৮.৫ মাত্রার ‘ঘুমন্ত দানব’ পার্বত্য চট্টগ্রামের নিচে, বার্মিজ ফল্টলাইনের হাজার বছরের ঘুম ভাঙছে?
![]()
নিউজ ডেস্ক
শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল ১০:৩৮ মিনিটে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভূকম্পন অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে ৫.৫ থেকে ৫.৭ মাত্রার এই মাঝারি ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদী বা ঘোড়াশালের কাছাকাছি অঞ্চল। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম থেকে তুলনামূলকভাবে নিকটবর্তী দূরত্বে সংঘটিত এই কম্পনটি আবারও বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের মনে সেই চাপা আশঙ্কা জাগিয়ে তুলেছে— এই ভূ-খণ্ড কি কোনো ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক নীরবতা হাজার বছরের। এর নিচে চাপা পড়ে আছে রিখটার স্কেলে ৮.৫ থেকে ৯.২ মাত্রার মতো একটি প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের বিপুল শক্তি। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল এখন সেই মহা-ভূমিকম্পের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, যা যেকোনো মুহূর্তে আঘাত হানতে পারে।
দুই প্লেটের ঘর্ষণ: মহা-বিপদকেন্দ্রে চট্টগ্রাম
ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের অবস্থান প্রধানত দুটি সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে রয়েছে ইন্ডিয়ান প্লেট এবং বার্মা প্লেট (বা ইউরেশিয়ান প্লেটের সাব-প্লেট)। ইন্ডিয়ান প্লেটটি প্রতি বছর পূর্ব দিকে বার্মা প্লেটের নিচে ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছে এবং বার্মা প্লেটটি পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই দুই প্লেটের সংযোগস্থলেই সৃষ্টি হয়েছে বিশাল বার্মিজ ফল্টলাইন বা চ্যুতি।
বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘ গবেষণায় উঠে এসেছে যে এই দুটি প্লেটের ঘর্ষণে এই অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ স্থিতিস্থাপক শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে, যা প্রায় ৪০০ বছর ধরে জমা হচ্ছে বলে অনুমান করা হয়। মূলত এই ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণেই চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকা অঞ্চলকে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
উপকূলের নিচে দুই প্লেটের মরণফাঁদ
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক হুমায়ুন আখতারের দীর্ঘ গবেষণার ফল বলছে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চল দুটি শক্তিশালী টেকটোনিক প্লেটের মিলনস্থল, যা ভূতাত্ত্বিক ভাষায় সাবডাকশন জোন নামে পরিচিত। পশ্চিম থেকে আসা ভারতীয় প্লেটটি ক্রমাগত পূর্বের বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। এই প্লেট দুটির মধ্যে সংঘর্ষের ফলে এই সাবডাকশন জোনের পশ্চিম প্রান্তে, অর্থাৎ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে, বহু বছর ধরে বিপুল পরিমাণ স্থিতিস্থাপক শক্তি জমা হয়ে আছে।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবাণী অনুযায়ী, এই অঞ্চলে গত প্রায় এক হাজার বছরের মধ্যে বড় মাত্রার কোনো ভূমিকম্পের শক্তি পুরোপুরি মুক্ত হয়নি। এই দীর্ঘ নীরবতা সংকেত দিচ্ছে, সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ এখন ধারণক্ষমতার চূড়ান্ত পর্যায়ে। অধ্যাপক হুমায়ুন আখতারের বিশ্লেষণ আরও উদ্বেগজনক: ‘আমরা শুধু জানি এই সঞ্চিত শক্তি এক সময়ে বের হবেই। এর কোনো বিকল্প নেই। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভূমিকম্প অবধারিত।’
সঞ্চিত শক্তি যখন ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে যাবে, তখন সেখানে যে ভয়াবহ ভূমিকম্প হবে, তার মাত্রা রিখটার স্কেলে ৮.৫ থেকে ৯.২ পর্যন্ত হতে পারে।
অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার গবেষণার বিস্তারিত জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের প্রধান দুটি উৎসের মধ্যে একটি হচ্ছে সিলেট থেকে ত্রিপুরা হয়ে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, টেকনাফ পর্যন্ত। এই উৎসটি খুব ভয়ংকর। তিনি আরও বলেন, সাবডাকশন অঞ্চলের পশ্চিম প্রান্তে বাংলাদেশের ভেতরে প্রচণ্ড সংঘর্ষের কারণে প্রচুর শক্তি জমা হয়ে আছে। এই সঞ্চিত শক্তি একবারেও যেমন বের হতে পারে, আবার ধীরে ধীরেও বের হতে পারে।
কাছের ফল্টলাইন সক্রিয়
চট্টগ্রাম এবং এর নিকটবর্তী দূরত্বে বেশ কয়েকটি সক্রিয় ফল্ট বা চ্যুতি রেখা রয়েছে, যা এই অঞ্চলকে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এর মধ্যে প্রধান হলো সীতাকুণ্ড-টেকনাফ ফল্ট এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বরকল ফল্টলাইন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, চট্টগ্রাম, ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তের কাছাকাছি বিস্তৃত বার্মিজ ফল্ট লাইন। যেহেতু ভারতের মিজোরাম এবং মিয়ানমার চট্টগ্রামের খুবই কাছাকাছি, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে, তাই এই অঞ্চলের ফল্টলাইনে সৃষ্ট যেকোনো বড় ভূমিকম্পের সরাসরি আঘাত বাংলাদেশে এসে পড়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।
সাবডাকশন জোনে ছোট কম্পনের ইঙ্গিত
বিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, এই সাবডাকশন অঞ্চলের পূর্ব প্রান্তে প্রায়ই ভূমিকম্প হয়। এখানে সঞ্চিত শক্তি পাঁচ থেকে দশ বছর পর পর বের হয়ে যায় এবং এর মাত্রা থাকে রিখটার স্কেলে পাঁচ থেকে ছয়। সবশেষ যে ভূমিকম্প হয়েছে তারও কেন্দ্র ছিল মিয়ানমারে। গত কয়েক মাসে বার্মিজ ফল্ট লাইনে বারবার ৫-এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়া ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এই স্থানটিতে সঞ্চিত শক্তির মুক্তি অতি সন্নিকটে। ছোট ছোট এই কম্পনগুলো বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস হতে পারে।
চট্টগ্রামের কাছাকাছি বড় ভূমিকম্প
১৯৯৭ সালের ২১ নভেম্বর বিকেল ৪:২৩ মিনিটে (স্থানীয় সময়) সংঘটিত ৬.১ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল ভারত-বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন মিজোরাম রাজ্যে। চট্টগ্রাম নগরীর নিকটবর্তী দূরত্বে হওয়া এই ভূমিকম্পে একটি পাঁচতলা ভবন ধসে ২৩ জন নিহত হয়েছিলেন।
২০২১ সালের ২৬ নভেম্বর ভোর ৫:৪৫ মিনিটে ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন মিজোরামের কাছে ৬.২ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছিল, যা চট্টগ্রাম থেকে তুলনামূলকভাবে নিকটবর্তী দূরত্বে অবস্থিত ছিল।
২০২২ সালের ২১ জানুয়ারি বিকেলে মিয়ানমারের ফালাম শহরে ৫.৪ মাত্রার কম্পন অনুভূত হয়েছিল, যা চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ২২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল।
২০২৩ সালের ২ ডিসেম্বর সকালে রামগঞ্জ, চট্টগ্রাম/ফেনীর কাছাকাছি ৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্প।
১৭৬২ সালের পুনরাবৃত্তি: ১৫০ বছরের মিথ ও ভূতত্ত্বের অংক
ভূ-তত্ত্ববিদদের মধ্যে একটি বহুল প্রচলিত ধারণা রয়েছে, প্রতি ১৫০ বছর পর পর এই অঞ্চলে একটি বড় ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি হয়। এই ধারণার মূলে রয়েছে ১৭৬২ সালের ২ এপ্রিলের এক ভয়াবহ স্মৃতি। ঐতিহাসিক দলিল অনুযায়ী, ওইদিন বিকেল ৫টার দিকে চট্টগ্রাম ও আরাকান উপকূলের মধ্যবর্তী বঙ্গোপসাগরের তলদেশে প্রায় ৮.৫ থেকে ৮.৮ মাত্রার একটি মেগাথ্রাস্ট ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল। এর ফলে চট্টগ্রাম, ফেনী, এমনকি কুমিল্লা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ‘গ্রেট আরাকান আর্থকোয়েক’ নামে পরিচিত ওই ভূমিকম্পে টেকনাফ থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত ৮.৫ মাত্রার কম্পনে সেন্টমার্টিন দ্বীপ তিন মিটার উপরে উঠে এসেছিল এবং বিশাল সুনামির সৃষ্টি হয়েছিল। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৭৬২ সালের সেই মহা-ভূমিকম্পের পর দীর্ঘ প্রায় ২৬৩ বছর কেটে গেছে এবং সেই একই ফল্ট লাইনে আবার বিপুল পরিমাণ শক্তি জমা হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেছেন, ‘বড় ভূমিকম্পগুলো ১৫০ বছর পরপর ফিরে আসার আশঙ্কা থাকে। এদিক থেকে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পগুলো ফেরত আসার সময় হয়ে গেছে।’
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।
তবে বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে সাবডাকশন জোনে বড় আকারের দুটো ভূমিকম্পের মাঝখানে সময়ের ব্যবধান হচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ বছর। এই হিসেবে আরেকটা বড় মাপের ভূমিকম্প বাংলাদেশের দ্বারপ্রান্তে অপেক্ষা করছে।
অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘যে কোনো সময়ে এটা হতে পারে। আগামী ১০ বছরে হতে পারে আবার ৫০ বছরের মধ্যেও হতে পারে।’ তাদের মতে, ১৭৬২ সালের ভূমিকম্পটি ছিল এক বিশাল বিপর্যয়, এবং সেই শক্তির মুক্তির সময়কাল এখন আরও কাছে চলে এসেছে।
দেড় কোটি মানুষ চরম ঝুঁকিতে: প্রয়োজন দ্রুত প্রস্তুতি
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, যদি রিখটার স্কেলে ৭.৫ থেকে ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প চট্টগ্রাম শহরে আঘাত হানে, তবে এক বিশাল মানবিক বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন এবং কর্ণফুলী নদীর পশ্চিম তীর সংলগ্ন বেলে মাটির ওপর নির্মিত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো যেমন বন্দর ও বিমানবন্দর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
তাদের মতে, চট্টগ্রামে প্রায় দেড় কোটি মানুষের বসবাস এবং লক্ষাধিক ভবন, যার মধ্যে স্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল রয়েছে, যা মাঝারি থেকে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকি বহন করছে।
ভূতত্ত্ববিদদের মতে, সরকারকে দ্রুততম সময়ে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড যথাযথভাবে অনুসরণ করে নতুন ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করতে হবে এবং পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে জরুরি ভিত্তিতে সেগুলোর রেট্রোফিটিং করা এখন সময়ের দাবি।
অধ্যাপক হুমায়ুন আখতারের শেষ কথা এটিই: ‘আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় হুমকি সিলেট এবং চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল। কারণ এসব অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে।’
-চট্টগ্রাম প্রতিদিন।