রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কতদূর? - Southeast Asia Journal

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কতদূর?

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান অবস্থায় গাজায় ইসরাইলের নৃশংস হামলা শুরু হয়েছে আর একই সঙ্গে বাড়ছে নিরীহ সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ। সারা বিশ্বের মনোযোগ এখন গাজার নির্মম ভয়াবহতার দিকে। এভাবেই পৃথিবীতে শান্তির বদলে একের পর এক প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভোগ লেগেই রয়েছে। দিনদিন দুর্ভোগের তীব্রতা বেড়েই যাচ্ছে, কিন্তু আগের চলমান সমস্যাগুলোর সমাধান হচ্ছে না। এর ফলে একটু পুরোনো হয়ে যাওয়া সমস্যা নতুন সমস্যার পেছনে চলে যাচ্ছে এবং সেসব সমস্যা মনোযোগ ও গুরুত্ব হারাচ্ছে। মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতা চলমান এবং বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকটে বিপর্যস্ত। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও সমস্যার সমাধান না হওয়ায় এগুলো নতুন সমস্যার আবর্তে পিছিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হওয়ার আগে বিশ্বকে তা কোনোভাবেই ভুলতে দেওয়া যাবে না।

মিয়ানমারের সামরিক সরকার পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং চলমান সংঘাতের মধ্যে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে শান্তি স্থাপনের জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৫ অক্টোবর সামরিক সরকার বহুপক্ষীয় যুদ্ধবিরতি চুক্তি (এনসিএ) স্বাক্ষরের অষ্টম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানায়। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর এ অনুষ্ঠানটি ছিল সামরিক সরকার এবং জাতিগত সংখ্যালঘু নেতাদের সঙ্গে প্রথম এ ধরনের আনুষ্ঠানিক সমাবেশ।

২০১৫ সালের অক্টোবরে আটটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী এনসিএ স্বাক্ষর করে, পরবর্তীকালে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরও দুটি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী সু চির বেসামরিক সরকারের অধীনে যুদ্ধবিরতিতে যোগ দেয়। সব মিলে ১০টি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী বিদ্রোহের অবসানের একটি পদক্ষেপ হিসাবে চুক্তিটি সম্পাদিত হয়েছিল। সামরিক সরকার গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বিরোধীদের দ্বারা দেশব্যাপী সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছে। জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর একটি জোট চীন সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় সামরিক লক্ষ্যবস্তু দখল করতে উত্তর-পূর্ব মিয়ানমারে একটি সমন্বিত আক্রমণ শুরু করেছে। সামরিক বাহিনীও জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলগুলোতে পালটা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।

এ অনুষ্ঠানে ডেমোক্রেটিক কারেন বৌদ্ধ আর্মি, কেএনইউ/কেএনএলএ পিস কাউন্সিল, পা-ও ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি, আরাকান লিবারেশন পার্টি, শান স্টেটের রিস্টোরেশন কাউন্সিল, নিউ মন স্টেট পার্টি, লাহু ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নসহ সাতটি স্বাক্ষরকারী গোষ্ঠী তাদের প্রতিনিধি পাঠায়। তবে বর্তমান সেনাসমর্থিত শাসনের বিরোধিতাকারী কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন, চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবং অল বার্মা স্টুডেন্টস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-এ তিনটি স্বাক্ষরকারী দল অনুষ্ঠানটি বয়কট করে।

এ অনুষ্ঠানকে সফল করার লক্ষ্যে সামরিক সরকার সামরিক শাসনবিরোধী জোটকে দুর্বল ও বিভক্ত করার জন্য ২০২২ সালের মে মাস থেকে জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে একের পর এক শান্তি আলোচনার আয়োজন করে। মিয়ানমারে ২১টি প্রতিষ্ঠিত জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন রয়েছে, এর মধ্যে কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি এবং ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মিসহ কয়েকটি বড় এবং সবচেয়ে শক্তিশালী গোষ্ঠী যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে সমর্থন করেনি। এ তিনটি দল গণতন্ত্রপন্থি পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) সঙ্গে জোট করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। গ্রুপ তিনটি এক যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা করেছে, চুক্তিটি আর বৈধ নয় এবং সরকার চলমান সহিংসতা বন্ধ না করা পর্যন্ত তারা এনসিএ শান্তি আলোচনায় যোগ দেবে না। এর কারণ হিসাবে তারা জানায়, সামরিক বাহিনী চুক্তির মূল নীতিগুলোকে অগ্রাহ্য করে বারবার বেসামরিক এলাকা দখল ও বেসামরিকদের লক্ষ্য করে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা রাজনীতি থেকে সেনাবাহিনীর প্রত্যাহার, ফেডারেল গণতন্ত্র বাস্তবায়ন এবং দেশের সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততার গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার দাবি জানায়।

দেশব্যাপী যুদ্ধবিরতি চুক্তির অষ্টম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রতিরক্ষা বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং তার বক্তব্যে আট বছর আগে এনসিএতে অংশ নেওয়া জাতিগত নেতাদের যারা চুক্তি স্বাক্ষরে অবদান রেখেছিলেন, তাদের সবাইকে আন্তরিক ও উষ্ণ শুভেচ্ছা জানান। এনসিএ অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দলের ৩৫ সদস্য, বেসরকারি সংস্থার ১১ কর্মকর্তা এবং ৩২ কূটনীতিক অংশগ্রহণ করেন। থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপমন্ত্রী, ভারতের উপজাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বিক্রম মিসরি এবং এশিয়ানবিষয়ক চীনের বিশেষ দূত দেং জিজুন এ চুক্তির পক্ষে সমর্থনমূলক মন্তব্য করেছিলেন। থাইল্যান্ড মিয়ানমারের জাতীয় যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং এ চুক্তিকে মিয়ানমারের জন্য শান্তি প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসাবে বিবেচনা করছে। থাইল্যান্ড বিশ্বাস করে, যে কোনো দেশে শান্তির পথ তার নিজস্ব জনগণ দ্বারা নির্ধারণ করা উচিত।

প্রতিবেশী দেশ হিসাবে বাংলাদেশও চায় মিয়ানমারে শান্তি ফিরে আসুক এবং একই সঙ্গে চলমান রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হোক। কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নেওয়া সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার পাশাপাশি প্রতিবছর ৩৩ হাজার করে রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হচ্ছে। গত ছয় বছরে প্রায় দুই লাখ শিশু জন্ম নিয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুন, অপহরণসহ সব ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে দেড় শতাধিক অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী সক্রিয় রয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫ হাজার রোহিঙ্গাকে আরসার সদস্য করা হয়েছিল, যাদের অধিকাংশই এখন আরসা ছেড়ে আসছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে ৭৩ জন আরসার অস্ত্রধারী সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত হওয়ায় আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা তরুণরা মাদক চোরাচালান, সন্ত্রাসে জড়াচ্ছে, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করার মধ্য দিয়েই এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব।

বর্তমানে চীনের মধ্যস্থতায় পাইলট প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ১৭৬ জন রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের টেকনাফে পাঁচটি ট্রানজিট কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। নভেম্বরের মধ্যে কেন্দ্রগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হলে ডিসেম্বরে প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে। ক্যাম্প থেকে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের প্রথমে ট্রানজিট কেন্দ্রে আনার পর প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা হবে। নিরাপদ বসবাসের নিশ্চয়তা পেলে মিয়ানমারে ফিরতে রাজি অধিকাংশ রোহিঙ্গা। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে যে কোনো সময় এ প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে এবং স্থলপথ ও নাফ নদীপথে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চলবে।

যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা সংকটে সহায়তা প্রদানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তার ১৭ অক্টোবর উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির পরিদর্শন করে জানান, যুক্তরাষ্ট্র জোর করে প্রত্যাবাসনে আগ্রহী নয়। মিয়ানমারে অনুকূল পরিবেশ তৈরির পরই কেবল স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্র নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করছে।

মিয়ানমার সরকারের কাছ থেকে রাখাইনে নিরাপদে থাকার নিশ্চয়তা পেলে রোহিঙ্গারা দ্রুত মিয়ানমারে ফিরতে চায়। কিন্তু এখন যে প্রক্রিয়ায় প্রত্যাবাসন শুরু হতে যাচ্ছে, তাতে ১২ লাখ রোহিঙ্গার মিয়ানমারে ফিরে যেতে বহু বছর লাগবে। রোহিঙ্গারা একসঙ্গে বড় দলে ফিরলে রাখাইনে ভালোভাবে থাকতে পারবে বলে মনে করে অনেক রোহিঙ্গা। ভবিষ্যতে যাতে তাদের নিপীড়নের শিকার হয়ে পুনরায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে না হয়, সেই নিশ্চয়তাও চায় রোহিঙ্গারা। চলমান প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও গ্রহণযোগ্য করতে এর সঙ্গে ইউএনএইচসিআর ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোকেও সম্পৃক্ত করা দরকার বলে অনেকে মনে করেন।

মিয়ানমারে গণতন্ত্র ও শান্তি ফিরিয়ে আনতে গণতন্ত্রকামী দলগুলো এবং প্রতিবেশী দেশ ও আঞ্চলিক সংস্থাগুলোকে সঙ্গে নিয়ে গঠনমূলক ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া গেলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। বাংলাদেশ সবসময় চায় মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক। একইসঙ্গে বাংলাদেশ আশা করে, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের দাবিগুলো মেনে নিয়ে রাখাইনে তাদের স্থায়ী ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় করার মাধ্যমে এ অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্রিয় অবদান রাখবে।

লেখক: মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক