বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা ও আজকের বাস্তবতা - Southeast Asia Journal

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা ও আজকের বাস্তবতা

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

জি. মুনীর

বিগত চার দশক ধরে বাংলাদেশ কাজ করে আসছে রোহিঙ্গাদের সেইফ হেভেন হিসেবে। এরা পাশের দেশ মিয়ানমার থেকে রাষ্ট্র ও উগ্র বৌদ্ধদের নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ১৯৭৮ সালে এ ধরনের দুই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আসে। ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসে আরো ৫০ হাজার রোহিঙ্গা। এই দুই পর্বে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে নানা দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটিয়ে আবার নিজ দেশ মিয়ানমারে চলে যায়। তবে অনেকেই ফিরে যায়নি। এরা রয়ে গেছে বাংলাদেশেই। বাংলাদেশ এদের আশ্রয় দেয়।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায় ২০১৭ সালের আগস্টে তাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের পরিকল্পিত হামলা গণহত্যা চালানোর পর। এ সময়ে বাংলাদেশে আসে আরো সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। এদের সাথে আগে থাকা উল্লিখিতরা মিলে কক্সবাজার জেলা এখন ১০ লাখ রেহিঙ্গা শরণার্থীর আবাসভূমি। এদের ছয় লাখ এখন আছে শরণার্থীদের জন্য নির্মিত কুতুপালং মেগা শিবিরে। আর এটি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এই বিপুলসংখ্যক শরণার্থী বাংলাদেশের জন্য নিশ্চিতভাবেই বড় ধরনের একটি বোঝা। এই শরণার্থী শিবির নিয়ে মাঝে মধ্যে সরকারকে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক চাপ এবং নিরাপত্তা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এই রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে উদ্ভূত নানামুখী বাস্তবতা মোকাবেলা করে চলতে হচ্ছে। আছে এসব শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের সীমাহীন পিছুটান। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে, বলতেই হয়- নিকটভবিষ্যতে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে, এমন সম্ভাবনা খুবই কম। একান্ত বাধ্য না হলে মিয়ানমার এদের ফেরত নেবে বলে মনে হয় না। ফলে এক-দুই বছরে এই সমস্যা সমাধানের বিষয় নয়। শরণার্থী ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের তালবাহানা সে বিশ্বাসকেই জোরদার করে তোলে। শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য এ সমস্যার শুরু চার দশক আগে। এ সমস্যা সমাধানে চার দশক সময় কম ছিল না। কিন্তু সুদীর্ঘ সময় ধরে মিয়ানমারের নেতিবাচক ভূমিকার কারণে সমস্যার সমাধান হয়নি। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ফেরত নেয়ার ব্যাপারে নেতিবাচক ভূমিকার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বলতেই হচ্ছে, সমস্যাটি বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি।

১৯৭০ ও ১৯৯০-এর দশকে সরকার বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করতে দিয়েছে। এই উভয় ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শরণার্থী কয়েক বছরের মধ্যে অবশ্য মিয়ানমারে ফিরে গেছে। কিন্তু আজকের রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কটের বেলায় তেমনটি ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। এবারের রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যাটাও বিপুল। অতীতের দশকগুলোতে বাংলাদেশ নজর দিয়েছে একান্তভাবেই তাদের স্বদেশে পাঠানোর ব্যাপারে এবং ১৯৭৮ সালে ও ১৯৯০-এর দশকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফিরেও যায়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ আশা করেছিল, বাংলাদেশ এবার আরো বেশি পরিমাণে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাবে। কিন্তু সে বছর অক্টোবরে এসেও যখন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা থামল না, তখন এদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সাথে আলোচনার সূত্রপাত করে। মিয়ানমার বাংলাদেশের সাথে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করার পর ডিসেম্বরে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করে। উদ্দেশ্য ছিল রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরার বিষয়টির সমন্বয় সাধন। উভয় পক্ষ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সাথে। তা সত্ত্বেও, এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। দেশ দু’টি রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেয় ২০১৮ সালের নভেম্বরে এবং ২০১৯ সালের অক্টোবরে। এই উভয় উদ্যোগের মাধ্যমে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে চাইলেও সমস্যা দেখা দেয় স্বদেশে ফেরত যাওয়ার শর্তাবলি নিয়ে। রোহিঙ্গারা জানায়, তারা ফিরে যাবে না যদি না- মিয়ানমারে তাদের ওপর কায়েমি প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য দূর করে এবং ধারাবাহিক নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধ করা হয়। রোহিঙ্গা নেতারা তাদের ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে কিছু পূর্বশর্ত আরোপ করেন। এর মধ্যে আছে : সরকারিভাবে স্বীকার করে নিতে হবে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বা এথনিক গ্রুপ; ফিরিয়ে দিতে হবে পূর্ণ নাগরিকত্ব; বহাল করতে হবে রোহিঙ্গা সমাজের অবাধ চলাচলের স্বাধীনতা এবং রাখাইন রাজ্যে তাদের দিতে হবে চাকরির সুবিধা। তারা এমন ব্যবস্থা চান, যাতে এটিই হয় তাদের শরণার্থী হওয়ার শেষ ঘটনা। তারা এটি পুনর্বার ঘটতে দিতে নারাজ। তারা পরিপূর্ণ অধিকার নিয়ে মিয়ানমারে ফিরতে চান।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশই রোহিঙ্গাদের এই যৌক্তিক দাবি সমর্থন করে। তবে এসব দেশের সরকারি কর্মকর্তারা এ কথাও স্বীকার করেন, মিয়ানমার যদি এসব দাবির বিষয়টি ফয়সালা না করে, তবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরে যাওয়া যেমন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে, তেমনি ভবিষ্যতেও আরো রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসতে থাকবে। কিন্তু এসব দাবির ব্যাপারে মনে হয় কোনো প্রভাব পড়েনি মিয়ানমারের রাজধানীতে। রোহিঙ্গাদের এমন সব দাবি মেনে নিতে মিয়ানমার অব্যাহতভাবে অস্বীকার করে আসছে। এর পবিবর্তে তাদের অভিমত, রাখাইন রাজ্যের সমস্যা সমাধানের উপায় হচ্ছে সেখানে বিনিয়োগ ও অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে এ রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া। এর সাথে সমন্বয় সাধন করেই রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে হবে। আর এ বিষয়টি হয়ে দাঁড়ায় রোহিঙ্গাদের নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে যাওয়ার সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ, অনেক রোহিঙ্গা গ্রাম ধ্বংস করে সেখানে ইতোমধ্যেই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কাঠামো নির্মাণের। তাও আবার করা হচ্ছে বিদেশী বিনিয়োগে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের কাজটি যতই দীর্ঘায়িত হচ্ছে, বাংলাদেশের কর্মকর্তারা মনে করছেন, মিয়ানমার এ ব্যাপারে ততই বেশি মাত্রায় আন্তরিকতাহীন হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ও মর্যাদার সাথে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে দেয়া প্রতিশ্রুতি থেকে পিছু হটেছে। উভয়পক্ষ পরস্পর দোষারোপ করছে প্রতিপক্ষকে রিপাট্রিয়েশন প্রটোকল মেনে না চলা ও এই প্রক্রিয়াকে গতিহীন করে তোলার অভিযোগ তোলে। এ ব্যাপারে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো খারাপের দিকে যায় গত বছরের জুনে। তখন মিয়ানমারের নেতা অং সান সু চি বলেন, বাংলাদেশের ব্যর্থতার কারণেই ফরমাল চ্যানেলে শরণার্থী ফিরিয়ে নেয়া যায়নি। এর প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সমস্যা নিহিত মিয়ানমারের মধ্যে। কারণ, তারা যেকোনো উপায়েই হোক রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চায় না। এমনি প্রেক্ষাপটে মনে করা হয়েছিল চীন হয়তো মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, চীন মিয়ানমারের পক্ষেই কথা বলছে। অন্য কোনো দেশ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ না নেয়ায় সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া কিছুতেই যেন এগিয়ে যাচ্ছে না।

এমনি প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা হিসেবে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযোগ এখন তোলা হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি), ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসসিজে) ও আর্জেন্টিনার অভ্যন্তরীণ আদালতে। এ অভিযোগ আদালতে নিয়ে গেছে বাইরের কয়েকটি দেশ। যদিও কার্যকর করার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে মিয়ানমারের অথবা সে দেশের জ্যেষ্ঠ কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতের দেয়া এ ধরনের যেকোনো রায় হতে পারে প্রতীকী মাত্র।

অবশ্য অনেক দেশ ও সেই সাথে জাতিসঙ্ঘ ও এনজিওগুলো মিয়ানমারের ওপর চাপ দিচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যাটি সমাধানে গঠনমূলক পদক্ষেপ নেয়ার জন্য। তবে এ চাপ মিয়ানমাকে বাধ্য করার মতো কোনো চাপ নয়। ফলে এ ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো অগ্রগতি অর্জিত হতে দেখা যায়নি। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আরো কার্যকর চাপ সৃষ্টি জোরদার করার জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল আঞ্চলিক হেভিওয়েটদের সমর্থন, বিশেষ করে ভারত ও চীনের সক্রিয় সহযোগিতা। কিন্তু চীন স্পষ্টতই বলে দিয়েছে, মিয়ানমারকে চীন কোনো কিছু করতে বাধ্য করবে না। বাস্তবে কৌশলগত ও বাণিজ্যিক স্বার্থসংশ্লিষ্টতার কারণেই চীন মিয়ানমারকে পাশে রাখবে। ভারতকেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে পাশে পায়নি। স্পষ্টতই ভারতের সমর্থনটাও পেয়েছে মিয়ানমার।

সদ্য বিগত বছরটিতে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের নেতারা রোহিঙ্গাদের নিয়ে তাদের বিভিন্ন উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেছেন। বলা হচ্ছে, এরা সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে। নেশাপণ্য চোরাচালানের সাথে এরা জড়িত হচ্ছে। গত বছরে নেশাপণ্য চোরাচালানের অপরাধের সাথে জড়িত কক্সবাজারের বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা ও স্থানীয় লোক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাতে ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখা গেছে। গত বছরের ২২ আগস্টে তিন হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি সম্পন্নের পরও একজনকেও ফেরত পাঠানো যায়নি। একই দিনে আওয়ামী অঙ্গসংগঠনের একজন নেতা টেকনাফ সীমান্তে নিহত হন। তখন অভিযোগ ওঠে এর জন্য রোহিঙ্গারা দায়ী। এসব ঘটনার জের হিসেবে বাংলাদেশের বেশির ভাগ গণমাধ্যমে রোহিঙ্গাবিরোধী সমালোচনা বেড়ে যায়। এদিকে পুলিশ সন্দেহভাজন দু’জন রোহিঙ্গাকে আটক করলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে শরণার্থীদের মধ্যে। এর তিন দিন পর ২৫ আগস্টে সেখানে শরণার্থীদের বড় ধরনের এক সমাবেশ হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর মতে, এই সমাবেশে দুই লাখ রোহিঙ্গা সমবেত হয়েছিল। তারা এই দিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসেবে অভিহিত করে। তাদের মতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে মিয়ানমার বাহিনী মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা অভিযান শুরু করেছিল। এই সমাবেশ শান্তিপূর্ণ হলেও রোহিঙ্গাদের দ্রুত এ ধরনের সমাবেশ আয়োজনের সক্ষমতা দেখে স্থানীয় কর্মকর্তারা কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। সরকার এ ব্যাপারে এনজিওদের ইন্ধনের অভিযোগ উচ্চারণ করে। তা ছাড়া, এর ফলে সরকারের ওপর স্থানীয়ভাবে চাপ বাড়ে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপের জন্য। ফলে এনজিওগুলোর কর্মকাণ্ড সীমিত করার চাপও আসে সরকারের ওপর। সব কিছু মিলিয়ে সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে দেশের ভেতরেও এক ধরনের রাজনৈতিক চাপের মধ্যে পড়ে।

বাস্তবতা হচ্ছে, সামগ্রিক পরিস্থিতিদৃষ্টে বললে ভুল হবে না, বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে শিগগিরই ফিরিয়ে নেয়ার সম্ভাবনাটা খুবই কম। রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রশ্নে বাংলাদেশকে উদ্ভূত বাস্তবতার আলোকেই নীতি অবস্থান নির্ধারণ করতে হবে। ঢাকা বর্তমানে অপরাধ দমন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শরণার্থীদের ও এনজিওদের ওপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপের নীতি অবলম্বন করছে, তা কোনো সুফল বয়ে আনবে না। বরং তা হবে কাউন্টারপ্রডাক্টিভ। শরণার্থী শিবিরে পুলিশের উপস্থিতি ও তৎপরতা না বাড়িয়ে বরং বাংলাদেশ সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে এমন সব পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে, যা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের দক্ষিণাংশের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং একই সাথে শরণার্থীদের সুরক্ষার একটি সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি হয়। রোহিঙ্গাদের এই বাস্তুচ্যুতির বিদ্যমান সঙ্কটটিকে একটি একক-বছরের সমস্যা হিসেবে না নিয়ে বাংলাদেশকে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে নিতে হবে। এই সমস্যা সমাধানে শরণার্থীদের মানবিক দিকটির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। শরণার্থীদের সাধারণ শিক্ষাসহ ও বৃত্তিমূলক শিক্ষারব্যবস্থা নিলে এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল পাওয়া যেতে পারে। তা ছাড়া ভবিষ্যতে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে গেলে যাতে এরা সেখানকার সমাজের সাথে একাত্ম হতে পারে সেজন্য তাদের নিজস্ব ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার। এর ফলে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা অপরাধমুখী না হয়ে কর্মমুখী হবে বলেই মনে হয়। এদের মধ্যে কমবে মিলিট্যান্সি ও ক্রিমিনালিটি। সাথে সাথে জোরদার কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে রোহিঙ্গাদের ধাপে ধাপে মিয়ানমারে রিইন্টিগ্রেশনের তৎপরতাও, যাতে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি এদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো যায়।

এ ধরনের পরিবর্তিত নীতি অবলম্বনে ঢাকার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন হবে এর আন্তর্জাতিক সাথীদের সক্রিয় সহযোগিতা। তাদের উচিত হবে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে মিয়ানমার বাধ্য হয়ে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেয় এবং তাদের নিজ দেশে নিরাপদ বসবাসের বিষয়টি নিশ্চিত করে। একই সাথে তাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব এবং নাগরিক ও মানবিক অধিকার নিশ্চিত করে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে শিক্ষাদীক্ষাহীন ও কর্মহীন করে রাখলে এরা নিজেরাও ভবিষ্যতে মিয়ানমারে ফিরে গেলেও সে দেশে বসবাস করতে হবে এক পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী হিসেবে। আর বাংলাদেশে থাকলে এরা রূপ নেবে একটি অপরাধী জনগোষ্ঠী হিসেবে। এ বিষয়টিও ভুলে গেলে চলবে না। তা ছাড়া বাংলাদেশী গণমাধ্যমে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যাপারে অতিমাত্রিক নেতিবাচক প্রচারণাও বন্ধ করা উচিত। কারণ, এ ধরনের প্রচারণা আন্তর্জাতিক মহলে রোহিঙ্গাদের একটি অপরাধী জাতিসম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত করে তুলবে। এর ফলে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তাদের প্রতি সহমর্মিতা কমে যাবে। এ ধরনের প্রচারণার ফলে আড়াল হয়ে পড়ে তাদের সত্যিকারের পরিচয় : রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জাতি, রাষ্ট্রহীন এক জনগোষ্ঠী। এরা শত শত বছর ধরে মিয়ানমারে বসবাস করেও সব ধরনের অধিকারহারা এক জনগোষ্ঠী। এরা নিজ দেশের সেনাবাহিনীর গণহত্যার শিকার, জাতিগত নিধনের শিকার।

শরণার্থী সম্পর্কিত সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে সরকারকে এক-বছরের পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিভিন্ন এনজিওর মানবিক কর্মসূচির ব্যাপারে সরকারকে উদার মনোভাব গ্রহণ করতে হবে। জাতিসঙ্ঘ ও ইউনিসেফের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে মিলে বহু-বার্ষিক পরিকল্পনার চেষ্টা চালাতে হবে। ডোনারদের কাছ থেকে এমন সহায়তা চাইতে হবে, যা টানা কয়েক বছর ধরে চলে। এমন কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে, যাতে শরণার্থীরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে। জাতিসঙ্ঘ ও দাতাদের সহায়তায় এমন শরণার্থী শিবির নির্মাণ করতে হবে, যা বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়।

রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাটি নিয়ে কাজ করার সময় আমাদের শরণার্থীদের অধিকার সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। রিফিউজি কনভেশনের ১২ থেকে ৩০ নম্বর ধারায় শরণার্থীদের অধিকারের কথা বর্ণিত রয়েছে। যেমন : সব শরণার্থীদের পরিচয়পত্র দিতে হবে। দিতে হবে প্রয়োজনীয় ভ্রমণসংশ্লিষ্ট কাগজপত্র, যাতে এরা আশ্রয়দাতা দেশ ছাড়াও অন্য দেশে যেতে পারে। শরণার্থীদের আশ্রয়দাতা দেশের নাগরিকদের মতো সম-আচরণ করতে হবে। তাদের অবাধে ধর্মীয় আচার পালন ও ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে দিতে হবে। আইনি সহায়তাসহ আদালতে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। সুযোগ দিতে হবে প্রাথমিক শিক্ষার। সরকারি ত্রাণ ও সহায়তা তাদের দিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের সংরক্ষণ সুযোগ দিতে হবে। সাহিত্য, শিল্পকর্ম ও বৈজ্ঞানিক কর্মের সুরক্ষা দিতে হবে। এ ছাড়াও রয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নানা অধিকার। সেসব অধিকার যেন আমরা লঙ্ঘন না করি।