শ্রীলঙ্কার হাসপাতালে দুরবস্থা: মোবাইলের আলোতে অস্ত্রোপচার - Southeast Asia Journal

শ্রীলঙ্কার হাসপাতালে দুরবস্থা: মোবাইলের আলোতে অস্ত্রোপচার

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

তিন বছর বয়সী মিরু লাল টকটকে একটা খেলনা গাড়ি দিয়ে খেলছে। চারপাশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে তার কোনো ধারণা নেই।

অর্থনৈতিক দুরবস্থায় জর্জরিত শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের খাবার ও বিদ্যুতের সংকট চলমান। রাস্তাঘাটে প্রতিবাদ করছেন তারা। দেশটির হাসপাতালগুলোতেও এখন করুণ পরিস্থিতি দেখা দিচ্ছে।

ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত মিরু প্রায় মৃগীরোগের কাঁপুনিতে পড়ে কয়েক মিনিটের জন্য সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে। তার জন্য প্রয়োজন হয় একটি অ্যান্টি-কনভালসেন্ট ঔষধ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে মিরুর বাবা উপুল চন্দনার পক্ষে কোথাও ওই ঔষধ পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কারণ শ্রীলঙ্কাতে এরকম অনেক ঔষধ আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে।

‘কোনো হাসপাতালে ঔষধটা নেই, ফার্মেসিগুলোতেও শেষ। টাকা দিয়েও ওই ঔষধ আর জোগাড় করতে পারছি না,’ বলেন উপুল।

কয়েক দশকের মধ্যে তীব্রতম অর্থনৈতিক মন্দায় ভুগছে শ্রীলঙ্কা। বাইরে থেকে মৌলিক জিনিসপত্র ও ঔষধ আমদানি করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে দেশটির জন্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারছেন না দেশটির নাগরিকেরা। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন তারা।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট পদত্যাগের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে শ্রীলঙ্কা। বর্তমানে বেইলআউট প্যাকেজ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)-এর সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে ভারত মহাসাগরের ছোট্ট এ দ্বীপদেশটি।

এ পরিস্থিতিতে ‘নজিরবিহীন মানবিক সংকটে’ পড়েছে শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্যসেবা। ডাক্তারেরা জানিয়েছেন তারা মেডিকেল যন্ত্রপাতি একবারের বদলে ধুয়ে আবার ব্যবহার করছেন। একটি শল্যচিকিৎসার জন্য মোবাইল ফোনের লাইট ব্যবহার করতে হয়েছে বলেও জানা গেছে।

এখন অব্দি দেশটিতে ঔষধ সংকটের কারণে কেউ মারা যায়নি বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করেছেন এ অর্থনৈতিক সংকটের ফলে কোভিডের ১৬ হাজার মৃত্যুর চেয়ে বেশি মানুষ মরতে পারে শ্রীলঙ্কায়।

শ্রীলঙ্কার স্টেইট ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন-এর সেক্রেটারি আথুলা আমারাসেনা বলেন, ‘এ সংকট আরও কতটা খারাপের দিকে যাবে তা এখনো বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা এটা বুঝতে পারছি আমরা আরও তীব্রতর সংকটের দিকে ধাবমান হচ্ছি।’

হাসপাতালে শোচনীয় পরিস্থিতি
বাসন্ত সেনেবীরত্নে প্রতিদিন কলম্বোর বিভিন্ন ফার্মেসিতে হন্যে হয়ে কেমোথেরাপির ঔষধ টপোটেকান খুঁজে বেড়ান। তার ৭ বছরের মেয়ের বেঁচে থাকা নির্ভর করছে এ ঔষধের ওপর।

কিন্তু হাসপাতাল বা ফার্মেসি, সব জায়গা থেকে একই উত্তর মেলে: দেশে এ ঔষধ আর পাওয়া যায় না। কয়েক সপ্তাহ আগেও হাসপাতালগুলো রোগীদের জন্য বিনামূল্যে টপোটেকান সরবরাহ করত।

শ্রীলঙ্কান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (এসএলএমএ)-এর প্রকাশিত এক বিবৃতি অনুযায়ী, দেশটির সব হাসপাতালে এখন জরুরি ঔষধপত্র ও মেডিকেল ইকুইপমেন্টের সংকট তৈরি হয়েছে। অ্যানেসথেটিক (বেদনানাশক) ও রিএজেন্টের অভাবে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে রুটিন সার্জারিগুলো স্থগিত করা হয়েছে, গবেষণাগারে পরীক্ষানিরীক্ষা কমানো হয়েছে।

পেরিনাটাল সোসাইটি অব শ্রীলঙ্কা’র প্রেসিডেন্ট হাসপাতালগুলোকে এনডোট্র্যাকিল টিউব জীবাণুনাশ করে পুনরায় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। এ টিউবগুলো দিয়ে নবজাতকের ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের একজন সার্জন জানিয়েছেন, স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের রোগীদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ঔষধের সরবরাহ এখন খুবই অপ্রতুল। হাসপাতালগুলো বাধ্য হয়ে একটি ক্যাথেটার একাধিকবার ব্যবহার করছে।

শ্রীলঙ্কার ঘরবাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করা হলেও হাসপাতালগুলোতে বিদ্যুৎ ঠিক রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, হার্টের সমস্যায় আক্রান্ত এক শিশুর অস্ত্রোপচার করার সময় তারা লোডশেডিং-এর মুখে পড়েছিলেন। তখন বাধ্য হয়ে জেনারেটর চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদেরকে মোবাইল ফোনের বাতি দিয়ে অপারেশন চালিয়ে যেতে হয়েছিল।

ওই চিকিৎসক বলেন, দুইটি মোবাইল ফোনের আলো থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে অপারেশন করতে ও সেলাই করতে বেগ পেতে হয়েছিল।

শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন হাসপাতালেই চিকিৎসকদের ক্যাথেটার ও টিউব একাধিকবার ব্যবহার করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এতে রোগীদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও আপাতত এর বাইরে কোনো পথও খোলা নেই চিকিৎসকদের কাছে।

অনেক ডাক্তারকেই কোন রোগীর ঔষধ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা ঠিক করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে (আইসিইউ) কতজন রোগী আগামী কয়েক সপ্তাহ বেঁচে থাকবেন, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে খোদ ডাক্তারদের মধ্যে।

যেভাবে আজকের দশা
কেউ কেউ বলছেন এরকম পরিস্থিতি আঁচ করতে পারাটা সরকারের উচিত ছিল।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্রীলঙ্কার সরকারের অব্যবস্থাপনা ও কোভিড-১৯-এর মতো দৈব দুর্ঘটনার কারণে আজকে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি এভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে।

আইএমএফ-এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৬.৯ বিলিয়ন ডলার থাকলেও তা এ বছর ২.২ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে।

নগদ অর্থ এভাবে কমে যাওয়ায় জ্বালানিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং মেডিকেল সরঞ্জাম, ঔষধ আমদানি স্থগিত হয়ে পড়ে দেশটিতে।

কয়েক মাস ধরেই আসন্ন সংকট বিষয়ে সতর্ক করে দিচ্ছিলেন শ্রীলঙ্কার চিকিৎসাখাতের মানুষজন। এমনকি সরকারের কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন দেশটির ডাক্তার ও নার্সেরা।

এর আগে ভ্রুক্ষেপ না করলেও এবং কোনো প্রকার ঘাটতির কথা উড়িয়ে দিলেও গত বুধবার শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বীকার করেছে, দেশটি কিছু ঔষধ ও অস্ত্রোপচারের সরঞ্জাম সংকটে ভুগছে।

মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ঔষধ কেনার জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পেয়েছে শ্রীলঙ্কা। তবে সে ঔষধ কখন দেশে এসে পৌঁছাবে তা এখনো অজানা।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ড. আনভের হামদানি এ পরিস্থিতিকে সংকটের বদলে ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এ সময় তিনি দাবি করেন, এ মাস শেষ হওয়ার আগেই ঘাটতির পেছনের সমস্যাগুলোর সমাধান করে ফেলবে শ্রীলঙ্কার সরকার।

তবে অনেকে দাবি করছেন, বর্তমান সংকট মানবসৃষ্ট। গভর্নমেন্ট মেডিকেল অফিসার্স ফোরাম (জিএমওএফ)-এর প্রেসিডেন্ট ড. রুকসান বেলানা বলেন, সরকার মজুদের জন্য ক্রেডিট লাইন পরিশোধ করতে পারেনি।

তিনি জানান, সরকারের অনুমোদিত ২৫০০ ফার্মাসিউটিক্যাল আইটেমের মধ্যে ৬০টির সরবরাহ কম রয়েছে। ‘(শ্রীলঙ্কার) প্রেসিডেন্ট কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বানে কান দেননি। ফলে অবস্থা দিনকে দিন আরও শোচনীয় হচ্ছে,’ বলেন বেলানা।

এরপর কী
শ্রীলঙ্কার সরকারের দাবি অনুযায়ী, তারা অর্থনৈতিক ও মেডিকেল সংকট দুটো থেকেই উত্তরণের চেষ্টা করছে। এ সপ্তাহে এক বিবৃতিতে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)-এর সাথে চিকিৎসাসামগ্রীর তহবিলের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন আলোচনা চালাচ্ছে। এছাড়া বিদেশে অবস্থানকারী শ্রীলঙ্কানদের কাছ থেকে অনুদান পাওয়ারও চেষ্টা করা হচ্ছে।

কিন্তু চিকিৎসকেরা বলছেন, জরুরিভিত্তিতে সহায়তার প্রয়োজন। স্টেইট ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন-এর আমারাসেনা বলেন, সমস্যার সমাধান হওয়ার আগে এটি আরও খারাপের দিকে যাবে। এমনকি বিদেশ থেকে সাহায্য আসতেও কয়েক সপ্তাহ থেকে মাস লেগে যেতে পারে।

তিনি বলেন, কিছু কিছু সাপ্লায়ার কেবল অর্ডার পাওয়ার পরে ঔষধ তৈরি করে। আর শ্রীলঙ্কায় এখন কোনো স্বাস্থ্যমন্ত্রীও নেই। সংকটের কারণে শ্রীলঙ্কার অনেক মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন।

আমারাসেনা বলেন, ‘এসবের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির পক্ষে দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। আমাদের হাতে পর্যাপ্ত সময়ও নেই।’

মেয়ের ভালো চিকিৎসার আশায় ক্যান্ডি প্রদেশ থেকে রাজধানী কলম্বোতে এসেছিলেন সেনেবীরত্নে। কিন্তু এখানে এসেও একই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে তাকে।

মন্দার কারণে চাকরির অবস্থাও বেহাল সেনেবীরত্নের। তাই তার পক্ষে বাইরে থেকেও কোনো ঔষধ আনানো সম্ভব নয়।

একই গল্প মিরুর বাবারও। গ্রামের ধানখেতি ছেড়ে কলম্বো এসেছিলেন সন্তানের চিকিৎসার জন্য। ঔষধের দোকান থেকে শেষ বোতলটি কিনে নেওয়ার সময় বিক্রেতা তাকে বলে দিয়েছেন, স্টকে থাকা এটাই শেষটা।

আর অল্প কয়দিনের ঔষধ বাকি আছে মিরুর জন্য। তারপর আবার তার বাবাকে চারদিকে ছুটে বেড়াতে হবে ঔষধের খোঁজে।

সূত্র: সিএনএন