শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী - Southeast Asia Journal

শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অবসরপ্রাপ্ত)

শ্রাবণের রোদেলা সকালে ঢাকা বিমানবন্দরে একদল চৌকস সেনা অফিসার কুয়েত এয়ারওয়েজের একটি বিমানে কুয়েত হয়ে বাগদাদ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। লে. কর্নেল ফজলে এলাহী আকবরের (পরে মেজর জেনারেল ও সুদান মিশনে ফোর্স কমান্ডার) নেতৃত্বাধীন সামরিক পর্যবেক্ষক দলটি ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধের জন্য গঠিত শান্তিরক্ষী মিশন ‘ইউনাইটেড নেশনস ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভার গ্রুপ’ (ইউনিমগ)-এ যোগদানের পথে। এটিই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম জাতিসংঘ শান্তি মিশন।

তাঁদের হৃদয়ে প্রিয়জন ও মাতৃভূমি ছেড়ে যাওয়ার বেদনা, চোখে মধ্যপ্রাচ্যের বিস্ময়।

আর রয়েছে নতুন গন্তব্যের রহস্যময়তা ও রোমান্টিকতা। কিন্তু তাঁরা কেউ জানেন না, সেনাবাহিনী তথা বাংলাদেশের জন্য কী অসাধারণ এক কীর্তির মাইলস্টোন স্থাপন করতে যাচ্ছেন। বিমানটি নীল আসমানে উড়াল দিলে বিশাল মেঘের ভেলার দিকে তাকিয়ে কর্নেল তাঁর নতুন চ্যালেঞ্জের কথা ভাবতে থাকেন…।

মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরেক মহৎ অর্জন হলো শান্তি রক্ষা মিশনে (পিস কিপিং অপারেশন) অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সামরিক কৃতিত্ব ও অর্জনগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আজ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক বছর ধরে বাংলাদেশ শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনী দেশের ভেতরে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে, যেমন—দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করেছে, তেমনি বিদেশে পেশাদারি ও নিবেদিতপ্রাণ মনোভাবের মাধ্যমে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে বিদেশিদের মন জয় করেছে।

জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে ১৯৮৮ সালে (ইউনিমগ) সেনাবাহিনীর পদযাত্রা শুরু। বাংলাদেশ পুলিশ ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ পরিবারের সদস্য হয় নামিবিয়া শান্তি মিশনের (ইউনিকম) মাধ্যমে।

বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী শান্তি মিশনে (বসনিয়া) যোগ দেয় ১৯৯৩ সালে।

বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এরই মধ্যে জাতিসংঘের বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। পরিবর্তিত বিশ্বের ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা বিচক্ষণতা, পেশাদারি এবং বুদ্ধিদীপ্ত উপায়ে সংশ্লিষ্ট দেশের স্থানীয় প্রশাসনকে সর্বদা সহায়তা করে যাচ্ছে। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বিশ্বে একটি সুন্দর ও বসবাস উপযোগী সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলার শান্তিসেনারা একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত (২০২৩) ৪০টি দেশে জাতিসংঘের ৫৬টি শান্তি মিশনে বাংলাদেশের এক লাখ ৮৮ হাজার ৫৫৮ জন শান্তিরক্ষী অংশগ্রহণ করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীর সংখ্যা এক লাখ ৫১ হাজার ৯৩০। বর্তমানে মোট ছয়টি দেশে সর্বমোট ছয়টি মিশনে ছয় হাজার ৪৩ জন সেনা সদস্য নিয়োজিত আছেন। নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশসহ মোট শান্তিরক্ষীর সংখ্যা বর্তমানে সাত হাজার ৪৪৬। যে দেশগুলোতে শান্তি মিশন চলছে সেগুলো হলো—আবেই (সুদান), সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, মালি, সাউথ সুদান, ডিআর কঙ্গো ও ওয়েস্টার্ন সাহারা।

শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীবর্তমানে জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীর সদস্য সংখ্যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তের দুর্গত-নিপীড়িত ও নিরীহ মানুষের সেবায় এই শান্তিসেনাদের হাত সর্বদা প্রসারিত। সংঘাতপূর্ণ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজের জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়েও তাঁরা আর্তমানবতার সেবা করে চলেছেন। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৩১ জন বীর সন্তান নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং ২২৮ জন সদস্য পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। তাঁদের এই ত্যাগ বিশ্বশান্তি রক্ষায় বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে। আমাদের শান্তিসেনাদের এই আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কথা বিশ্বশান্তি রক্ষার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা মিশন এলাকায় বিবদমান দলকে নিরস্ত্রীকরণ, মাইন অপসারণ, সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়তা দান, সড়ক ও জনপথ এবং স্থাপনা নির্মাণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। সেনাবাহিনী প্রায় ২০০ আর্মাড পারসোনাল ক্যারিয়ার, অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক যানবাহন নিয়ে তাদের অপারেশন পরিচালনা করছেন। মাঠ পর্যায়ে শান্তি রক্ষা অভিযানে অংশগ্রহণের পাশাপাশি জাতিসংঘ সদর দপ্তরের ডিপার্টমেন্ট অব পিস কিপিং অপারেশনেরও স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সেনা কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করে থাকেন। ৩৫ বছর ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা অসামান্য সাফল্যের ইতিহাস তৈরি করেছেন। কম্বোডিয়া, সাবেক যুগোস্লাভািয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো, আইভরি কোস্ট, সিয়েরা লিওন, দক্ষিণ সুদান, লাইবেরিয়া, মালি ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের জটিল ও চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে বাংলার সাহসী শান্তিসেনারা পেশাদারি ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে সেসব দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে।

শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশ একটি ‘ব্র্যান্ড নেম’। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা স্বাগতিক দেশের জনগণের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে সর্বদা সচেষ্ট। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা বিদেশের বৈরী পরিবেশে নিজেদের খাপ খাইয়ে প্রদত্ত সব দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করে থাকে। আমাদের শান্তিসেনাদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও কাজ, মানবিক গুণাবলি, শৃঙ্খলা এবং স্থানীয় জনগণের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এই সুনামের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে। প্রতিটি সেনা সদস্য সেখানে দেশের একেকজন প্রতিনিধি, শান্তিদূত।

আইভরি কোস্টে স্থানীয় জনগণ তাদের একটি গ্রামের নাম রেখেছে ‘রূপসী বাংলা’। হাইতিতে একটি শিশুর নাম ‘বাংলাদেশ’। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের নামে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে, যা শান্তিরক্ষীদের প্রতি দেশগুলোর জনগণের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ মৈত্রী স্কুল, বাংলাদেশ সেন্টার। সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি ও প্রাপ্তি হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর সাধারণ মানুষের মুখে ফুটিয়ে তোলা হাসি ও তাদের ভালোবাসা।

শান্তিরক্ষী হিসেবে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের নারী সদস্যদের কর্মকাণ্ড বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের দুই হাজার ৭২৮ জন নারী শান্তিরক্ষী শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ করেছেন। ২০০০ সালে পূর্ব তিমুরের শান্তি মিশনে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ পুলিশের একদল নারী শান্তিরক্ষী দায়িত্ব পালন করেন। হাইতিতে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ মহিলা পুলিশ কন্টিনজেন্ট প্রেরণ করে ২০১০ সালে। উল্লেখ্য, ২০০৯ সাল থেকে সশস্ত্র বাহিনীর নারী সদস্যরা জাতিসংঘ মিশনে অংশগ্রহণ করে আসছেন। বর্তমানে সশস্ত্র বাহিনীর ৩৮৮ জন নারী সদস্য মিশন এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন।

শান্তিরক্ষী ও বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট পাঠিয়ে বাংলাদেশ প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। এটি এখন বাংলাদেশের আয়ের খাত। ‘শান্তি রক্ষা কূটনীতি’ এখন জাতীয় কূটনীতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক শান্তিরক্ষীই বিদেশে বাংলাদেশের শান্তিদূত। ‘পিস কিপিং’ এখন বাংলা সাহিত্যে লেখালেখির নতুন ও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়।

বিবর্তনের ধারায় পিস কিপিংয়ে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে ইন্ট্রিগ্রেটেড অথবা মাল্টি-ডাইমেনশনাল শান্তি রক্ষা মিশনগুলো দিন দিন জটিল ও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। শান্তি রক্ষা মিশনের ধরনে যে আবশ্যিক পরিবর্তন ও চাহিদা আগামী সময়ে দৃশ্যমান তা বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জগুলো কী ধরনের হতে পারে এবং তার মোকাবেলা কিভাবে করতে হবে তার জন্য বিস্তারিত ও খোলামেলা আলোচনা প্রয়োজন।

জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনের নিরাপত্তা এবং কৌশলগত পরিবেশ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। অপ্রতিসম হুমকির উত্থান, রাষ্ট্রবিরোধী সদস্য ও সংগঠনের উপস্থিতি, কভিড-১৯ মহামারির কারণে বিঘ্নিত পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তনে বৈশ্বিক প্রভাব, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং তথ্য যোগাযোগ বিপ্লব জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা পরিস্থিতিকে বহু গুণ জটিল করে তুলেছে। ফলে শান্তিরক্ষীরা নিজেরাও নানা আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের শান্তি রক্ষা কন্টিনজেন্টগুলোর সাংগঠনিক কাঠামো ও কার্যপদ্ধতির পরিবর্তন জরুরি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

আজ ২৯ মে বিশ্ব শান্তিরক্ষী দিবস। এই দিন শান্তিরক্ষী কার্যক্রমে আমাদের গর্বিত অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আজ বাংলাদেশ সবার কাছে শান্তি স্থাপনকারী বীরের দেশ হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে। আজকের দিনে আমরা সেই সব বীরকে স্মরণ করি, যাঁদের আত্মত্যাগের ফলে শান্তি রক্ষা সম্ভব হয়েছে এবং বাংলাদেশ বিশ্বে তার অবস্থান সমুজ্জ্বল করতে পেরেছে। বর্তমানে শান্তি রক্ষা মিশনে কর্মরত সব গর্বিত শান্তিরক্ষীর জন্য রইল প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক
bayezidsarwar792@gmail.com