ভারতকে চাপ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ভট প্রচেষ্টা বন্ধ করতে হবে- নিক্কেই এশিয়ার প্রতিবেদন
![]()
নিউজ ডেস্ক
রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে জোট তৈরি হয়েছে তাতে যোগ দিতে বিভিন্ন দেশকে অনবরত উৎসাহিত করে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এটি দেখে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার একটি বক্তব্যের কথা মনে পড়ে যায়। তিনি একবার বলেছিলেন, পশ্চিমাদের একটি বড় ভুল হচ্ছে যে, তারা মনে করে তাদের শত্রুকে অবশ্যই আমাদেরও শত্রু হতে হবে।
ইউক্রেন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব এবং রাশিয়ার মধ্যে যে রেষারেষি চলছে তাতে কোনো পক্ষই নিতে চাচ্ছে না নন-ওয়েস্টার্ন দেশগুলো। ব্রাজিল থেকে মেক্সিকো কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ইন্দোনেশিয়া, পশ্চিমা নয় এমন অনেক গণতান্ত্রিক দেশই নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেছে। কিন্তু শুধুমাত্র ভারতের নিরপেক্ষতা নিয়েই যত ক্ষোভ বাইডেনের। এর কারণ, ভারত বিশ্বের সবথেকে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বাইডেন প্রথম থেকেই ইউক্রেন ইস্যুকে ‘গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্র’ কিংবা ‘স্বাধীনতা বনাম নিপীড়ন’ যুদ্ধ হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছেন। তাই সবথেকে বড় গণতন্ত্র ভারত যখন এ ইস্যুতে নিরপেক্ষ থাকে তখন তা বাইডেনের এই চেষ্টাকে ছোট করে দেয়।
কিন্তু ইউক্রেনে ভোলোদিমির জেলেনস্কির শাসন কোনো দিক থেকেই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের থেকে কম স্বৈরতান্ত্রিক নয়।
যখনই যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষকে সমর্থন দেয়, তখনই সেই পক্ষ ‘স্বাধীনতার জন্য লড়ছে’ বলে প্রমাণ করতে শুরু করে পশ্চিমারা। এমনকি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত আল-কায়দা ও তালেবানের ক্ষেত্রেও একই অবস্থান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। এখনও সিরিয়ায় যে ইসলামিক স্টেটের উত্থান হয়েছে তাদেরও একসময় আসাদ-বিরোধী হওয়ায় সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেনের কথিত ‘স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের’ অংশ হিসেবে পশ্চিমাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রে ভরে গেছে ইউক্রেন। এছাড়া সেখানে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহের মাধ্যমেও যোগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু অপরদিকে গত দুই বছর ধরে ভারতীয় সীমান্তে চীন যে আগ্রাসন চালিয়ে আসছে তা নিয়ে এখন পর্যন্ত একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি বাইডেন। তার পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে আগ্রাসন চালানো দেশকে ভিক্টিমের সমান বিবেচনা করে বিবৃতি দেয়া হয়েছে, ভারত ও চীনের উচিৎ নিজেদের মধ্যেকার সীমান্ত ইস্যু সমাধানে শান্তিপূর্ণ রাস্তা খুঁজে বের করা।
যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সবথেকে বড় বাণিজ্য সহযোগী রাষ্ট্র। ক্রমেই দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত একটি সম্পর্ক গড়ে উঠছে। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারত কোনো অস্ত্র আমদানি করতো না, সেখানে ২০২০ সালে তা ২০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকেছে।
এখন অন্য যে কোনো দেশের থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বেশি সামরিক মহড়া করে ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যেখানে ভারতের ১৫০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয় সেখানে রাশিয়ার সঙ্গে হয় মাত্র ১২.৮ বিলিয়ন ডলারের! সেখানে নতুন স্নায়ু যুদ্ধে ভারতকে একটি পক্ষ বেছে নিতে যুক্তরাষ্ট্র যে হুমকি দিচ্ছে তা দেশটির সঙ্গে ভারতের এই সম্পর্ককে ছোট করা ছাড়া কিছুই নয়। ভারত বরাবরই আন্তর্জাতিক ইস্যুতে নিরপেক্ষ ছিল। অথচ বাইডেনের শীর্ষ অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ব্রায়ান ডিজ বলছেন, ভারতের এই নিরপেক্ষতার জন্য তাকে যে পরিণতি ভোগ করতে হবে তা হবে ব্যাপক এবং দীর্ঘমেয়াদি।
ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তেহরান-দিল্লি সম্পর্কেও প্রভাব ফেলেছে। বাইডেন এখন তাদের রাশিয়াবিরোধী নিষেধাজ্ঞাকে ব্যবহার করে দিল্লি ও মস্কোর মধ্যেকার ঐতিহাসিক সম্পর্ককেও দুর্বল করতে চাইছেন। ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ভারতকে কম মূল্যে তেল আমদানির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর তারা মার্কিন জ্বালানীর সবথেকে বড় আমদানিকারকে পরিণত করেছে ভারতকে। এই নিষেধাজ্ঞায় সবথেকে বেশি সুবিধা পেয়েছে ভারতের শত্রু দেশ চীন। তারা যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা না মেনেই ইরান থেকে সস্তায় তেল কিনতে পারছে। সাথে সাথে তারা ইরানের সবথেকে বড় নিরাপত্তা সহযোগী রাষ্ট্রেও পরিণত হয়েছে। এখনও ওয়াশিংটন চাইছে এই ইস্যুকে ব্যবহার করে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে নষ্ট করতে। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ভারতকে সেই আহ্বানই জানিয়েছেন। সকল সামরিক চাহিদা মেটাতে যুক্তরাষ্ট্র আছে বলেও জানাচ্ছেন তিনি। ডেপুটি সেক্রেটারি ওয়েন্ডি শেরম্যানও মার্কিন কংগ্রেসে বলেছেন, ভারতে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রির ব্যাপক সম্ভাবনা দেখছে যুক্তরাষ্ট্র।
এসব চাপের মুখে ভারতের তরফ থেকে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, তারা যে অল্প পরিমাণ তেল রাশিয়া থেকে আমদানি করে, তার পরিমাণ আর বাড়ানো হবে না। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর বলেন, আমরা রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করা শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে থাকবো না। কিন্তু তার পরেও ভারতের ওপর থেকে চাপ কমাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র। এটি আসলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং সময়। এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সহযোগিকে ছোট করার কোনো অর্থ হয় না। ভারতের প্রতিবেশীদের অবস্থা খুব একটা ভাল না। শ্রীলঙ্কায় চলছে নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকট। অপরদিকে চীনের নিপীড়নে তিব্বতে আত্মহত্যা বাড়ছে। এরমধ্যে বাইডেন আফগানিস্তানকে তালেবানের হাতে তুলে দিয়েছেন। এ অঞ্চলে পাকিস্তানের শক্তিবৃদ্ধিতে এটি কাজ করবে। একইসঙ্গে নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে মিয়ানমারকেও চীনের কোলে তুলে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এখন রাশিয়াকে শাস্তি দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কার্যত ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তা উদ্বেগ বৃদ্ধি করছে। এরমধ্য দিয়ে চীনের সম্প্রসারণবাদী মনোভাব চাঙ্গা হবে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্বের সবথেকে প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক রাশিয়া এখন ক্ষুধার্ত চীনের পকেটে ঢুকবে। চীন শক্তিশালী হলে তার সবথেকে বড় আঘাত আসবে তার ভারতের মতো প্রতিবেশি দেশগুলো উপরে। জাপান ও অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ছাতার আশ্রয়ে থাকলেও ভারতকে একা একাই চীনকে মোকাবেলা করতে হবে।
(নিক্কেই এশিয়াতে প্রকাশিত ভূ-কৌশলবিদ এবং লেখক ব্রহ্মা চেলানির লেখা থেকে অনূদিত)