মারমা জাতির উন্নয়নের অন্তরাই চাবাই মগের অন্তর্ধান - Southeast Asia Journal

মারমা জাতির উন্নয়নের অন্তরাই চাবাই মগের অন্তর্ধান

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

কামরুজ্জামান  ও মোঃ রিফাতউল্লাহ

পার্বত্য চট্টগ্রামের এক সূর্যপ্রতিম ব্যক্তিত্বের নাম চাবাই মগ। চাবাই মগ জুম্ম জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আত্ম নিবেদন করেন, তার প্রেক্ষিতে কলেজ জীবন থেকেই পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সম্পাদক ও পরবর্তীতে জেএসএস-এর দক্ষিণাঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সত্তর দশকের শেষের দিকে সন্তু লারমা ও চাবাই মগ গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘ চার বছর জেল খাটার পর তৎকালীন সরকার সন্তু লারমাকে কিছু শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয় বলে জানা যায়। চাবাই মগ হয়ত বিষয়টি জানতেন পার্বত্য চট্টগ্রামের সচেতন মহল মনে করেন চাবাই মগকে স্বার্থান্বেষী মহল হয়ত একারনেই অপহরণ করে মেরে ফেলেছিল। এছাড়া চাবাই মগ তার নেতৃত্বের গুনাবলী আর ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে চাকমা কর্তৃপক্ষের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে যাচ্ছিলেন। সেজন্য চাবাই মগকে অপহরণ করে মেরে ফেলেছে বলে স্থানীয়রা মনে করেন।

চাবাই মগ ৭ জুলাই ১৯৫০ সালে রাঙ্গামাটি জেলার বালুখালী ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮০ সালের মে মাসে তিনি রেডেমা চৌধুরীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬৮ সালে রাঙ্গামাটি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ থেকে ১৯৭০ সালে এইচএসসি এবং ১৯৭২ সালে বিএ পাস করেন।

চাবাই মগ ছোট বেলা থেকেই দুরন্ত সাহসীর অধিকারী ছিলেন তার সমাজ সংবেদনশীল সচেতনতা ও নেতৃত্বের গুণাবলীর অধিকারী। ছাত্র অবস্থায় দেখা গিয়েছিল, কলেজ জীবনে তিনি বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামের জড়িয়ে পড়েন এবং পাহাড়ি ছাত্র সমিতির সক্রিয় সদস্য হন। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় পাহাড়ী ছাত্র সমিতির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি জনসংহতি সমিতিতে যোগদান করেন এবং জুম্ম জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আত্মনিবেদন করেন। এসময় তিনি দক্ষিণাঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং বিভিন্ন গেরিলা যুদ্ধে দৃঢ়তার সাথে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং সংগঠনে তার অবদানের কারণে যথেষ্ট সুনাম ছিল। ১৯৭৯ সালে এপ্রিল মাসের শেষের দিকে প্রতিক্রিয়াশীলদের যোগসাজশে তিনি সশস্ত্র অবস্থায় ধরা পড়েন এবং বছরের শেষের দিকে তিনি মুক্তি পান। এরপর কিছুদিন তিনি ঢাকা নারায়ণগঞ্জ এর পারটেক্স মিলে চাকরি করেন। কিন্তু যার রক্তের নিপীড়িতদের অধিকার আদায়ের দ্রোহ তিনি কি শুধু চাকরি করে জীবন কাটাতে পারেন। তিনি পারেননি, তাই ফিরে আসেন মাটি ও পাহাড়ের টানে। ১৯৮০ সালে তিনি খাগড়াছড়ি পার্বত্য এলাকায় ফিরে চাকরি নেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বোর্ডে। খাগড়াছড়িতে এসে তিনি মারমাদের অচলায়তন পশ্চাৎপদতা দেখতে পান। সম্পদ ও প্রাচুর্যের সমৃদ্ধ মারমা জাতি হারাতে বসেছে তার সূর্য সময়, তিনি মারমাদের দূর ব্যবস্থা উত্তরনের পথ খুঁজতে থাকেন নিমগ্ন ভাবনায়। তার ভাবনার ফলস্বরূপ মারমা উন্নয়ন সংসদ আত্মপ্রকাশ করে। তার নেতৃত্বে মারমা উন্নয়ন সংসদের মাধ্যমে বিশৃংখল মারমা জাতি ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে সমাজকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিতে অর্থ-সামাজিক কর্মসূচি, সমাজ মননে পশ্চাৎপদতা এবং চিন্তা ধারণা অনৈক্য কাটাতে তিনি শুরু করেছিলেন সমাজ সংস্কারের সংগ্রাম। সরকারি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনে তিনি ছিলেন সমাজ বিনির্মাণের সাধনায়। আস্তে আস্তে আশেপাশের কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রের দানা বাঁধে তার ওপর।

উল্লেখ, সত্তর দশকের শেষের দিকে সন্তু লারমা ও চাবাই মগ গ্রেপ্তার হওয়ার পর চার বছর জেল খেটে সন্তু লারমাকে কোন সাজা না দিয়ে শর্তসাপেক্ষে তাকে মুক্তি দেয় তৎকালীন সরকার। চাবাই মগ এই বিষয়টির প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে সবকিছু জানতেন এবং কিছুদিন পর সরকার মুক্তি দেয়। তার পর থেকেই চাবাই মগকে সন্তুলারমা সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে এবং তারই প্রেক্ষিতে তিনি ষড়যন্ত্রকারী নীলনকশায় ৩ জানুয়ারি ১৯৮৭ সালে জুমরম ১২ নং রাবার এলাকা থেকে অপহৃত হন। অপহৃত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ খবর পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য মারমা নেতৃবৃন্দ এবং সকল স্তরের জনমানুষ শান্তিবাহিনীকে দায়ী করে খাগড়াছড়ি বিক্ষোভ মিছিল করেছিল। স্থানীয় বিজ্ঞজনেরা মনে করেন সন্তু লারমার সাথে তার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থাকার কারণে সন্তুলারমার ইচ্ছাতেই চাবাই মগের মৃত্যু ঘটেছিল বলে স্হানীয়রা মনে করেন।

চাবাই মগের নেতৃত্বের কারণে মারমা জাতি পুনরায় ফিরে পেয়েছিলো তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। নিপীড়িত মারমা জাতি হয়ে উঠেছিল এক সম্ভাবনাময় জাতি। কিন্তু বর্তমানে চাবাই মগের আদর্শ শুধুমাত্র দৃশ্যমান। যে কারণে মারমা জাতি আজও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মাধ্যমে নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়ে যাচ্ছে। পরিশেষে বলা যায় চাবাই মগের অন্তর্ধান এর ফলে মারমা জাতি যে ক্ষতি হয়েছে তা কিছুতেই পূরণ হবার নয়।