র‍্যাবের অভিযানের আগেই কবর থেকে ‘জঙ্গির’ লাশ উধাও - Southeast Asia Journal

র‍্যাবের অভিযানের আগেই কবর থেকে ‘জঙ্গির’ লাশ উধাও

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

বান্দরবানের থানচির গভীর অরণ্যে এক ‘জঙ্গির লাশের কবরের’ খবর পেয়ে অভিযান চালিয়েছে র‍্যাব। তবে সেখানে কোনও লাশ পায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাটি। র‍্যাবের দাবি, অভিযানের আগেই কবর থেকে লাশ তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

র‍্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত ১১ জানুয়ারি (বুধবার) বান্দরবানের থানচি ও রোয়াংছড়ি থেকে র‍্যাবের অভিযানে আটক পাঁচ জঙ্গি তথ্য দিয়েছে, থানচির মিয়ানমার সীমান্তবর্তী রেমাক্রী প্রাংশা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত লউমউলপাড়া সংলগ্ন একটি পাহাড়ি ঝিরির কাছে কু‌মিল্লার নুরুল ইসলা‌মের ছে‌লে আল আমিন নামের এক জঙ্গিকে কবর দেওয়া হয়েছে। গত ২৫ নভেম্বর অসুস্থ হয়ে ওই জঙ্গি কেএনএফ-এর জর্ডান ক্যাম্পে মারা গেলে তাকে পাহাড়ি ঝিরির পাশে কবর দেওয়া হয়। সে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কিয়ার সদস্য।

প‌রে রবিবার (১৫ জানুয়ারি) হেলিকপ্টারযো‌গে সেখানে লাশ উদ্ধারে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু র‍্যাবের সদস্যরা পৌঁছার আগেই কবর থেকে লাশটি তুলে নিয়ে গেছে। তবে ওই কবরের ভেতর ও পাশে কিছু কাপড়-চোপড় ও সন্ত্রাসীদের অস্থায়ী ক্যাম্পের সরঞ্জাম পাওয়ার গেছে। ওই আস্তানা থেকে পাঁচ রাউন্ড গুলিও উদ্ধার করা হয়েছে।

অভিযানের সময় গ্রেফতার জঙ্গি কুমিল্লার সালেহ আহমদ ও শিথিলকে সঙ্গে নিয়ে গেছে র‍্যাব। সেখানে রুমার ইউএনও, পুলিশ র‍্যাব ও সেনাবাহিনী সঙ্গে ছিল। লাশ না পেয়ে তারা ফিরে আসে।

এ বিষয়ে র‍্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘এক জঙ্গির লাশ দুর্গম এলাকায় কবর দেওয়া হয়েছে এ তথ্যের ভিত্তিতেই সেখানে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু কবর থেকে কে বা কারা লাশটি নিয়ে গেছে তা স্পষ্ট নয়। এলাকাটি এতটাই দুর্গম যে সেখানে পৌঁছানো খুবই কষ্টকর। অভিযানের খবর পাওয়ার আগেই হয় তো লাশ কেউ নিয়ে গেছে। এ বিষয়ে আরও খবর নেওয়া হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘গতকাল লউমউলপাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, ওই পাড়া থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি একটি ঝিরির কাছে নতুন সশস্ত্র পাহাড়ি সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) জর্ডান ক্যাম্প নামে একটি আস্তানা গড়ে তুলেছে।’

কেন নিখোঁজ, জানার চেষ্টা করছে র‌্যাব
কথিত হিজরতে যাওয়া ৫৫ তরুণের যে তালিকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৈরি করেছিল, তার মধ্যে সাত জনকে এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানিয়েছে, নিখোঁজ তরুণদের মধ্যে একজনসহ জঙ্গি প্রশিক্ষণের সময় দুই জনের মৃত্যুর খবর জানা গেছে। তবে ‘হিজরতের’ উদ্দেশে ঘরছাড়া মৃত তরুণের লাশও খুঁজে পায়নি র‌্যাব। তদন্তের স্বার্থে কবর খুঁড়ে দেখা গেছে, আগেই তার লাশ উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কারা, কেন এই লাশ উঠিয়ে নিলো তা মাথায় রেখে র‌্যাব তদন্ত চালাচ্ছে।

বাড়ি থেকে বের হয়ে যারা নিখোঁজ হয়েছে, তাদের অনেকেই নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া’র সামরিক শাখায় যোগ দিয়েছে এমন তথ্য পেয়েছে র‌্যাব। যে সাত জনকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে তারা বান্দরবান ও আশপাশের পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান নিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলো বলেও জানা গেছে।

র‌্যাব জানায়, কুমিল্লা থেকে যে আট জন স্বেচ্ছায় তথাকথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল তাদের একজন আলামিন। ২০২২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘জর্দান ক্যাম্পে’ প্রশিক্ষণের জন্য যান তিনি। সেখানে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় গত ২৫ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর সেখানেই জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং পাশেই কবর দেওয়া হয়। সম্প্রতি বান্দরবান পাহাড়ি এলাকায় জঙ্গি সংগঠনের পাঁচ জনকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে এসব তথ্য পায় র‌্যাব।

আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মরদেহটি পরীক্ষার জন্য কবর খোঁড়া হয়। দেখা যায় সেখানে লাশ নেই। আগেই উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কবরে আলামিনের পোশাক ও কম্বল পাওয়া গেছে।

গ্রেফতাকৃতরা জানায়, আলামিন কারও গুলিতে মারা যায়নি। প্রশিক্ষণরত অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে।

মরদেহ সরিয়ে ফেলার বিষয়ে র‌্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, এটি জঙ্গি সংগঠনের একটি মনোভাবের বিষয়। গত ১১ জানুয়ারি অভিযান চালিয়ে পাঁচ জনকে আটক করা হয়। ১৪ জানুয়ারি কবরে সন্ধান চালানো হয়। এই তিন দিনের মধ্যে গ্রেফতারের খবর প্রকাশিত হয়েছে। জঙ্গি সংগঠনের কেউ অথবা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সদস্যরা এই সুযোগে লাশ সরিয়ে ফেলেছে বলে ধারণা করছেন র‌্যাবের কর্মকর্তারা।

র‌্যাব আরও জানায়, জহিরুল ইসলাম ওরফে ডা. আহমেদ আলী নামের একজনও মারা গেছেন জঙ্গিদের ক্যাম্পে। একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী দল নতুন জঙ্গিদের ক্যাম্পে আক্রমণ করেছিল, এসময় গুলিতে তিনি নিহত হন। তিনি মূলত ২০২১ সালের প্রথম দিকে এই জঙ্গি সংগঠনের আমিরের আমন্ত্রণে বয়ান দিতে আসেন এবং জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়ে পড়েন। ২০২১ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে জহিরুল ইসলাম ওরফে ডাক্তার আহমেদ আলীসহ গ্রেফতারকৃতদের সঙ্গে আরও ১২ জন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আসে। নভেম্বর থেকে প্রায় জুন মাস পর্যন্ত তারা কেএনএফ এর রেদলাং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। এই ক্যাম্পে অন্য একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হামলা চালায়। হামলায় জহিরুল ইসলাম নিহত হন। পরে সেই ক্যাম্পের নাম রাখা হয় ‘শহীদ ডা. আহমেদ আলী ক্যাম্প’।

র‌্যাব জানতে পেরেছে, মৃত্যুর পরও আহমেদ আলীর পরিবারের কাছে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠানো হতো প্রতি মাসে। পরিবারও জানতো না তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন।

জানা গেছে, সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) ক্যাম্পে যারা নতুন সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল তাদের ১৪ জনকে এ পর্যন্ত আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এছাড়া নতুন জঙ্গি সংগঠনের ৩৫ জনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তবে যাদের জঙ্গি সংগঠনের মূল নেতা বলা হচ্ছে, তাদের মধ্যে আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ, সামরিক ও মিডিয়া শাখার প্রধান রণবীর, অর্থ শাখার প্রধান রাকিব এবং দাওয়াতি শাখার প্রধান মাইমুন, প্রধান উপদেষ্টা শামীম মাহফুজকে এখনও গ্রেফতার করা যায়নি।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকা থেকে সব শেষ যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল জিজ্ঞাসাবাদে তারা আমাদের পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে, আলামিন প্রশিক্ষণরত অবস্থায় মারা গেছে। তারা সেখানে জানাজা পড়ে তাকে কবর দিয়েছে। তার মরদেহ কবর থেকে কোথায় গেলো সেসব বিষয় আমরা তদন্ত করে দেখছি। অন্যদের গ্রেফতারের চেষ্টাও অব্যাহত আছে।

জঙ্গিদের নতুন সংগঠন কেন
কর্মকর্তারা জানান, নতুন জঙ্গি সংগঠন তৈরির উদ্দেশ্য হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেওয়া। জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া–এই সংগঠনটি এখনও নিষিদ্ধ হয়নি, নিষিদ্ধের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

তারা জানান, যে সব জঙ্গি সংগঠন নিষিদ্ধ অবস্থায় আছে সেগুলোর নামে প্রচার-প্রচারণা বা সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নতুনের জঙ্গি সংগঠনের বেশিরভাগ সদস্যরা আনসারুল ইসলামের সদস্য। হুজি ও জেএমবি থেকেও এসেছে অনেকে। পুরনো জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের সমন্বয় এবং যোগাযোগ শুরু হয়েছিল আদালত চত্বর থেকে। হাজিরা দেওয়া আসামিদের সঙ্গে বাইরে থাকা জঙ্গিদের দেখা সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হতো আদালত চত্বরে। ২০১৭ সাল থেকে তাদের মধ্যে এই যোগাযোগ শুরু হয়। পরবর্তীতে তারা নিজেরা সংঘবদ্ধ হয়ে যোগাযোগ বাড়িয়ে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনটি তৈরি করেছে।

সূত্র আরও জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সঙ্গে চুক্তিতে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হছিল। সেখানে তারা নতুন সংগঠনের নামটি ব্যবহার করেছিল।

নতুন জঙ্গি সংগঠনের গ্রেফতার হওয়া সদস্য এবং কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়াদের জিজ্ঞাসাবাদের পর র‌্যাব জানায়, জঙ্গি সংগঠনের টার্গেট কী এটা প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীরা জানতো না। তাদের অনুমান, কোনও সহিংসতা বা নাশকতা চালানোর জন্য তাদের প্রস্তুত করা হচ্ছিল। তাদের সংগঠনের বিভিন্ন শাখায় ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। কাউকে বোমা বিশেষজ্ঞ দলেও দেওয়া হয়েছিল।

বর্তমানে বান্দরবানের থানচি, রুমা ও রোয়াংছড়িতে র‍্যাব ও সেনাবাহিনীর জঙ্গি ও সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান চলছে। গত অক্টোবর থেকে এই অভিযান শুরু হয়। এই তিনটি উপজেলায় দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে প্রশাসন।