খাগড়াছড়ির সড়কে অবরোধ শিথিল হলেও গাড়ি নামেনি, আতঙ্ক
![]()
নিউজ ডেস্ক
খাগড়াছড়ি-ঢাকা ও খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গতকাল সোমবার দুপুর ১২টা থেকে পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত অবরোধ শিথিল করা হয়েছে। গতকাল এক বিবৃতিতে বিষয়টি নিশ্চিত করে ‘জুম্ম-ছাত্র জনতা’র মিডিয়া সেল। বিবৃতিতে বলা হয়, লাশ সৎকার ও আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য অবরোধ শিথিল করা হয়েছে। তবে অন্যান্য সড়কে অবরোধ চলবে। এ দিকে নতুন করে সোমবার তিন পার্বত্য জেলায় সড়ক অবরোধ ডাকা হয়েছে। পাশাপাশি তারা তিন জেলায় সব পর্যটন কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করে।
খাগড়াছড়িতে স্কুলছাত্রী ধর্ষণের বিচার দাবিতে বিক্ষোভ একপর্যায়ে সংঘর্ষে রূপ নেয়ায় প্রশাসনের জারি করা ১৪৪ ধারা বহাল রয়েছে। গত রোববার গুইমারা উপজেলায় পাহাড়ি-বাঙালির উত্তেজনায় দুর্বৃত্তের গুলিতে আহতদের চিকিৎসা ও নিহতদের সৎকারে জেলায় অবরোধ শিথিলের ঘোষণা দেয় জুম্ম ছাত্র-জনতা। কিন্তু সশস্ত্র গ্রুপের তাণ্ডবের আশঙ্কায় সড়কে গতি আসেনি, গাড়ির চাকাও ঘুরেনি। ফলে খাগড়াছড়ির প্রধান সড়কসহ গুরুত্বপূর্ণ জনপদ অনেকটাই নীরব। খাগড়াছড়ির প্রবেশমুখে শতাধিক খাদ্য ও পণ্যবাহী গাড়ি আটকা পড়েছে।
এদিকে টানা তৃতীয় দিনের মতো খাগড়াছড়ি জেলায় সড়ক অবরোধ চলছে। সকাল থেকে সদরে অল্প কিছু অটোরিকশা চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে। তবে দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ছিল। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সাধারণ মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। বিভিন্ন স্থানে কাঁচামালবাহী ট্রাক ও পিকআপ আটকে থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। ১৪৪ ধারা জারি থাকায় বাজারের দোকানপাটও বন্ধ। নিত্যপণ্যসহ প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে না পারায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় জেলার প্রবেশমুখ ফটিকছড়ি উপজেলার নয়াবাজার (চেক পোস্ট) গিয়ে দেখা গেছে, পাহাড়ে সরকারি খাদ্যগুদাম ও হাটবাজারে আসা গো ও পোলট্রি খাদ্য, ফলবাহী শ’ খানেক ট্রাক নয়াবাজারে দাঁড়িয়ে আছে, যা বিকেল সাড়ে ৫টায়ও আটকে ছিল। এ সময় খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলায় সরকারি গুদামের মালবাহী ট্রাকচালক নাজমুল হাসান বলেন, রোববার বিকেল ৪টায় খাগড়াছড়ির প্রবেশমুখে এসে আটকা পড়েছি। পাহাড়ে চলমান পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার অভাব এবং অবরোধ থাকায় যেতে পারছি না। ট্রাকচালক আশিক জানান, ৩০টির অধিক ট্রাক নিয়ে আমরা দুঃসময় পার করছি। এই এলাকায় দোকানপাট কম, খাবার নেই। সকালের চা-বিস্কুটে দুপুর গড়িয়েছে। ফলবাহী ট্রাকচালক নিজাম উদ্দিন বলেন, খাগড়াছড়ি শহরের জন্য আপেল, আঙুর, কমলা লোড করে সেই সকাল ৫টায় এসে রোদে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখেছি। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অবরোধের কারণে যেতে দিচ্ছে না। অপেক্ষা করতে বলছেন। যাত্রীদের সড়ক ও দোকানপাটে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। অনেকে নিরুপায় হয়ে ফিরে গেছেন।
শনিবার-রোববারের সহিংসতার পর খাগড়াছড়ি সদর ও গুইমারা উপজেলায় ১৪৪ ধারা বহাল রেখেছে স্থানীয় প্রশাসন। বিভিন্ন স্থানে পুলিশ, আর্মড পুলিশ, বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে এবং সেনাবাহিনীকে রাস্তায় টহল দিতে দেখা গেছে।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন মহলের সাথে আলোচনা চলছে।
জনগণের পাশে থাকবে বিজিবি
খাগড়াছড়ির পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এবং ১৪৪ ধারা না ওঠা পর্যন্ত বিজিবি নিরবচ্ছিন্নভাবে সাধারণ জনগণের পাশে থেকে দায়িত্ব পালন করবে। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিজিবি সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে। রোববার বিকেলে স্বনির্ভর বাজার এলাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন খাগড়াছড়ি বিজিবি সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মো: আবদুল মুত্তাকিম।
তিনি বলেন, বিজিবির দ্রুত পদক্ষেপের কারণে দুষ্কৃতিকারীরা এই এলাকায় নাশকতা সৃষ্টি করতে পারেনি এবং পাহাড়ি-বাঙালির সঙ্ঘাত আমরা প্রতিহত করতে সক্ষম হই। আমাদের ১০টি প্লাটুন খাগড়াছড়ি শহর ও স্বনির্ভর বাজারে দিনে ও রাতে সার্বক্ষণিক টহল পরিচালনা করছে। এ ছাড়াও আরো চার প্লাটুন স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সেক্টর কমান্ডার বলেন, কিছু মহল ষড়যন্ত্র করে পার্বত্য এলাকাকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। এসব ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় বেসামরিক প্রশাসনসহ সেনাবাহিনী যেভাবে আমাদের সহযোগিতা চাচ্ছে আমরা তা করে যাচ্ছি।
আইএসপিআরের বক্তব্য
প্রতিবেদক জানান, খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় সহিংসতার ঘটনায় পরিস্থিতি সম্পর্কে বিবৃতি দিয়েছে সেনাবাহিনী।
রোববার রাতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেলচালক মামুন হত্যাকে কেন্দ্র করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) মূল এবং অঙ্গসংগঠনগুলো জেলার দীঘিনালা ও রাঙ্গামাটি জেলায় সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এতে তিনজন নিহতসহ বেশ কিছু এলাকাবাসী আহত হয়। গত বছরের ঘটনার এক বছর পূর্তি হিসেবে এই বছর ইউপিডিএফ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করে এবং অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা করে।
আইএসপিআর জানায়, গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়ির সিঙ্গিনালা এলাকায় এক স্কুলছাত্রীর ধর্ষণের অভিযোগকে আমলে নিয়ে ইউপিডিএফের (মূল) দাবিকৃত সন্দেহভাজন শয়ন শীলকে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় পরদিন গ্রেফতার করা হয় এবং পুলিশ হেফাজতে রিমান্ডে নেয়া হয়। ঘটনাটির সত্যতা বিচারে আইনিপ্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। শয়ন শীলকে গ্রেফতার সত্ত্বেও ইউপিডিএফের অঙ্গসংগঠন পিসিপি নেতা উখ্যানু মারমা ‘জুম্ম ছাত্র জনতার’ ব্যানারে গত ২৪ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল এবং প্রতিবাদী মানববন্ধনের ডাক দেয়। এর ধারাবাহিকতায় ২৫ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে অর্ধবেলা হরতাল পালিত হয়। একই সময় দেশে-বিদেশে অবস্থানরত ব্লগার এবং পার্বত্যাঞ্চলের কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক অনলাইনে বাঙালিদের উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন রকম অপপ্রচার ও উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়া হয়।
২৬ সেপ্টেম্বর ইউপিডিএফ কর্মী উখ্যানু মারমার নেতৃত্বে এবং সামাজিক মাধ্যমে উসকানিমূলক প্রচারণার প্রভাবে খাগড়াছড়িতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। অবরোধ চলাকালে একপর্যায়ে ইউপিডিএফের প্ররোচনায় উচ্ছৃঙ্খল এলাকাবাসী টহলরত সেনাদলের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে তিনজন সেনা সদস্য আহত হয়। সার্বিক পরিস্থিতি এবং উসকানির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সেনাবাহিনী অত্যন্ত ধৈর্য্য, সংযম ও মানবিকতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এবং বলপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকে।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর ইউপিডিএফ এবং অঙ্গ সংগঠনের কর্মীরা আবারো দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টির চেষ্টা চালায় এবং বিভিন্ন স্থানে বাঙালিসহ সাধারণ মানুষের ওপর গুলি, ভাঙচুর, অ্যাম্বুলেন্সে আক্রমণ এবং রাস্তা অবরোধসহ নাশকতা করে সমগ্র খাগড়াছড়ি পৌরসভা এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটায়। ওই দিন দুপুরে সামগ্রিক বিষয়টি পাহাড়ি-বাঙালির একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপ নেয়। অবস্থা বিচারে জেলা প্রশাসন কর্তৃক খাগড়াছড়ি ও গুইমারা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
আইএসপিআর আরো জানায়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অপচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ইউপিডিএফ ও এর অঙ্গসংগঠন রোববার সকাল থেকে খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা উপজেলার রামসু বাজার এলাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সাধারণ জনগণকে উসকে দিয়ে গুইমারা-খাগড়াছড়ি রাস্তা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়। সকাল সাড়ে ১০টায় ইউপিডিএফ কর্মী ও সন্ত্রাসীরা এলাকার বাঙালি জনগোষ্ঠীর সাথে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় লিপ্ত হয়। এ পর্যায়ে সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে তারা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র, ইটপাটকেল, গুলতি ও লাঠিসোটা নিয়ে সঙ্ঘবদ্ধভাবে সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। এতে সেনাবাহিনীর তিনজন অফিসারসহ ১০ জন সদস্য আহত হয়। একই সময় তারা রামগড় এলাকায় বিজিবির গাড়ি ভাঙচুর করে এবং বিজিবি সদস্যদের আহত করে। সংঘর্ষ চলাকালে সাড়ে ১১টার দিকে রামসু বাজারের পশ্চিম দিকে অবস্থিত উঁচু পাহাড় থেকে ইউপিডিএফ (মূল) সশস্ত্র দলের সদস্যরা চার-পাঁচবার অটোমেটিক অস্ত্র দিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত পাহাড়ি, বাঙালি এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত সেনাসদস্যদের লক্ষ্য করে প্রায় ১০০-১৫০ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। এতে ঘটনাস্থলে সংঘর্ষে লিপ্ত এলাকাবাসীর মধ্যে অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়। এ অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনীর টহল দল দ্রুত সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করার লক্ষ্যে ওই এলাকায় গমন করে। সেনাবাহিনীর তৎপরতায় ওই সশস্ত্র দলটি দ্রুত এলাকা ত্যাগ করে। সমসাময়িক সময়ে রামসু বাজার এবং ঘরবাড়িতে ইউপিডিএফের (মূল) বহিরাগত দুষ্কৃতিকারীরা অগ্নিসংযোগ করে এবং বাঙালিদের সাথে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় লিপ্ত হয়।
আইএসপিআর জানায়, বিগত কয়েক দিনের ঘটনা পর্যবেক্ষণে এটি স্পষ্ট যে ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে সুপরিকল্পিতভাবে এলাকার মহিলা এবং স্কুলগামী কোমলমতি শিশুদের বিভিন্ন পন্থায় তাদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে বাধ্য করছে। একই সাথে পার্বত্যাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠনের লক্ষ্যে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্রসহ পার্বত্যাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। রোববার বিকেলে বিজিবির কাপ্তাই ব্যাটালিয়ন কর্তৃক চেকপোস্টে ইউপিডিএফের সন্ত্রাসী সংগঠনের পরিবহনকৃত বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র যাত্রীবাহী বাস থেকে জব্দ করা হয়।
বিগত ১৯ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খাগড়াছড়ি ও গুইমারা এলাকায় বিভিন্ন ঘটনাকে পুঁজি করে আইনের আশ্রয় না নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলকে অস্থিতিশীল ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠনের বিষয়টি একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ বলে প্রতীয়মান হয়। এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রমাণাদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সংরক্ষিত আছে। বিগত কয়েক দিনের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সেনাবাহিনী পার্বত্য অঞ্চলের সব জাতিগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও জনসাধারণকে সংযত আচরণ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। পার্বত্যাঞ্চলের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হচ্ছে।
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।