আদানির মতো অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় চুক্তি হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের?
![]()
নিউজ ডেস্ক
ভারতের আদানি পাওয়ার ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) মধ্যে ২০১৭ সালে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট) সই হয়। চুক্তিটি দীর্ঘদিন গোপন ছিল এবং এতে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী বহু শর্ত রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিপিডিবি কর্মকর্তাদের দিয়ে চুক্তিটি করানো হয়, যেখানে আদানির পক্ষে এককভাবে সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার কোনো কার্যকর আইনি সুযোগ বিপিডিবির নেই।
চুক্তিতে বাংলাদেশকে আদানির ঝাড়খণ্ডের গড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতার ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য করা হয়েছে, যেমনটা অন্য কোনো বিদ্যুৎ চুক্তিতে নেই। কয়লার দাম নির্ধারণেও আদানির হাতে সুবিধা। কয়লার মূল্য নিয়ে বিরোধের কারণে আদানির ২৩০ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিল নিয়ে আপত্তি রয়েছে বিপিডিবির।
আদানি পাওয়ারের এ নেতিবাচক অভিজ্ঞতা চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনালগুলোয় বিদেশী অপারেটর নিয়োগের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া উচিত হলেও অন্তর্বর্তী সরকার তা করেনি বলে অভিযোগ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি, আদানির মতো চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়নকে ঘিরেও একই ধরনের অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় চুক্তি সম্পন্ন হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বিদেশী অপারেটরের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়নবিষয়ক একাধিক দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে।
এসব চুক্তির খসড়া, বিশেষ করে চুক্তির গ্যারান্টি, ইনডেমনিটি, টার্মিনেশন বা পরিবেশসংক্রান্ত ধারাগুলো এখনো সাধারণের সামনে প্রকাশ করা হয়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসব ধারা নিয়ে কোনো অস্বচ্ছতার থাকলে তা আগামীতে যে সরকারই আসুক, তাদের জন্য বোঝা হয়ে উঠতে পারে। যেমনটা ঘটেছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ আমলে সই হওয়া আদানির সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, বন্দরের যেকোনো মালিকানা বা পরিচালনাসংক্রান্ত চুক্তি কেবল একটি অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং এটি জাতীয় নিরাপত্তা, ভূরাজনীতি এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রশ্নেও পরিণত হয়। ফলে চুক্তিতে থাকা সংবেদনশীল ধারা যাচাই-বাছাইসহ অংশীজনদের মতামত ও বিভিন্ন ধরনের পর্যালোচনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। বর্তমানে হতে যাওয়া চুক্তিগুলোয় কী আছে তা কেউ জানে না।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে আদানির বিপুল বকেয়া পরিশোধ এবং চুক্তিটি খতিয়ে দেখতে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেছে। কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন, চুক্তিতে ভয়াবহ অনিয়মের প্রমাণ রয়েছে।
কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ চুক্তি বাতিল করতে গেলে সরকারকে বেশকিছু বিপদে পড়তে হবে। তারা আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে পারে। ফলে চাইলেই এখন চুক্তিটি বাতিল করা সম্ভব নয়। তবে এখানে যে ব্যত্যয়গুলো হয়েছে, সেগুলো নিয়ে সরকার কাজ করতে পারে।’
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনালের চুক্তিগুলোর শর্ত ও বিষয়াদি কীভাবে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে, তা নিয়ে স্পষ্ট নীতিগত ঘোষণা নেই। সরকারি সূত্র তথ্য দিচ্ছে না, বন্দর কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিচ্ছে না। অন্যদিকে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলছে, তারা চুক্তির সারসংক্ষেপও দেখতে পাননি। অভ্যন্তরীণ কয়েকটি সূত্র দাবি করেছে চুক্তিগুলো পিপিপি কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিদেশী অপারেটর বিল্ড-অপারেট-ট্রান্সফার পদ্ধতিতে টার্মিনাল পরিচালনার অধিকার পাবে। কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা আদৌ কি পুনরুদ্ধার করা যাবে, নাকি দীর্ঘমেয়াদে অপারেটরেরই নিয়ন্ত্রণ থাকবে, এ ধরনের বিষয়গুলো অনিশ্চিত।
জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের চুক্তিতে গ্যারান্টিবিষয়ক ধারা থাকে। এ ধারায় সাধারণত রাষ্ট্র বা বন্দর কর্তৃপক্ষ বেসরকারি বিনিয়োগকারীর জন্য নির্দিষ্ট মুনাফা, সর্বনিম্ন কার্গো হ্যান্ডলিং ভলিউম অথবা নীতিগত স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা দেয়। এ ধারায় রাজস্ব গ্যারান্টি থাকতে পারে। এক্ষেত্রে আয় না হলে সরকার ক্ষতিপূরণ দেয়।

আবার চাহিদা গ্যারান্টির বিষয়ও থাকে। যেখানে নির্দিষ্ট পরিমাণ কনটেইনার বা কার্গো বন্দর দিয়ে যাবে বলে নিশ্চয়তা দেয়া হয়। না হলে রাষ্ট্র নিজ খরচে বন্দর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে। এ রকম ঘটলে বন্দরের লাভের চাপ জনগণের ওপর এসে পড়ে। এমন ঝুঁকি শ্রীলংকা ও কেনিয়ার মতো বহু দেশ এরই মধ্যে মোকাবেলা করেছে।
পারফরম্যান্সবিষয়ক ধারায় অপারেটরের জন্য টার্মিনালের যাতায়াত ক্ষমতা, জাহাজ খালাস ও অপেক্ষার সময়সীমা, ক্রেন ব্যবহার এবং ফি সংগ্রহের দক্ষতা নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় বাঁধা থাকে। শর্ত পূরণ না হলে জরিমানা, আর্থিক কাটছাঁট বা কনসেশন বাতিলের ক্ষমতা থাকে। বন্দরের জট হলে জরিমানার বিধান থাকে। আবার আন্তর্জাতিক সেফটি স্ট্যান্ডার্ড বজায় না রাখলে লাইসেন্স বাতিলযোগ্য হয়।
ইনডেমনিটি বিষয়ক ধারায় কোনো দুর্ঘটনা, অপারেশন ব্যর্থতা বা অর্থনৈতিক ক্ষতি হলে আর্থিক দায় কার সে বিষয়গুলো নির্দিষ্ট করা থাকে। এ ধারা অনুসারে চুক্তির যেকোনো ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনা (দুর্ঘটনা, দূষণ, শ্রমিক-দাবি, তৃতীয় পক্ষ ক্ষতিপূরণ) ঘটলে কোন পক্ষ আর্থিক দায় বহন করবে তা নির্ধারিত হয়।
একইভাবে ট্যাক্স বা রাজস্বসংক্রান্ত ধারায় বিনিয়োগকারীর করছাড়, ভ্যাট অব্যাহতি, কাস্টমস সুবিধা বা রাজস্ব ভাগাভাগির সূত্র নির্ধারণ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে ১০ থেকে ২৫ বছরের জন্য করমুক্ত সুবিধা বা ডিউটি ড্র ব্যাক দেয়া হয়, যা সরকারি আয়ের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
টার্মিনেশন ধারায় নির্ধারিত থাকে কোন পরিস্থিতিতে চুক্তি বাতিল করা যাবে। পরিবেশসংক্রান্ত ধারায় ড্রেজিং, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, তেল/রাসায়নিক ছড়িয়ে পড়া, কার্বন নিঃসরণ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলার বাধ্যবাধকতা থাকে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, বন্দর উন্নয়নের মতো চুক্তি গোপন রাখা উচিত নয়। যদিও আইনি বাধ্যবাধকতা নেই, তবু এ ধরনের রাষ্ট্রীয় চুক্তির মৌলিক শর্তগুলো প্রকাশ করা প্রয়োজন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাধ্যবাধকতা না থাকলেও সাধারণত এ ধরনের চুক্তির মূল বিষয়গুলো প্রকাশ করা উচিত। এ চুক্তিগুলো সরকার করে থাকে সাধারণত রাষ্ট্রের পক্ষে। যাদের সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে তাদের স্বার্থের পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বার্থও দেখতে হবে। যেমন এর আগে আদানির সঙ্গে চুক্তিটি সম্পূর্ণ একপক্ষীয় ছিল। যেহেতু আমাদের অভিজ্ঞতা খারাপ, সেই কারণে আমি মনে করি চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো প্রকাশ করা উচিত।’
চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে এক্ষেত্রে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান আরো বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতির একটা স্তম্ভ হলো চট্টগ্রাম বন্দর। এ বিবেচনায় শর্তগুলো প্রকাশ এবং অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। সরকারি কাঠামোর বাইরে বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করা উচিত, যাতে ঝুঁকি নিরসনের সম্ভাবনা এমন একটা পর্যায়ে থাকে যেটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে বিশেষ করে বিদ্যুৎ খাতে যে চুক্তিগুলো হয়েছে, সেগুলো শাখের করাত হয়ে গেছে। আমরা গিলতে পারছি না, ফেলতেও পারছি না। এ ধরনের চুক্তিগুলো সালিশি পর্যায়ে চলে গেলে তখন আমাদের স্বার্থের পরিপন্থী হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কাজেই সরকার ওই অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে অগ্রসর হবে বলে আশা করি।’
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল ও কেরানীগঞ্জের পানগাঁও নৌ টার্মিনাল পরিচালনায় বিদেশী অপারেটরের সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত করাকে ঘিরে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে অনুমোদন, বোর্ডে সদস্য সংখ্যা সংকটের মতো প্রশ্ন উঠেছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) একই দিনে তাড়াহুড়ো করে দুটি চুক্তির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে। এগুলো হলো পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনালের ২২ বছর মেয়াদি টার্মিনাল অপারেটর নিয়োগ এবং চট্টগ্রামের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালের মোট ৫০ বছরের কনসেশন চুক্তি।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, ৭ ও ৮ নভেম্বর পানগাঁও টার্মিনালে অপারেটর নিয়োগ এবং লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালের দীর্ঘমেয়াদি কনসেশন চুক্তির নেগোসিয়েশন ও চূড়ান্ত দলিলকাজ সম্পন্ন হয়। মূল্যায়ন কমিটির বেশির ভাগ সদস্য এসব বিষয়ে অবগত ছিলেন না। জানতেন কেবল চবক, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও পিপিপি কর্তৃপক্ষের কয়েকজন নির্বাচিত সদস্য।
৭ ও ৮ নভেম্বর সাপ্তাহিক ছুটির দিনে গোপনীয়তার সঙ্গে এ দুটি বিষয় সম্পন্ন হওয়ায় এখন প্রশ্ন উঠেছে পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে। অভিযোগ উঠেছে মূল্যায়ন কমিটিকে পাশ কাটানো, প্রয়োজনীয় বোর্ড সদস্য ছাড়া অনুমোদন নেয়া, একই দলের সদস্যদের একই সময়ে দুটি আন্তর্জাতিক নেগোসিয়েশনে জড়ানো এবং একদিনের মধ্যে মন্ত্রণালয় হয়ে আইন মন্ত্রণালয় পর্যন্ত ফাইল পৌঁছে যাওয়া—সব মিলিয়ে নজিরবিহীন তাড়াহুড়োর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারি বা আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এমন গুরুতর নথি অনুমোদন করে না। এতে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক।’
সূত্র জানিয়েছে, সবচেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ দিক হচ্ছে, উভয় মূল্যায়ন কমিটিতে আহ্বায়ক এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি ছিলেন একই ব্যক্তিরা। পরিচালক (পরিবহন) এবং প্রধান অর্থ ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা দুজনই দুই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং একই সময়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ নেগোসিয়েশনে এ ভূমিকা পালন করেছেন।
এ নিয়ে পিপিপি বিষয়ে অভিজ্ঞ একজন প্রকৌশলী নাম না প্রকাশের শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একই সময় দুই ভিন্ন বিদেশী বিনিয়োগকারীর সঙ্গে দুটি পিপিপি নেগোসিয়েশন অসম্ভব ও নৈতিকভাবেও প্রশ্নবিদ্ধ। পিপিপি চুক্তি অত্যন্ত জটিল। প্রতিটি লাইন, আইনগত বিষয়, কনসেশন শর্ত সবকিছুই পুরো কমিটিকে বসে বিশদভাবে পর্যালোচনা করতে হয়। এত দ্রুততার সঙ্গে, তাও একই টিম দিয়ে এভাবে কাজ করানো—এটি দেশের স্বার্থের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এ ধরনের চুক্তি পুনর্বিবেচনা করা জরুরি।’
বোর্ড সভায়ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, সভায় প্রয়োজন ছিল চারজন সদস্যের, ছিলেন মাত্র দুজন। চবক আইনে বোর্ডে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তে তিন-চার সদস্যের ভোট প্রয়োজন। কিন্তু এ দুই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এমন এক বোর্ড সভায়, যেখানে উপস্থিত ছিলেন মাত্র দুই সদস্য। তাদের সম্মতি নিয়েই বিষয়গুলো অনুমোদন করা হয়।
বর্তমান বোর্ডের এক সদস্য এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে বন্দরসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন অনুযায়ী এটি ত্রুটিপূর্ণ বোর্ডের সিদ্ধান্ত। ন্যূনতম তিন সদস্য ছাড়া এ ধরনের অনুমোদন আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায়। দেশের স্বার্থে বোর্ডে পূর্ণাঙ্গ আলোচনার মাধ্যমে পুনরায় অনুমোদন নেয়া প্রয়োজন।
বন্দর ব্যবহারকারী সংগঠনগুলোর কোনো সদস্যকেই পুরো প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হয়নি বলে অভিযোগ করছে পোর্ট ইউজার্স ফোরাম। সংগঠনের একজন সিনিয়র সদস্য বলেন, ‘সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি অস্বচ্ছতার সঙ্গে হয়েছে। ৯ নভেম্বর বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয়ার পর সেদিনই নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় কাগজপত্র। পরদিন ১০ নভেম্বরই তা আইন মন্ত্রণালয়ে পৌঁছায়। এত দ্রুততম সময়ে এমন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া নজিরবিহীন। সব মিলিয়ে তাড়াহুড়ো, অস্বচ্ছতা ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে। তাই একের পর এক প্রশ্ন উঠছে।’
প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, উভয় চুক্তিই দেশের জন্য বড় ও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অস্বাভাবিক গোপনীয়তায় এগুলোর বিষয়াদি চূড়ান্ত হয়েছে। এতে পরবর্তী সময়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে।
এদিকে আগামীকাল লালদিয়া ও পানগাঁও টার্মিনালের চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রাপ্ত হবে। তার ভিত্তিতে বিনিয়োগকারীকে পিপিপি অনুযায়ী নির্ধারিত সময় দিয়ে নোটিস অব অ্যাওয়ার্ড (এনওএ) প্রদান করতে হবে। বিনিয়োগকারী এনওএ গ্রহণ করলে এককালীন পরিশোধযোগ্য অর্থ ও মূল চুক্তিমূল্যের ১০ শতাংশ পারফরম্যান্স গ্যারান্টি হিসেবে জমা দেবেন। লালদিয়া টার্মিনালের চুক্তির ক্ষেত্রে যা প্রায় ৫ কোটি ডলার সমমূল্যের। পিপিসি অ্যাক্ট অনুযায়ী এ অর্থ জমা দেয়ার পরই কেবল চুক্তি সম্পাদন হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে, বৈদেশিক মুদ্রা জমা না নিয়ে, যথাযথ প্রক্রিয়ার বেশকিছু ধাপ বাদ দিয়ে চুক্তি করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চুক্তিগুলোর বিষয়ে সবকিছু জানতে পারবেন ১৭ তারিখ (নভেম্বর)। ছয় মাস ধরে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আইনজীবী, বিশ্বব্যাংক সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞসহ সবাই চুক্তির প্রক্রিয়াগুলোয় যুক্ত রয়েছেন। চুক্তির আগে কোনো কিছু প্রকাশ করা সম্ভব না। চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার আগে আমার পক্ষে কোনো কিছু বলা সম্ভব না।’
চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে চারটি কনটেইনার টার্মিনাল চালু রয়েছে। এর মধ্যে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), চিটাগং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি), জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি), রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি), যা পতেঙ্গা টার্মিনাল নামে পরিচিত। এর মধ্যে এনসিটি ২০০৭ সালে আংশিক এবং ২০১৫ সালে পুরোদমে চালু হয়। শুরু থেকে চলতি বছরের ৬ জুলাই পর্যন্ত এটি পরিচালনা করেছে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। এখন যা সিডিডিএলের দায়িত্বে।
এ চারটি টার্মিনালের মধ্যে পতেঙ্গা টার্মিনালে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গত বছরের জুনে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল বা আরএসজিটিআইকে অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বাকি তিনটি অর্থাৎ এনসিটি, জিসিবি, সিসিটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জিটুজি (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) পদ্ধতিতে। শুধু এনসিটি নয়, বন্দর কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যতে বে-টার্মিনাল প্রকল্পের টার্মিনালও আমিরাতভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানের হাতে দেয়ার পরিকল্পনা করছে।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) কাঠামোর আওতায় বর্তমানে চালু থাকা এনসিটি ও নতুন তিনটি টার্মিনালে জিটুজি ভিত্তিতে বিদেশী অপারেটর নিয়োগের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছে সরকার। পিপিপি আইনের ২০১৫ সংস্করণে জিটুজি প্রকল্পের বিধান ছিল না। ২০১৭ সালে এ-সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন করা হয় এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালে আইন সংশোধন করা হলে বিদেশী অপারেটর নিয়োগের পথ আরো সুগম হয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের করা এ সংশোধিত আইনের ভিত্তিতেই বিদেশী অপারেটর নিয়োগের কাজ এগোচ্ছে।
বে-টার্মিনাল প্রকল্প হাতে নেয়ার পর মোট নয়টি দেশ ও প্রতিষ্ঠান টার্মিনাল নির্মাণ ও বিভিন্ন কাজে বিনিয়োগ বা আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দেয়। ২০১৯ সালের ৮ জুলাই নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বন্দরের চিঠি অনুযায়ী প্রস্তাব প্রদানকারী দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো হলো নেদারল্যান্ডসের এপিএম টার্মিনালস, চীনের চায়না মার্চেন্টস গ্রুপ, আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড, দক্ষিণ কোরিয়ার ইন্টারন্যাশনাল পোর্ট ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন প্রোগ্রাম, সিঙ্গাপুরের পিএসএ, ভারতের আদানি গ্রুপ, সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক।
এসব প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত জিটুজি বা সরকারি পর্যায়ে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় গড়ায় এবং অন্তর্বর্তী সরকার এখন তার কয়েকটি প্রায় চূড়ান্ত করার পর্যায়ে পৌঁছেছে।
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।
বে-টার্মিনাল ও লালদিয়া অঞ্চলে প্রকৃত বিদেশী বিনিয়োগ এলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে এমন মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ও স্টেকহোল্ডার।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও চট্টগ্রাম বন্দরের বোর্ড সদস্য মো. জাফর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘লালদিয়ার চর ও বে-টার্মিনালে বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে আপত্তি নেই, কারণ সেখানে অবকাঠামো নির্মাণে প্রকৃত বিদেশী বিনিয়োগ আসবে। যদিও নিউমুরিং টার্মিনালে জিটুজি বাদ দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে অপারেটর নিয়োগ করার সুযোগ আছে।’
চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান টার্মিনালগুলোতে বিদেশী অপারেটর নিয়োগের প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুত হচ্ছিল। এখন তা আনুষ্ঠানিক বাস্তবায়নের দিকে এগোচ্ছে। বিশেষ করে এনসিটিতে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে অপারেটর হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত জিটুজির স্বচ্ছতা, প্রতিযোগিতা ও চুক্তির পর্যাপ্ত সুরক্ষা নিশ্চিত হয়েছে কিনা, এ প্রশ্ন সামনে এনেছে।
সীকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, ‘নতুন প্রকল্পে বিদেশী বিনিয়োগ (লালদিয়া ও বে-টার্মিনাল) ইতিবাচক উদ্যোগ। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছতা মেনে হচ্ছে কিনা তা গুরুত্বপূর্ণ। চুক্তির সময় এমন শর্ত যুক্ত করা জরুরি, যা দেশের স্বার্থ রক্ষা করবে। যেসব টার্মিনালে অপারেশনাল কার্যক্রম চলমান, সেগুলো প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে শুধু অপারেশনের জন্য দেশী–বিদেশী যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান নিয়োগই সবচেয়ে যৌক্তিক।’
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে একাধিকবার বার্তা ও মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ও মুখপাত্র ওমর ফারুক ফোন রিসিভ করেননি।
– বণিক বার্তা।