সেনা ক্যাম্প স্থাপনের বিরোধীতাকারীদের দাবি এখন সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের!
লাল কালিতে গোল চিহ্নিত ব্যক্তি উষাতন চাকমা।
![]()
মোঃ সাইফুল ইসলাম
অতি সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির লক্ষীছড়ি, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ও রাঙামাটি পার্বত্য জেলার কাউখালি উপজেলার সমন্বয়ে গঠিত বর্মাছড়ি ইউনিয়নে একটি অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প নির্মাণের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর ২৪ আর্টিলারি ব্রিগেড ও গুইমারা রিজিয়নের লক্ষীছড়ি জোন তাদের আওতাধীন বর্মাছড়ি এলাকায় ওই সেনা ক্যাম্প নির্মাণের প্রস্তুতি নেয়।
এর আগে, গত মাসের শেষাংশে খাগড়াছড়িতে এক মারমা কিশোরীকে ধর্ষণের তথাকথিত অভিযোগ তুলে আন্দোলনের নামে টানা কয়েকদিন সহিংসতা, সেনাবাহিনীর উপর হামলা এবং গুইমারায় ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাস্তায় নেমে সেনাবাহিনীর ওপর গুলি চালিয়ে তিন পাহাড়ি যুবককে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতি সশস্ত্র সংগঠন ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা এই বর্মাছড়িতে গা ঢাকা দেয়। এছাড়া খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও চট্টগ্রামের তিন উপজেলার ট্রাইজাংশন ব্যবহার করে তারা এখানে একটি বড় সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে।
অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প নির্মাণের মূল লক্ষ্য ছিল বর্মাছড়ির সশস্ত্র নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়া। কিন্তু সেই সময় ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে স্থানীয় পাহাড়ি নারী ও শিশুদের ব্যবহার করে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কৌশলী ভূমিকা নেয়। তারা নারী ও শিশুদের সামনে ঠেলে দিয়ে সেনা ক্যাম্পের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ করে। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা অপপ্রচার চালিয়ে স্থানীয়দের ক্ষেপিয়ে তোলে। সেনা ক্যাম্প স্থাপন ঠেকাতে তারা বৌদ্ধ বিহারের জমি দখলের অভিযোগ তুলে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ধর্মীয় ট্রামকার্ডও ব্যবহার করে।
বর্মাছড়ি এলাকায় সেনা ক্যাম্প স্থাপনের সময় সবচেয়ে তীব্র বিরোধিতা করেছিল ইউপিডিএফ। তারা নানা অজুহাতে দাবি তুলেছিল—সেনাবাহিনী নাকি তাদের “অধিকার” হরণ করছে। বাস্তবে তারা ভয় পেত নিজেদের চাঁদাবাজি, নিয়ন্ত্রণ ও সশস্ত্র অবস্থান হারানোর। এই বিরোধিতার কারণে এলাকাবাসীর মধ্যে ভয়-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়, যদিও স্থানীয় মানুষ বরাবরই চেয়েছিল নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা।
এই সমস্ত বিক্ষোভ, অপপ্রচার ও কৌশলগত পরিকল্পনায় পেছন থেকে সর্বাগ্রে ভূমিকা পালন করেছিলেন ফটিকছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান উষাতন চাকমা। তিনি বর্মাছড়িসহ ওই অঞ্চলে সশস্ত্র তৎপরতায় যোগান দেন এবং সরকারি রিজার্ভ ফরেস্টের কাঠ পাচারের চক্রেও জড়িত ছিলেন।
সেসময় সাম্প্রদায়িক সংঘাত এড়ানো ও জনমনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেনাবাহিনী বর্মাছড়িতে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিল করে। এতে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পায় ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা।

তবে এবার সেই ফটিকছড়ি, বর্মাছড়ি, ঘাগড়া ও কাউখালিতে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অবস্থান ও জনসাধারণের নিরাপত্তার দাবি তুলেছে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ইউপিডিএফ। সম্প্রতি রাঙামাটির ঘাগড়া-চট্টগ্রাম সীমান্তবর্তী এলাকায় সশস্ত্র একটি দলের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও জনহয়রানির অভিযোগ তুলে নিরাপত্তার দাবিতে বিক্ষোভ, সংবাদ সম্মেলন ও স্মারকলিপি দিয়েছে ‘‘ছাত্র-জনতা সংগ্রাম পরিষদ’’ ও “কাউখালির সচেতন শান্তিপ্রিয় নাগরিক সমাজ” নামের দুটি সংগঠন।
এই সংগঠনের পেছনেও জড়িত ফটিকছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান উষাতন চাকমা। মূলত প্রতিপক্ষ সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস সন্ত্রাসীদের আনাগোনা ঠেকাতে তিনি পুরনো কৌশল ব্যবহার করে স্থানীয় নারী ও শিশুদের মাঠে নামিয়েছেন। দাবি একটাই—চৌচলাবিল, সাদেক্যা বিল, মিদিঙ্যাছড়ি, রাজখালী, বেতছড়ি, রস্যাবিলি, ধুল্যাছড়ি, বলিঘোনা, ঘাগড়া, বর্মাছড়ি ও ফটিকছড়ির দুর্গম এলাকায় জেএসএস সন্ত্রাসীদের আধিপত্য ঠেকানো। কারণ, ওই এলাকায় জেএসএসের আধিপত্য বাড়লে দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত ইউপিডিএফের নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়বে এবং ট্রাইজাংশন ব্যবহার করে গড়ে তোলা অস্ত্রের সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র আধিপত্য হারাবে।

সেনা ক্যাম্প স্থাপনের বিরোধীতাকারীরা এবার প্রতিপক্ষকে ঠেকাতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছে। এর ধারাবাহিকতায় গত ১৬ নভেম্বর ঘাগড়া ইউনিয়নের রাঙামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নারী ও শিশুদের ব্যবহার করে একটি বিক্ষোভ সভা অনুষ্ঠিত হয়, যার নেতৃত্ব দেন উষাতন চাকমা। সভা শেষে তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে।
এরপর আজ রবিবার (২৩ নভেম্বর) রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার ফটিকছড়ি ইউনিয়নের ডাবুয়া বাজারে সংবাদ সম্মেলনে জেএসএসের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও জনহয়রানির অভিযোগ তোলা হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ফটিকছড়ি ইউপি সদস্য জগদীশ চাকমা, সাবেক ইউপি সদস্য অংচাজাই মারমা, চাথুইমং মারমা, কলমপতি ইউপি সদস্য মংথুইপ্রু মারমা, সমাজকর্মী উবাইচিং মারমা, কারবারি চাইশিমং মারমা ও হরি প্রু মারমা। সেখানে তারা প্রশাসনের কাছে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সহায়তা কামনা করেন।
মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো হয়েছে। নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী জেএসএস-এর হামলা, আধিপত্য-বিভেদ ও সশস্ত্র চাপের মুখে পড়ে ইউপিডিএফই এখন প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সহায়তা চাচ্ছে। যেই সেনা উপস্থিতিকে তারা “অবাঞ্ছিত” বলেছিল, আজ সেই বাহিনীরই নিরাপত্তাই তাদের একমাত্র ভরসা। এটি তাদের রাজনৈতিক ও সশস্ত্র স্বার্থের প্রকৃত চরিত্রকে প্রকাশ করে।
বছরের পর বছর পাহাড়ে সশস্ত্র আধিপত্য কায়েম রাখা, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে ইউপিডিএফ নিজেদের একটি স্বাধীন শক্তি হিসেবে দেখাতে চেয়েছে। কিন্তু প্রতিপক্ষ শক্তিশালী হলে কিংবা নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে পড়লেই তারা প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়। এর মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়—তাদের আন্দোলনের আদর্শিক ভিত্তি নেই, আছে শুধুই ক্ষমতা ধরে রাখার প্রবণতা।
ইউপিডিএফ কখনোই উপজাতি মানুষের জীবন, নিরাপত্তা বা উন্নয়নের জন্য কাজ করেনি। বরং যখন সেনাবাহিনী বা প্রশাসন নিয়মশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে গেছে, তখন প্রতিরোধ করেছে; কিন্তু বিপদে পড়লে সেই একই রাষ্ট্রযন্ত্রকে সহযোগী হিসেবে চাইছে। এই দ্বিমুখী আচরণ পাহাড়ের সাধারণ মানুষের কাছে দীর্ঘদিন ধরেই স্পষ্ট।
পাহাড়ে সাম্প্রতিক সংঘাত, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও সশস্ত্র দৌরাত্ম্যের যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার মূলে এই গোষ্ঠীগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্বই সর্বাধিক। অথচ যখন তারা বিপদে পড়ে, তখনই “প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে” বলে দাবি তোলে—দায়িত্বশীলতা কিংবা শান্তির জন্য নয়, বরং নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে।
প্রসঙ্গত, পাহাড়ে টেকসই শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর এই দ্বিচারিতা চিহ্নিত করা জরুরি। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী যখন-তখন সুবিধাবাদী রাজনৈতিক ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর রক্ষাকবচ হবে—এমন ধারণা যেমন অযৌক্তিক, তেমনি বিপদের সময় প্রশাসনের পেছনে ছুটে গিয়ে আবার শান্ত হলে তাদের বিরোধিতা করার প্রবণতাও পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার বড় অন্তরায়।
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।