ভারতীয় উপমহাদেশে উপজাতিদের মধ্যে ১ম রাষ্ট্রদূত খাগড়াছড়ির মুকুর কান্তি খীসার জীবনধারা

ফিচার ডেস্ক
ভারতীয় উপমহাদেশে উপজাতিদের মধ্যে ১ম রাষ্ট্রদূত মুকুর কান্তি খীসা। যিনি ১৯৩৫ সালে বর্তমান খাগড়াছড়ি উপজেলাধীন খবংপুজ্যা (খবংপড়িয়া) গ্রামের এক বিখ্যাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম গগণ চন্দ্র খীসা ও মাতার নাম ক্ষেমতি খীসা। তাঁর পিতামহ বিরাজমুনি ১৮শতকের শেষের দিকে খবংপুজ্যা গ্রামের গোড়াপত্তন করেন এবং তাঁর মাথা থেকে শিরোস্ত্রাণ বা ‘খবং’ পড়ে যাওয়ায় গ্রামটি ‘খবংপুজ্যা ‘ নামকরন হয়।
চার ভাই তিন বোনের মধ্যে মুকুর কান্তি খীসা ছিলেন সবার কনিষ্ঠ। অদম্য মেধাবী এ ব্যক্তিটির শৈশব কেটেছে খবংপুজ্যার প্রকৃতি ও আলো বাতাসের সান্নিধ্যে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার সময় তিনি তৎকালীন খাগড়াছড়ি জুনিয়র হাই স্কুলে ৭ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। দেশ ভাগ হওয়ার সময় তাকে ভারত বা পাকিস্তান যে কোন একটি দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের অপশন দেয়া হলে তিনি ভারতে থেকে যান এবং লেখাপড়ার জন্য কাকাকেও ভারতে নিয়ে যান।
শৈশবে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় Khabong Parya Lower Primay Schoolএ (বর্তমানে খবংপড়িয়া সরকারি প্রার্থমিক বিদ্যালয়)। সেখান থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তিনি খাগড়াছড়ি মিডল ইংলিশ স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণি ও খাগড়াছড়ি জুনিয়র হাই স্কুলে ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। অতপর বড় ভাইয়ের সাথে ভারতে চলে গেলে তৎকালীন কোলকাতায় বিখ্যাত Hare Schoolএ অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন (ম্যাট্রিক) পাশ করেন। কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাশ করলে তিনি The Telegraph School Awards of Excellence, Bishop Thoburn Award সহ কোলকাতার চারটি সেরা স্টুডেন্ট’স এওয়ার্ড লাভ করেন। অতপর তৎকালিন সময়ের কোলকাতার সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান Presidency College (বর্তমানে Presidency University) থেকে বিএ অনার্স(ইংলিশ), এমএ(পলিটিকাল সায়েন্স) ও এলএলবি ডিগ্রী অর্জন করেন।
ইন্ডিয়ান এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস(আইএএস) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ২৭তম স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন এবং ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস(আইএফএস) পরীক্ষায় ১০এর মধ্যে অবস্থান করলে ১৯৫৯সালে ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন। চাকুরীজীবনে তাঁর সর্বপ্রথম পোস্টিং হয় স্পেন এর রাজধানী মাদ্রিদে। সেখানে গ্লোরিয়া লংবার্ডো নামে এক স্প্যানিশ মহিলার সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ঔরসে দুজন কণ্যা সন্তানের জন্ম হয়। দীর্ঘ অনেক বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালনের পর তিনি ১৯৯৩ সালে চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ইন্ডিয়ান এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস (আইএএস) ও ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস (আইএফএস) পরীক্ষায় তিনি যে রেকর্ড গড়েছিলেন ভারতের কোন সিডিউল ট্রাইব বা সিডিউল কাস্ট অদ্যাবধি সেই রেকর্ড ভাঙতে পারেননি।
অত্যন্ত মেধাবী খাগড়াছড়ির এই কৃতী সন্তানটি ছাত্রজীবনে “Why I best in India” বিষয়ক রচনা প্রতিযোগিতায় সমগ্র ভারতে ১ম স্থান অর্জন করে স্বর্ণপদক লাভ করেছিলেন। ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট হিসেবে কর্মজীবনে তার বিশাল সুপরিচিত ছিল। লেখালেখিতে তিনি খুবই ভালো ছিলেন। Hare School এ পড়াকালীন সময়ে তিনি ‘মনের ফসল’ নামে সাহিত্য পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন। জীবনে তিনি অসংখ্য ছোটগল্প ও প্রবন্ধ লিখেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক ও বর্তমান প্রেক্ষাপট, ১৯৪৭ সালের দেশ বিভক্তি ও সমকালীন রাজনীতি এবং তৎসময়ে উপমহাদেশের ক্ষমতাধর শাসকদের চরিত্রের নেতিবাচক দিকসমূহ উপস্থাপনের মাধ্যমে ন্যারেটিভ স্টাইলে তার লেখা All That Glisters ও Time and Again উপন্যাসগুলি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাঠকদের কাছে খুবই সমাদৃত হয়েছে। অত্যন্ত সাবলীল ও প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা বইগুলিতে জন্মভূমির প্রতি তাঁর গভীর টান ও আত্মিক সম্পর্কের বিষয়টি বার বার গুরুত্বারোপ করেন। ১৯৪৭ সালের দেশবিভক্তিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়েও বেশি ভয়াবহ হিসেবে উল্লেখ করে উক্ত কারনে শত সহস্র পরিবারের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে দুঃখের সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়ার ঘটনা তুলে ধরেন এবং নিজের ক্ষেত্রেও আজীবন এ সীমাহীন বেদনা বয়ে বেড়ানোর আক্ষেপ প্রকাশ করেন।
আকস্মিকভাবে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ক্ষণজন্মা এ ব্যক্তি ২০০৭ সালের ২০ ডিসেম্বর স্ত্রী ও দুই কণ্যা ( রিতা খীসা ও অনিতা খীসা) রেখে স্পেন এর রাজধানী মাদ্রিদে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি গলফ খেলতে খুবই ভালোবাসতেন, এমনকি মৃত্যুর চারদিন আগেও তিনি গলফ খেলেছিলেন।