শান্তির দূত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান
বিশ্বশান্তি রক্ষায় অহংকার ও গৌরবের ইতিহাস বহনকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর ‘ইমেজ’ ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ করার অপতৎপরতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। দেশের প্রতিটি দুর্যোগ বা সংকটে সেনাবাহিনী অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে। দেশের মানুষও তাদের ওপর যথেষ্ট সন্তুষ্ট এবং আস্থাশীল। কিন্তু দেশবিরোধী ভয়ানক সাইবার দুর্বৃত্তরা যেন ফেসবুক ও ইউটিউবে অসত্যের দোকান খুলে বসেছে। বিশ্লেষক নামধারী এই সাইবার দুর্বৃত্তরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ‘টার্গেট’ করে দিব্যি মনগড়া ও ভুল তথ্যের প্রবাহ সৃষ্টি করার অপচেষ্টা করছে। তারা অবাস্তব, অসত্য, বানোয়াট ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করছে এবং গুজব ছড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। মূলত একটি চিহ্নিত অপশক্তির টু-পাইস ফর্মুলায় তারা বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন বন্ধের হীন চক্রান্ত করছে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাকে কুণ্ডতর্ক শুরু করেছে। অসত্য তথ্য-উপাত্ত ছড়িয়ে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি চক্রটির সঙ্গী হয়েছে বৈশ্বিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সম্প্রতি জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হওয়ার বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে এ সংগঠনটি নিজেদের বিতর্কিত ভূমিকাকে আরো একবার মোটা দাগে সামনে এনেছে। অথচ জাতিসংঘের হয়ে বিশ্বের দেশে দেশে শান্তির পতাকা ওড়ানোর কাজে শ্রেষ্ঠত্বের অনুপম নজির স্থাপন করে শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে ১২২টি দেশের মধ্যে এক নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা বাংলাদেশ।
সাইবার দুর্বৃত্ত চক্রের এসব কার্মকাণ্ডকে সরকারবিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এর মাধ্যমে মূলত সেনা সদস্যদের উসকে দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার অনুকূলে প্রলুব্ধ করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে দীর্ঘ চার দশকের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সফল অগ্রযাত্রাকে। এই সাইবার দুর্বৃত্ত চক্রের এ ধরনের ভূমিকায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছেন স্বাধীনতার সপক্ষের প্রতিটি বিবেকবান মানুষ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেটিজেনরাও।
তারা বলছেন, ‘দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। দেশের সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সংকট মোকাবিলায় সব সময়ই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সর্বোচ্চ পেশাদারি, দক্ষতা ও নিষ্ঠার দৌলতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্লু হেলমেটধারীদের “মজ্জা” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। গৌরব-অহংকারের বাহিনীটিকে নিয়ে সব ধরনের অপপ্রচার আমরা ঘৃণাভরেই প্রত্যাখ্যান করছি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতি একটি রাজনৈতিক দল তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে পোস্ট করেছে, যা ন্যক্কারজনক। এই রাজনৈতিক দলটি এভাবে কার্যত নিজেদের রাষ্ট্রদ্রোহের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে।’
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বরাবরই গণতন্ত্রের পক্ষে সাহসী ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের সেনাবাাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনী এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে পেশাদার ও বিশ্বমানের। নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে তারা দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক হয়ে আছেন। তাদের কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই। কোনো ধরনের বিভ্রান্তির প্রলোভনে তারা গত দুই যুগে পা দেয়নি।
কিন্তু দেশে একটি রাজনৈতিক দুর্যোগকে স্বাগতম জানাতে স্পষ্টতই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করতে দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করতে ফন্দিফিকির করছে কেউ কেউ। এজন্য তারা সেনাবাহিনীকে টার্গেট করে জলঘোলা করার সব আয়োজন করেছে। এরা মূলত স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্রের পোষ্য। তারা ওই চক্রটির কথায় ওঠে-বসে। সরকারকে নাস্তানাবুদ করার অপকৌশল হালে পানি না পাওয়ায় এখন তারা দেশের স্বাধীনতাণ্ডসার্বভৌমত্বের প্রতীক সেনাবাহিনীকে উসকে দেওয়ার সব ধরনের হীন অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু টেকসই গণতন্ত্র, উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার প্রশ্নে দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যদের অটল মনোভাব প্রমাণ করেছে শেষ পর্যন্ত কোনো বড় ধরনের রাজনৈতিক দুর্যোগ বাংলাদেশে আঘাত হানতে সক্ষম হবে না।
দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি গত ৫২ বছরে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ অবদানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, ‘দেশব্যাপী অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণে সেনাবাহিনী আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও পেশাগত দক্ষতায় বলীয়ান হয়ে দেশের প্রতিরক্ষা ও দেশ গড়ার কাজে আরো বেশি অবদান রাখবেন।’
বিশ্বের সব প্রান্তের দুর্গত, নিপীড়িত ও নিরীহ মানুষের সেবায় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের হাত প্রসারিত। সংঘাতপূর্ণ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজের জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়েও তারা আর্তমানবতার সেবা করে চলেছেন। দেশ ও বিদেশে নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে স্বীয় দক্ষতা ও পেশাদারির জন্য সব মহলের প্রশংসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের সফল যাত্রাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাম্প্রতিক দুরভিসন্ধিমূলক অবস্থানে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এর আগেও আন্তর্জাতিক মহলে লবিং করে টাকা ঢেলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছিল জামায়াতে ইসলামীসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক মহল।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, ‘বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী অ্যাটলিস্ট পিস কিপিংয়ে যে পেশাদারি এখন পর্যন্ত দেখিয়ে এসেছে, যার জন্য এ বছরও নাম্বার ওয়ান পিসকিপার হিসেবে তারা আছে। কোনো একটা দেশ মনে করলেই একেবারে পিস কিপিং চলে যাবে তাও আবার এই গণতন্ত্র, এসব কারণে, তাহলে তো চীন কখনো পিস কিপিং ফোর্স হতে পারত না।’
একই বিষয়ে সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) মো. আলী শিকদার বলেন, ‘লবিস্ট নিয়োগ করে করে টাকা বিনিয়োগ করে এ ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি আদায় করা কিন্তু এখন কঠিন কাজ নয় এবং এটা শুধু আজকে নয় বিগত দিনেও হয়েছে। অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে ২০০৭ সালেও সেনাবাহিনীবিরোধী অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। তখনকার কুশীলবরাও এর পেছনে জড়িত কি না তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।’
সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর (অব.) নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘সেনাবাহিনীর সদস্যদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যাওয়ার বিরুদ্ধে যখন তারা কথা বলে তখন আমাদের খুব ভাবতে হয়। আসল পরিকল্পনাটা কী? সেনাবাহিনীকে উসকে দেওয়া, সেনাবাহিনীর বদনাম করা এবং শেষ বিচারে সেনাবাহিনীকে সরকারের বিরদ্ধে অবস্থান নিতে প্রলুব্ধ করা- এটার পরিণতি কখনো ভালো হবে না।’
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও বিশ্লেষক