রোহিঙ্গা সমস্যা : কোনো উদ্যোগই সফল হচ্ছে না কেন - Southeast Asia Journal

রোহিঙ্গা সমস্যা : কোনো উদ্যোগই সফল হচ্ছে না কেন

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

সৈয়দ ফারুক হোসেন

বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা ঝুঁকি এড়াতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে শিগগিরই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোহিঙ্গারা যাতে দ্রুত মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারে, তা নিশ্চিত করতে বিশ্বকে অবশ্যই গুরুত্বসহকারে কাজ করতে হবে বলে আবারও তিনি জানান। এ ছাড়া তিনি বলেন, অন্যথায় সংকট থেকে তৈরি নিরাপত্তা ঝুঁকি শুধু আমাদের সীমানায় সীমাবদ্ধ থাকবে না। এ অঞ্চলের জন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো এটিকে অবাধ, উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করা।

নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের একটি দলকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত যেসব খবর পাওয়া গেছে, এতে প্রাথমিকভাবে কাজটি সফলভাবে করা গেছে। সামগ্রিকভাবে রোহিঙ্গা সংকট ও শরণার্থী ব্যবস্থাপনার কিছু দিক নিয়ে তিনি আলোকপাত করেন। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে, রোহিঙ্গা সমস্যার দায় কোনোভাবেই বাংলাদেশের নয়। নির্যাতন ও নিপীড়নের মুখে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে মানবিক আচরণ দেখিয়েছে, তা বিশ্বসম্প্রদায়ের দৃষ্টি কেড়েছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি সাময়িক এবং যত দ্রুত সম্ভব তাদের নিরাপদে, প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাসহ মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোই বাংলাদেশের লক্ষ্য। বাস্তবতা হচ্ছে, ওই উদ্যোগে সফলতা নেই এবং বোঝা যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে সময় লাগবে। ফলে বাংলাদেশকে কিছু ব্যবস্থাপনাগত উদ্যোগ নিতে হয়েছে এবং রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে ভাসানচরে পাঠানো এরই অংশ।

মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর হত্যাযজ্ঞ ও বর্বরতা চালিয়েছে, নারীদের ধর্ষণ করেছে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে। এটি পরিষ্কার, জাতিগত নির্মূলের পরিকল্পিত লক্ষ্য নিয়েই মিয়ানমার সরকার এ কাজটি করেছিল। শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সরকারের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দিয়ে একটি বড় আঞ্চলিক সংকট এড়াতে সাহায্য করেছে বাংলাদেশ। চীনের মধ্যস্থতায় চলতি মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর প্রচেষ্টা করতে চাইছে বাংলাদেশ। এ কারণে রোহিঙ্গাদের আগেই রাখাইনে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানোর প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। আগে এই প্রস্তাব নাকচ করেছিল মিয়ানমার। বাংলাদেশ চাইছে, মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন হোক রোহিঙ্গারা। সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা করা হচ্ছে। এর আগে সেখানে প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছে কিনা, তা দেখতে চাইছে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি দল। প্রসঙ্গত, এর আগে চীনের মধ্যস্থতায় দুইবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা সত্ত্বেও শেষ মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের কারণে প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়নি। আধুনিক এই বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ বিষয় হলো বিপুলসংখ্যক একটি জনগোষ্ঠী নিজ ঘরবাড়ি ও দেশ ছেড়ে অন্য কোনো দেশে বাস্তুচ্যুত জীবনযাপন করছে। আর এই বাস্তুচ্যুতরাই সবচেয়ে বেশি সংকটে ভুগছে। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে রাজনৈতিক, সামরিক, জাতিগত ও মতাদর্শের নানা সংকট মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে জাতিগত পরিচয় এবং বেঁচে থাকার অধিকার।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বের নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছিলেন। এই মানবিক সিদ্ধান্ত ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের জনগণের নিজস্ব বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এবং বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নীতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রহণ করা হয় বাংলাদেশের এ সংগ্রাম, শান্তি ও ন্যায়বিচারের জন্য সর্বজনীন লড়াইয়ের প্রতীক। প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের জন্য যে কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, তা বিশ্বের আর কোনো দেশ বা কোনো নেতাই গ্রহণ করতে সক্ষম হননি। এই বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তাদের আশ্রয় দিয়ে এবং তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত তিনি লড়াই করে যাচ্ছেন। বাঙালি জাতির জন্য তার সব ত্যাগ স্বীকার করে চলেছেন। যেমনটি করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পিতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণের জন্য সব সময় কাজ করে যাচ্ছেন এবং বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ পারে আশ্রয়হীনদের আশ্রয় দিতে ও তাদের পাশে দাঁড়াতে।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। বাংলাদেশ তাদের জন্য সাধ্যমতো বসবাসের ব্যবস্থা করেছে ভাসানচরে। এদিকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে তাদের জন্য নির্মিত নতুন বাড়ি বা বসতিতে থাকতে চায় না রোহিঙ্গারা। অনেকটা বাংলাদেশের ভাসানচরের মতোই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য বসতি স্থাপন করেছে সেখানে। তবে রোহিঙ্গারা এটিকে ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ আখ্যা দিয়ে বলেছেÑ ‘আমরা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নয়, ঘরে ফিরতে চাই।’ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুতে যে গ্রামগুলো থেকে রোহিঙ্গারা পালিয়েছিল, তা আর আগের অবস্থায় নেই। কিন্তু রোহিঙ্গাদের দাবি, তারা ঠিক সেখানেই ফিরবেÑ যেখানে এক সময় তাদের বাস ছিল। রাখাইনে গিয়ে নিজেদের গ্রাম দেখে রোহিঙ্গারা মত দিয়েছেন, তা আর আগের মতো নেই। যেখানে থাকতেন, ঠিক সেখানেই আবার ফিরতেন চান তারা। যেহেতু মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করা হবে, সেহেতু তাদের সরেজমিন অভিজ্ঞতা প্রত্যাবাসন কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ।

সম্প্রতি রোহিঙ্গা সংক্রান্ত মানবিক সংকটের মোকাবিলায় বাংলাদেশে ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা ২০২৩ চালু করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থান দেওয়া কোনো স্থায়ী সমাধান নয়, বরং এটি একটি সাময়িক আশ্রয়। সর্বোপরি রোহিঙ্গারা যেন তাদের নিজেদের দেশে, নিজেদের গৃহে ফিরতে পারেÑ এ জন্য আন্তর্জাতিক মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গাদের রাখাইনে তাদের নিজ বাসভূমে সম্মানের সঙ্গে প্রত্যাবর্তন করতে ব্যর্থতার অর্থ হবে প্রকারান্তরে মিয়ানমারের অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের একাধিক উদ্যোগ, দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উদ্যোগ দৃশ্যত। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় যে প্রতিনিয়ত নতুন হুমকি বাড়ছে, এতে সন্দেহ নেই। তবু রোহিঙ্গা শিবিরে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে পড়ছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল অস্থিতিশীল ও নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতেই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে যে কোনো উপায়কে উপেক্ষা করা যায় না। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত এই রোহিঙ্গাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন সময়ে নানা মত দিয়ে আসছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি এই রোহিঙ্গা সমস্যার। কোনো উদ্যোগেই কাজ হয়নি, বরং বাংলাদেশের ওপরেই চাপ বেড়েছে বহুগুণ। অথচ বাংলাদেশ ছোট্ট একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসাÑ সব ব্যবস্থা করে আসছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।

আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের শরণার্থী, একই সঙ্গে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য যে মানবিকতা দেখিয়েছেনÑ তা বিশ্ববাসীর কাছে একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। আজ বিশ্বদরবারে তিনি ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ বা ‘মানবতার মা’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। তার কূটনৈতিক সাফল্যে এই রোহিঙ্গা প্রতাবর্তনও শুরু হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর প্রতিও অনুরোধ থাকবে, বৈশ্বিক এই সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের পাশে থাকুন। জয় হোক মানবতার জননী শেখ হাসিনার। মিয়ানমার থেকে লাখো নির্যাতিত-নিপীড়িত নারী-পুরুষ-শিশু সবাই যখন জীবন বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে ছিল, তখন আমাদের জননেত্রী শেখ হাসিনা ও মাদার অব হিউম্যানিটি আশ্রয় দিয়ে তাদের জীবন রক্ষা করেছিলেন।

সৈয়দ ফারুক হোসেন : রেজিস্ট্রার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, জামালপুর