাহিনীর নামে অপপ্রচার চালায়। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতেও এরা আশ্রয় নেয় নতুন নতুন অপপ্রচারের।

এবার খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দীঘিনালায় সেনাবাহিনীর একটি সফল অভিযান নিয়েও অপপ্রচারে মেতেছে প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন পাহাড়ের চুক্তিবিরোধী আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন ইউপিডিএফ।

বিভিন্ন গণমাধ্যম জানায়, “খাগড়াছড়ির জারুলছড়িতে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের গোপন আস্তানায় অভিযান চালিয়েছে সেনাবাহিনী। এসময় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। গত শুক্রবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।

এতে বলা হয়, ইউপিডিএফ (প্রসীত) দলের সন্ত্রাসীরা এই এলাকায় অস্থায়ী ঘাঁটি গড়ে তুলে। সেখানে তারা নতুনভাবে আধিপত্য বিস্তার এবং নতুন সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

স্থানীয় জনগণের মধ্যে নতুনভাবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা, চাঁদাবাজি, সাধারণ মানুষকে অহেতুক হয়রানি এবং মারধর করা ছাড়াও নানা অসামাজিক অপকর্ম চালিয়ে আসছে দলটি। এমন তথ্যের ভিত্তিতে গত শুক্রবার (৪ ফেব্রুয়ারি) ভোর ৫টায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে দিঘীনালা জোনের অপারেশন দল।

তবে নিরাপত্তাবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে তারা এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণ করতে থাকে। সেনাবাহিনীর অভিযান দল তাৎক্ষণিক পাল্টা আক্রমণের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করে। ফলে সন্ত্রাসী দলটি তাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে মজুদ করা সরঞ্জামাদি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দলিল দস্তাবেজ রেখেই পিছু হঠতে বাধ্য হয়।

ক্যাম্প হতে অভিযান দলটি সন্ত্রাসীদের ইউনিফর্মের অংশ বিশেষ, সন্ত্রাসীদের দলীয় নামীয় তালিকা, চাঁদা আদায় সংক্রান্ত নিয়মের নির্দেশিকা এবং ০২ (দুই)টি এলএমজির ওয়াই স্টিক উদ্ধার করে। অভিযান শেষে সেনা সদস্যরা সন্ত্রাসীদের চারটি ব্যারাক এবং দুটি ডিউটি পোস্ট ও অস্ত্রাগার ধ্বংস করেন।”

বিষয়টি সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। পাহাড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এটি সেনাবাহিনীর একটি সফল অভিযানও বটে।

কিন্তু, নির্বিঘ্নে চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা, ধর্ষণের মতো অপরাধ কর্মকান্ড রুখে দেয়ায় সেনাবাহিনীর প্রতি অপপ্রচার করতে এবারও পিছপা হয়নি প্রসীত বাবুর দল।

অপপ্রচারের অংশ হিসেবে, গত রবিবার (৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২) উল্টাছড়ি-ধনপাদা এলাকাবাসীর ব্যানারে একটি মানববন্ধন করে বাবুছড়ার ধনপাতা এলাকাবাসী।

ইউপিডিএফের অপপ্রচারের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত সিএইচটি নিউজ পোর্টালে এবিষয়ে একটি সংবাদও প্রকাশ করা হয়। সেখানে গত ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ দীঘিনালা উপজেলার বাবুছড়া ইউনিয়নের উল্টাছড়ি দজর পাড়ায় সেনাবাহিনী কর্তৃক ২ জনকে শারীরিক নির্যাতন ও গ্রামে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে আতঙ্ক সৃষ্টির অভিযোগ তোলা হয়।

এছাড়া, প্রকাশিত সংবাদে জনগণকে উদ্বৃত করে বলা হয়, গত ৪ ফেব্রুয়ারি ভোর বেলায় সেনাবাহিনী গ্রামে এসে অতর্কিত ব্রাশফায়ার করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। তারা গ্রামের বাসিন্দা রিপন চাকমা ও তার ছেলে কলেজ ছাত্র ডিজেন চাকমা (কালায়্যা)-কে অমানুষিক নির্যাতন করেছে। শুধু তাই নয়, সেনারা রিপন চাকমা ও তার পরিবারের ব্যবহৃত কাপড়-চোপড়, জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র পুড়িয়ে দেয় এবং তার ঘরে পালিত চারটি মুরগী বিনামূল্যে খেয়ে দিয়েছে।

তারা উক্ত ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, সেনাবাহিনী যেভাবে সাধারণ জনগণের ওপর অন্যায়-অবিচার চালাচ্ছে এ অবস্থায় আমরা এখন নিজের বাড়িতেও নিরাপদে থাকতে পারছি না। তাহলে আমরা কি নিজেদের বাড়িতেও শান্তিতে ঘুমাতে পারবো না? আমরা যাবো কোথায়? তাই আমরা অবিলম্বে জনগণের উপর এ ধরনের অন্যায়-অবিচার বন্ধের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই।

অথচ সেই তথাকথিত প্রতিবাদী মানবন্ধনে উপস্থিত বিচিত্রা চাকমা ও মনিবালা নামের দুইজন গৃহিনী জানান, মূলত সেদিনকার সেনাবাহিনী পরিচালিত জারুলছড়িতে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের গোপন আস্তানায় পরিচালিত অভিযানে খুশি এলাকার জনসাধারণ। উক্ত স্থানটি দখল করে সেখানে আস্তানা তৈরী করে দীর্ঘদিন যাবৎ ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা বাঙ্গালীদের পাশাপাশি স্থানীয় আশে-পাশের কয়েকটি গ্রামের পাহাড়ী জনসাধারণের উপরও অমানুষিক নির্যাতন ও চাঁদাবাজি করে আসছিলো। ভয়ে সেখানে কেউ মুখ খুলতে পারে নি। এছাড়া রবিবার সকালে স্থানীয় কয়েকটি বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মানববন্ধনে হাজির হবার জন্য জনগণকে নির্দেশ দেয় ইউপিডিএফ, অন্যথায় সরাসরি গুলি করে হত্যা করার হুমকি দেয়া হয়। ভয় পেয়ে অনেকে তথাকথিত এই মানববন্ধনে হাজির হলেও অনেকেই হুমকির পর থেকে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে বলে অভিযোগ করে তারা বলেন, সেনাবাহিনীর অভিযানের পর থেকে গ্রামবাসীদের মনে স্বস্তি ফিরেছে।

এছাড়া, সিএইচটি নিউজে অভিযোগকৃত রিপন চাকমা নামে উক্ত এলাকায় যার বাড়িতে ভাংচুর, জিনিসপত্র পুড়িয়ে দেয়া ও মুরগী খেযে ফেলার অভিযোগ তোলা হয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সেটিও মিথ্যা বলে জানিয়েছেন রিপন চাকমা প্রতিবেশী আদু মিলন চাকমা। তিনি জানান, সেনাবাহিনী নয় বরং ইউপিডিএফের কয়েকজন সদস্য মানবন্ধনের সকালে রিপন চাকমার খোয়াড় থেকে জোরপূর্বক ২টি মোরগ নিযে যায় নিজেদের দুপুরের খাবারে যোগ করার কথা বলে।

স্থানীয়, পাহাড়ি-বাঙালিরা বলছেন, পাহাড়ে যে চারটি সন্ত্রাসী সংগঠন আছে তারা চায় না পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসুক। তাদের মধ্যে স্বাধীনতা বিরোধী, শান্তিচুক্তি বিরোধী চক্র রয়েছে। সেনাবাহিনী থাকার কারণে পাহাড়ে সকল ধর্মের মানুষ নিরাপদে সহাবস্থান করছে। পাহাড়ি-বাঙালি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাস করছে। কিন্তু সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো সেটা চায় না। তারা চায়, পাহাড়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো বছরে প্রায় দুইশ কোটি টাকা চাঁদা নেয় পাহাড়ি বাঙালিদের কাছ থেকে।

তারা বলছেন, এই সন্ত্রাসীদের কাছে আমরা জিম্মি হতে পারি না। আমরা সহাবস্থানে থাকতে চাই। আমরা সকল ধর্মের মানুষ মিলেমিশে থাকতে চাই। কিন্তু চারটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কারণে আমরা পারছি না। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন পাহাড়ি— বাঙালিরা।

পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়ি—বাঙালিরা আরো বলেছেন, পার্বত্য অঞ্চলের সূচনালগ্ন থেকেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অসংখ্য কিয়াংঘর তৈরি করেছে এবং তার সুরক্ষায় সর্বাত্মকভাবে নিজেদেরকে আত্মনিয়োগ করেছে। পক্ষান্তরে আমাদের ঠিক পার্শ্ববর্তী দেশের বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী সেনাবাহিনী জাতিগত নিধন চালিয়ে নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে হাজার হাজার নিরীহ মুসলমানকে জীবন্ত পুড়িয়ে, জবাই করে, গুলি করে হত্যা করেছে। সেই সাথে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করেছে অসংখ্য মসজিদ। তাদের নির্মমতার শিকার হয়ে প্রায় ১২ লক্ষাধিক অসহায় মানুষ প্রাণ বাঁচাতে আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছে। যাদের দেখভাল করা, চিকিৎসা সেবা প্রদান, খাবার বিতরণ থেকে শুরু করে পুনর্বাসন প্রক্রিয়াতেও আমাদের এই দেশপ্রেমী সেনাবাহিনীকেই অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও শান্তিরক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে শান্তিরক্ষার পাশাপাশি সেদেশের মানুষের জীবনমানের উন্নয়নসহ ধর্মপ্রাণ সকল ধর্মাবলম্বী মানুষের জন্যও উপাসনালয় তৈরি করে দিয়েছে এবং দিয়ে চলেছে। সেনাবাহিনী দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম, নির্ঘুম রাত্রিযাপন, সাপের কামড় আর ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও মাসের পর মাস মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান, প্রিয়জনদেরকে ছেড়ে দুর্গম পাহাড়ে শান্তি স্থাপনের অন্বেষায় নিজেদেরকে বিলিয়ে দিয়েছে। অথচ তাদেরকেই কি-না সেখানে অপপ্রচারের বলি বানানো হচ্ছে।