ভারতে কেন সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়িয়ে পার পাওয়া যায়? - Southeast Asia Journal

ভারতে কেন সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়িয়ে পার পাওয়া যায়?

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

ভারতে সম্প্রতি ১০ই এপ্রিল যে রাম নবমী পার্বণ হয়ে গেল তার আগের বেশ কয়েকদিন ধরে একের পর এক এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যাতে নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে ঘৃণা ছড়িয়েও দেশটিতে সহজে পার পাওয়া যায়। রাম নবমীকে কেন্দ্র করে নেতাদের মুখে চরম ঘৃণাসূচক বিবৃতি শোনা গেছে। কয়েকটি রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা পর্যন্ত হয়েছে। মানুষ মারা গেছে।

দক্ষিণের হায়দ্রাবাদ শহরে, কট্টর হিন্দু দল বিজেপির একজন এমপি – যাকে ২০২০ সালে ঘৃণা ছড়ানোর দায়ে ফেসবুকে নিষিদ্ধ করা হয় – নিজের গলায় একটি গান গেয়েছেন। সেই গানের কথা ছিল – যে মানুষ হিন্দু দেবতা রামের নাম করবে না, তাকে ভারত থেকে বের করে দেওয়া হবে। তার কয়েকদিন আগে, অনলাইনে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায় উত্তর প্রদেশ রাজ্যের একজন হিন্দু ধর্মগুরু প্রকাশ্যে মুসলিম নারীদের অপহরণ এবং ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছেন। ঐ ভিডিও নিয়ে হৈচৈ শুরু হলে এক সপ্তাহ পর পুলিশ একটি মামলা দায়ের করে এবং বুধবার ঐ গুরুকে আটক করে।

প্রায় একই সময়ে ইয়াতি নরসিংঘানান্দ সরস্বতী নামে আরেক বহুল পরিচিত একজন হিন্দু ধর্মগুরু রাজধানী দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে দেয়া ভাষণে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হিন্দুদের হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার ডাক দেন। এই গুরুর বিরুদ্ধে আগেও এমন ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে মামলা হয়েছে এবং তিনি সেই মামলায় এখন জামিনে রয়েছেন।

পুলিশ বলেছে যে অনুষ্ঠানে মিঃ সরস্বতী ভাষণ দিয়েছে তার কোনো অনুমতি ছিলনা এবং তিনি তার জামিনের শর্ত ভেঙ্গেছেন। কিন্তু তারপরও ঐ গুরুর বিরুদ্ধে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ভারতে অনেক দিন ধরেই প্রকাশ্যে এমন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বিবৃতি দেওয়া একটি সমস্যা। ১৯৯০ সালে, ভারত শাসিত কাশ্মীরের কিছু মসজিদে হিন্দু বিরোধী ঘৃণাসূচক বক্তব্য দেওয়ার পর সেখানে সহিংসতা শুরু হয় যার পরিণতিতে দলে দলে হিন্দুরা কাশ্মীর ছাড়ে। ঐ একই বছর বিজেপি নেতা লাল-কৃষ্ণ আদভানি অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ চত্বরে রাম মন্দির নির্মাণের আন্দোলন শুরুর ঘোষণা দেওয়ার পর দলবদ্ধ হিন্দুরা কয়েকশ বছরের পুরনো মসজিদটি গুঁড়িয়ে দেয় যার পরিণতিতে ব্যাপক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়।

কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানো ও বক্তব্য বিবৃতি দেয়ার প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। এমনকি ছোটোখাটো রাজনীতিকদের কথাবার্তাও সোশ্যাল মিডিয়া এবং টিভি চ্যানেলগুলোর সুবাদে ব্যাপক প্রচার পাচ্ছে, এবং এসব অখ্যাত লোকও সহজে নিজেদের পরিচিত করে তুলতে তার সুযোগ নিচ্ছে – বিবিসিকে বলছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নীলাঞ্জন সরকার। ফলে, তিনি বলছেন, ঘৃণাসূচক বক্তব্য বিবৃতির “বিরতিহীন বিস্তার ঘটছে।”

“আগে সাধারণত নির্বাচনের আগে এসব ঘৃণাসূচক কথাবার্তা শোনা যেত। কিন্তু এখন মিডিয়া জগতের নতুন যে চালচিত্র তাতে রাজনীতিকরা বুঝতে পেরেছেন যে একটি রাজ্যে এ ধরনের বক্তব্য দিলে অন্য রাজ্যেও নিজের দলের লোকজনের সুবিধা হবে,” বলছেন মি. সিরকার।

টিভি নিউজ চ্যানেল এনডিটিভি ২০০৯ সালে ‘ভিআইপি হেট স্পিচ’ নামে একটি কর্মসূচি নেয় যেখানে তারা বড় বড় রাজনীতিকদের – মন্ত্রী, এমপি – ঘৃণাসূচক বক্তব্য-বিবৃতির ওপর নজর রাখে। জানুয়ারি মাসে এনডিটিভি জানায়, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই প্রবণতা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। বেশ কজন শীর্ষ বিজেপি নেতা – যাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরাও রয়েছেন – এসব সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক বিবৃতি দিয়েও সহজে পার পেয়ে গেছেন।

বেশ কজন বিরোধী রাজনীতিকও – যেমন লোকসভার এমপি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এবং তার ভাই আকবর উদ্দিন ওয়াইসি – ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে একাধিকবার অভিযুক্ত হয়েছেন। ২০১২ সাল থেকে আকবর উদ্দিন ওয়াইসির বিরুদ্ধে এরকম দুটো মামলা হয় যেগুলো থেকে বুধবার তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানোর বিরুদ্ধে ভারতে যথেষ্ট আইন রয়েছে।

“কিন্তু সেই আইন প্রয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠান দরকার, এবং অধিকাংশ সময় এসব প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না,” বলেন সিনিয়র আইনজীবী অঞ্জনা প্রকাশ, যিনি গত ডিসেম্বরে উত্তরাখণ্ড রাজ্যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় উসকানি দেওয়ার জন্য কয়েকজন হিন্দু ধর্মীয় নেতার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন করেছেন। তবে কোন কথা ঘৃণাসূচক আর কোনটি নয় সে ব্যাপারে ভারতে আইনি ব্যাখ্যা খুব স্পষ্ট নয়। তবে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় কিছু ব্যতিক্রমের কথা আইনে বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে যাতে বলা আছে কোন কথা বলা যাবে না বা লেখা যাবে না।

যেমন, আইনে এমন কথা বা কাজকে অপরাধ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যেগুলো “বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা বাড়িয়ে তুলতে পারে”। ইচ্ছাকৃত-ভাবে কোনো কথা বা কাজের মাধ্যমে “কোনো গোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতি এবং বিশ্বাসে আঘাত করা” ভারতে দণ্ডনীয় অপরাধ। ঘৃণা ছড়ানোর বিভিন্ন মামলা মাঝে মধ্যেই আদালতে আসে। কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আদালতের মধ্যে একটি দ্বিধা কাজ করে।

রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় নেতাদের বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বিবৃতি দেওয়া বন্ধ করতে একটি গাইডলাইন তৈরির জন্য ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্টে একটি পিটিশন করা হয়। আদালত তখন তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছিল যে এ ধরনের বিদ্বেষমূলক বক্তব্য-বিবৃতি মানুষকে বিপদগ্রস্ত করে। কিন্তু চলতি আইনের বাইরে বাড়তি কোনো নির্দেশনা দিতে সুপ্রিম কোর্টে অস্বীকার করে।

সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার জন্য নিরপেক্ষ আইনজ্ঞদের নিয়ে তৈরি আইন কমিশনকে নির্দেশ দেয়। ২০১৭ সালে আইন কমিশন সুপারিশ করে যে ঘৃণাসূচক বক্তব্য বিবৃতিকে অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করতে হবে এবং ভারতীয় পেনাল কোডে তা ঢোকাতে হবে।

কিন্তু পেনাল কোডে প্রস্তাবিত এই সংশোধনের প্রশ্নে অনেক আইনজ্ঞ উদ্বিগ্ন। “কোনটি ঘৃণাসূচক বিবৃতি তা সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করে একটি আইন আনলে তাতে খুব বেশি কিছু লাভ হবেনা। কারণ কথা বা কাজে ঘৃণা ছড়ানো এখনও চলতি আইনে অপরাধ,” বলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আদিত্য ভর্মা। তার মতে, সবচেয়ে বড় উদ্বেগ যেটি, তা হলো প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা। তিনি ব্রিটেনের উদাহরণ টানেন যেখানে কোভিড বিধিনিষেধ ভেঙ্গে পার্টি করার জন্য পুলিশ এমনকি প্রধানমন্ত্রী জনসনকেও জরিমানা করেছে। কিন্তু ভারতে রাজনৈতিক চাপে পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালনে অনীহা দেখাচ্ছে – এমন ঘটনা খুবই স্বাভাবিক।

“হয়তো আইনে কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে, কিন্তু তার চেয়েও যেটা বড় সমস্যা তা হলো যেটি কালো অক্ষরে আইনে ইতিমধ্যেই লেখা আছে সেটাওতো প্রয়োগ হচ্ছে না,” বলেন মি ভর্মা।

আইনজীবী অঞ্জনা প্রকাশ বলেন প্রতিষ্ঠানের এই “এই পালন না করার” যে প্রবণতা তার ভয়াবহ পরিণতি রয়েছে। “যিনি হিংসা ছড়াচ্ছেন, তাকে যদি আপনি শাস্তি না দেন, তাহলে আইন কিভাবে অপরাধ ঠেকাবে?”

বিশেষজ্ঞরা বলেন ঘৃণা ছড়ানোর প্রবণতা সমাজে যখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়, তার পরিণতি ভয়াবহ।

“যখন পরিবেশ পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে ওঠে, মানুষ যখন চরম ভীতি-উসকানির মধ্যে জীবনযাপন করতে থাকে, তখন সে তার স্বাভাবিক জীবন-যাপন, জীবিকা থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে,” বলেন মি সিরকার। সেটাই, তার মতে, কোনো সমাজ এবং রাষ্ট্রের “সবচেয়ে বড় ক্ষতি।”

সূত্র: বিবিসি বাংলা।