পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালীদের আঞ্চলিক রাজনীতি কোন পথে যাচ্ছে? – পর্বঃ ৫
![]()
ফিচার ডেস্কঃ
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী বাঙ্গালীদেরকে ঘিরে বিভিন্ন মহল থেকে পরস্পরবিরোধী মূল্যায়ন পাওয়া যায়। পাহাড়ীদের একাংশ, যারা সক্রিয়ভাবে আঞ্চলিক রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত তারা বাঙ্গালীদের বড় একটি অংশকে “সেটেলার” বলে দাবি করে। তারা পার্বত্য অঞ্চলকে একটি “বিশেষ অঞ্চল” বলে প্রতীয়মান করে, বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের মতো সকল নাগরিকদের প্রচলিত অধিকারের বিষয়টি মানতে চায়না। অপরদিকে বাঙ্গালীদের মধ্যে যারা সক্রিয় আঞ্চলিক রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত তারা বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সকল নাগরিকের অধিকার সমান, এমন যৌক্তিক দাবি করছে। এছাড়া গত শতকের ৮০’র দশকে তৎকালীন সরকার প্রদত্ত যেসকল ভূমি অসহায় বাঙ্গালীদেরকে বন্দোবস্তি দেয়া হয়েছে তার পূর্নবাস্তবায়নসহ সম অধিকার চায় তারা। তবে আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাঙ্গালীদের অধিকার নিয়ে যারা কাজ করে তারা কয়েকটি দলে বিভক্ত। বাঙ্গালীদের মধ্যে এই অনৈক্যর সুযোগ নিচ্ছে উপজাতি আঞ্চলিক দলগুলো। অপরদিকে শিক্ষাক্ষেত্রে সাধারণ উপজাতিদের মধ্যে যে পরিমান আগ্রহ রয়েছে বাঙ্গালীদের মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে গুনগতমান ধরে রাখার বিষয়ে ঐ পরিমান আগ্রহ নেই। ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা সরকার প্রদত্ত বিশেষ কোটা সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি নিজ যোগ্যতাতেও দেশে ও বিদেশে সুনামের সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। অপরপক্ষে বাঙ্গালীরা আন্তঃকলহ, গুনগত শিক্ষা অনুপস্থিতি এবং সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেইভাবে এগুতে পারছে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন অবস্থানের পরেও বাঙ্গালীদের মধ্যে থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের গুনগত নেতৃত্ব বেড়ে উঠার ক্রমধারা মন্থর গতিতে এগুচ্ছে। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থিতিশীলতা অনয়নে বাঙ্গালীদের মধ্যে থেকে যোগ্য নেতৃত্ব এবং বাঙ্গালী ভিত্তিক আঞ্চলিক দলের ঐক্যবদ্ধ সক্রিয় কর্মকান্ড একান্ত প্রয়োজন।
সাউথইস্ট জার্নালের পক্ষ হতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালীদের মধ্যে থেকে আঞ্চলিক রাজনীতিতে যারা উল্লেখযোগ্য ভাবে সম্পৃক্ত তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজকের ৫ম পর্বে পার্বত্য অধিকার ফোরামের অঙ্গ-সংগঠন বৃহত্তর পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের দীঘিনালা উপজেলা শাখার নেতা মোঃ আল আমিনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হলো। তিনি খাগড়াছড়ি সরকারী কলেজে অধ্যায়নরত আছেন।
সাউথইস্ট জার্নালের সাথে তার কথোপকথন নিম্নরুপঃ
সাউথইস্ট জার্নাল: বর্তমানে পাহাড়ে বাঙ্গালীদের রাজনীতির বর্তমান গুনগত মান এবং এর ভবিষ্যৎ কি বলে মনে করেন?
আল আমিন: পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক বাঙ্গালী সংগঠনগুলোর যে গুনগত মান তা আসলে আগের চাইতে কিছুটা উন্নতির দিকে। তবুও বর্তমানে যে নেতৃত্ব পর্যায়ে আছে তার ভবিষ্যত অন্ধকার ছাড়া ভালো কিছু আশা করা যায়না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই দেশে আমরা বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছি। যেমন, সরকার আমাকে একটা জাতীয় পরিচয় পত্র দিয়েছে, জন্ম নিবন্ধন সনদ দিয়েছে তারপরেও দেখেন হেডম্যানের কাছ থেকে আমাদের রিপোর্ট নিতে হচ্ছে, স্থায়ী বাসিন্দার সনদ নিতে হচ্ছে। এগুলাতো একটা বৈষম্য, যার স্বীকার আমরা বাঙ্গালীরা।
আর বাঙ্গালী সংগঠনগুলোকে টিকে থাকতে হলে, গুনগতমান ঠিক করতে হলে আগে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। ঐক্য গড়ে তোলা গেলে কাদা ছোঁড়াছুড়ি বন্ধ হবে, কর্মীদের ও সংগঠনের গুনগত মান বৃদ্ধি পাবে।
সাউথইস্ট জার্নাল: বাঙ্গালীদের যে আঞ্চলিক রাজনীতি আছে সেটার সাথে জাতীয় রাজনৈতিক দলের কোন সাংঘর্ষিক অবস্থা আছে কি? অনেকেই মনে করেন ইতিপূর্বে বাঙ্গালী সংগঠনগুলোর যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের অনেকের সাথেই বিএনপি-জামাতের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আল আমিন: আমাদের আঞ্চলিক বাঙ্গালী সংগঠনগুলোর সাথে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর কোন সাংঘর্ষিকতা নেই। পূর্বে যে জামাত-শিবির নিয়ে কথাটা প্রচলিত ছিলো সেটা থেকে বেরিয়ে এসে আমরা যারা আছি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে চাই।
সাউথইস্ট জার্নাল: অনেক বাঙ্গালী আছে যারা আঞ্চলিক রাজনীতি করে, তাদের বিরুদ্ধেতো এলাকার জনগনই মামলা করেছে, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির কারণে! এবিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আল আমিন: পার্বত্য অঞ্চলে যেসব আঞ্চলিক উপজাতি সংগঠন ইউপিডিএফ-জেএসএস আছে তাদের সাথে বাঙ্গালী সংগঠনগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে চলার সুযোগ নেই। যেকোন প্রোগাম বলেন আর বাঙ্গালীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন বলেন, সেখানে সবার সহযোগিতা ছাড়া কোন চাঁদাবাজিকে আমরা প্রশ্রয় দিবো না।
সাউথইস্ট জার্নাল: আপনার কাছে কি মনে হয়, বাঙ্গালী সংগঠনগুলোর মধ্যে যে বিভেদ আছে সেগুলি একসময় ঐক্যে রুপান্তর করা সম্ভব?
আল আমিন: আমি মনে করি আঞ্চলিক বাঙ্গালী সংগঠনগুলোর মধ্যে ঐক্য সম্ভব। তবে এখানে যারা নেতৃত্ব পর্যায়ে আছে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করতে হবে। ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিলে ঐক্য সম্ভব হবে না।
সাউথইস্ট জার্নাল: স্থানীয় অনেকেরই শঙ্কা, বাঙ্গালী আঞ্চলিক রাজনীতির নামে আরেকটি চাঁদাবাজ ইউপিডিএফের সৃষ্টি হলো কি না? এ বিষয়ে আপনার অভিমত কি?
আল আমিন: আমরা চাইনা পার্বত্য আঞ্চলিক বাঙ্গালী সংগঠনগুলোর কেউ ইউপিডিএফের মতো চাঁদাবাজি করুক। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাবো। এছাড়া আমরা ইউপিডিএফের মতো পাহাড়কে অস্থিতিশীল করতে চাইনা, সুতরাং এখানে চাঁদাবাজির সুযোগ নেই।
সাউথইস্ট জার্নাল: বাঙ্গালী সংগঠনগুলোতে শিক্ষিত ও উন্নত মানসিকতার কর্মীর অভাব রয়েছে কি?
আল আমিন: আমাদের সব ধরণের আন্দোলনে যথেষ্ট শিক্ষিত কর্মীর অভাব রয়েছে। বর্তমানে যাও আছে, আমি মনে করি ঐক্য প্রক্রিয়া গঠন হলে সেখানে যখন একটা অবস্থান তৈরী হবে তখন এ ঘাটতিটা দূর হয়ে যাবে।
সাউথইস্ট জার্নাল: গ্রাম পর্যায়ে যারা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে তাদের বিষয়ে আপনাদের কোন পদক্ষেপ আছে কি ?
আল আমিন: গ্রাম পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করতে আমরা কাজ করছি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে বই বিতরণ, ভর্তি কার্যক্রমসহ বিভিন্ন পর্যায়ে সহায়তার মাধ্যমে আমরা ঝরে পড়া রোধ করতে কাজ করছি।
সাউথইস্ট জার্নাল: শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেতে আপনাদের গ্রাম পর্যায়ে কোন পরিসংখ্যান কমিটি আছে কি না?
আল আমিন: না, সরকারী পৃষ্টপোষকতা পেতে আমাদের গ্রাম পর্যায়ে কোন পরিসংখ্যান কমিটি নেই তবে উপজেলা পর্যায়ে আছে।
সাউথইস্ট জার্নাল: বাঙ্গালীদের ও বাঙ্গালী সংগঠনগুলোর মানোন্নয়নে আপনি কি স্বপ্ন দেখেন?
আল আমিন: বাঙ্গালীরা যেখানেই অন্যায়-অবিচার, বৈষম্যর স্বীকার হচ্ছেন সেখানেই আমরা তাদের পাশে দাঁড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। মানোন্নয়নের কথা বলতে গেলে, আমাদের স্বপ্ন, আমরা বাঙ্গালী নতুন প্রজন্মকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত করার স্বপ্ন দেখি। লেখা-পড়ায় উদ্বুদ্ধ করার স্বপ্ন দেখি, আমরা তাদের মধ্যে থেকে সাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনা দূর করে দেবো।
সাউথইস্ট জার্নাল: চাকমা সমাজে দেখা যায়, বর্তমানে ২০-২৫ জন পিএইচডি হোণ্ডার আছেন যারা দেশে-বিদেশে কর্মরত আছেন। বাঙ্গালীদের শিক্ষার গুনগত মান ঐ পর্যায়ে যেতে পারছে কি না, যে পর্যায়ে গেলে কার্যকরী নেতৃত্ব দিতে পারবে?
আল আমিন: আমি বলেছি যে, বাঙ্গালী পার্বত্য অঞ্চলে শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রেই বৈষম্যের স্বীকার। আমরা কোটার কারনে মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইনা। যদি সরকার উপজাতিদের পাশাপাশি আমাদেরও ওদের মতো সুযোগ সুবিধা দেয় তাহলে আমরা বাঙ্গালীরাও শিক্ষার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাতে পারবো।
সাক্ষাৎকারের ভিডিও: