রাঙামাটিতে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আদ্যোপান্ত’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

রাঙামাটিতে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আদ্যোপান্ত’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

রাঙামাটিতে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আদ্যোপান্ত’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

রাঙামাটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ৯৭ এর আদ্যোপান্ত শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার (২২ নভেম্বর) সকালে ডায়লগ ফর পিস অব চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস (ডিপিসি)র আয়োজনে এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। রাঙামাটি প্রেসক্লাব মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক বিশ্লেষক লে. কর্নেল (অব.) এস এম আইয়ুব, প্রধান আলোচক ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক বিশ্লেষক ব্রি. জে. (অব.) ড. আবদুল্লাহ আল ইউসুফ। সভায় মুল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দৈনিক ইনকিলাবের সিনিয়র সাংবাদিক ও পার্বত্য গবেষক সৈয়দ ইবনে রহমত।

সভায় বক্তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) ও তার সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর। যদিও তার প্রস্তুতি চলছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ব থেকেই। একদিকে শান্তিবাহিনীর ধারাবাহিক সশস্ত্র তৎপরতা এবং অন্যদিকে তার প্রতিকারে রাষ্ট্রের পাল্টা পদক্ষেপের ফলে সামরিক-বেসামরিক হাজার হাজার মানুষের জীবন ক্ষয় হয়েছে এই পাহাড়ে। পিতা-মাতা হারিয়ে বহু সন্তান এতিম হয়েছেন, বহু নারী স্বামী হারিয়ে বিধবা হয়েছেন, সন্তান হারিয়েছেন অসংখ্য মা ও বাবা। হামলা-অগ্নিসংযোগে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অগণিত ব্যক্তি ও পরিবার।

বক্তারা বলেন, অবশেষে পিসিজেএসএস-এর সঙ্গে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যে চুক্তিটি ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক চুক্তি’, ‘পার্বত্য চুক্তি’, ‘শান্তিচুক্তি’ ইত্যাদি নামে পরিচিত। চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল পাহাড় থেকে সশস্ত্র তৎপরতার অবসান করে জনজীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও এর অধিবাসীদের ভাগ্যোন্নয়ন। চুক্তি স্বাক্ষরের ২৮ বছর অতিক্রান্ত হলো, কিন্তু এর সুফল কতটা বাস্তবে রূপ পেয়েছে সেটা নিয়ে প্রশ্নের শেষ হয়নি। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী একটি পক্ষ পিসিজেএসএস বলছে, চুক্তির মৌলিক ধারাগুলোই বাস্তবায়ন হয়নি, অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চুক্তির অধিকাংশ ধারাই বাস্তবায়িত হয়েছে। পিসিজেএসএস এবং তার সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠার প্রায় তিন দশক পর চুক্তি হয়েছে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে। তবে এটা ছিল আগের দুটি সরকারের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনার ফসল। ১৯৮৫ সালের ২১ অক্টোবর এরশাদ সরকার শুরু করেছিল এই আলোচনা, পরপর ৬টি বৈঠক করেছিল সেই সরকার। পরবর্তী সময়ে বিএনপি সরকার এই আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যায়, তারা তাদের ক্ষমতায় থাকা পাঁচ বছরে ১৩টি বৈঠক করে পিসিজেএসএস-এর সঙ্গে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভের পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ৭টি বৈঠক করে পিসিজেএসএস-এর সঙ্গে চুক্তিতে পৌছায়। তবে এরশাদ সরকারের আগের সরকারগুলোও এ ব্যাপারে তৎপর ছিল। বিশেষ করে, পিসিজেএসএস ও শান্তিবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা এম এন লারমার ১৯৭৫ সালে বাকশালে যোগদান, পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে ট্রাইবাল কনভেশন গঠন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা, কালচারাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা, এম এন লারমার ছোট ভাই এবং বর্তমান আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমাকে (সন্তু লারমা) জেল থেকে মুক্তি প্রদান সেই সময়কার সরকারগুলোন তৎপরতার স্বাক্ষর বহন করে। এতে বোঝা যায়, সশস্ত্র তৎপরতা বন্ধ করে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সরকারেরই কোনো না কোনো প্রচেষ্টা ছিল। শেষ পর্যন্ত চুক্তিও হলো, তারপর ২৮ বছর পেরিয়ে গেছে, কি শান্তির স্বপ্ন এখনো পরিপূর্ণ ডানা মেলতে পারলো না।

বক্তারা আরও বলেন, স্বাক্ষরকালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং তাদের মিত্র কয়েকটি রাজনৈতিক দল বাদে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল এটিকে একটি দেশবিরোধী ও অসাংবিধানিক চুক্তি বলে আখ্যায়িত করেছিল। বিশেষ করে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট এই চুক্তিকে কালো চুক্তি আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে লংমার্চ পর্যন্ত করেছে এবং ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে এই চুক্তি বাতিল করা হবে বলে তারা জানিয়েছিলেন। চুক্তির পর আওয়ামী লীগ তিন বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় ছিল। সেই সময় চুক্তির আলোকে তারা তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন (১৯৯৮) সংশোধন করেছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন-১৯৯৮ প্রণয়ন করেছে, পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১ প্রণয়ন করেছে। তবে সম্পূর্ণ চুক্তি তারা বাস্তবায়ন করেননি। অপরদিকে ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয়জোট ক্ষমতায় আসার পর চুক্তি বাতিল না করে বরং সবকিছুই চলমান রেখেছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবারো সরকার গঠনের পর টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও তারা তাদের নিজেদের করা চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করেনি।

বক্তারা জানান, উচ্চ আদালতের মূল্যায়ন হাইকোর্টে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক চুক্তিকে চ্যালেঞ্জ করা রিট আবেদন নম্বর ২০১০ সালের ১২ ও ১৩ এপ্রিল দুই দিনব্যাপী এক ঐতিহাসিক রায় দেন আদালত। দীর্ঘ শুনানি শেষে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীকে নিয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পর্কে বলেন, ‘বহু- বৈচিত্র্যময় শান্তিচুক্তিটি সংবিধানের অধীন বর্ণিত চুক্তির অন্তর্ভুক্ত নয়। দীর্ঘদিন ধরে চলমান শান্তি প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট এই আন্তঃরাষ্ট্রীয় শান্তিচুক্তিটি মূলতঃ সংবিধান সংশ্লিষ্ট নয় এবং সাংবিধানিক বিবেচনার বাইরে থেকেই এর প্রকৃতি ও বৈধতা নির্ধারণ করতে হবে। তাছাড়া শান্তিচুক্তি স্বাভাবিক কার্যকারিতা হারিয়েছে কারণ, এই চুক্তিটি পরবর্তীকালে ৪টি (তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ) আইনে পরিবর্তি হয়েছে। এ কারণে শান্তিচুক্তির বৈধতার প্রশ্নে আদালতের কিছু বিবেচনার প্রয়োজন নেই। কারণ শান্তিচুক্তি শর্তগুলো উক্ত ৪টি আইনের মাধ্যমে কার্যকর হয়েছে। ফলে আদালত শান্তিচুক্তির পরিবর্তে চুক্তির শর্ত মোতাবেক প্রণীত আইনগুলো সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করে রায় প্রদান করছে।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।

পার্বত্য চুক্তির গ-খণ্ডের আলোকে প্রণীত আঞ্চলিক পরিষদ আইন সম্পর্কে আদালতের বক্তব্য হচ্ছে, ‘আঞ্চলিক পরিষদ আইনের ধারা ৪১-এর মাধ্যমে আইন প্রণেতাদের ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেয়ার উদ্দেশ্যকেই প্রকাশ করে রাষ্ট্রের একক স্বত্বাকে খর্ব করার উদ্দেশ্যেই আঞ্চলিক পরিষদ আইনের ধারা ৪০ এবং ৪১ ইচ্ছাকৃতভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও আঞ্চলিক পরিষদ আইন সংবিধানের ১ নম্বর অনুচ্ছেদে রক্ষিত রাষ্ট্রের এক চরিত্র হিসাবে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে বিনষ্ট ও ধ্বংস করেছে। বাদী এবং বিবাদী পক্ষের যুক্তিতর্ক সংবিধানের ৮ম সংশোধনী মামলার মতামত ও পর্যবেক্ষণ থেকে আদালত সিদ্ধান্তে আসে যে, আঞ্চলিক পরিষদ আইনটি রাষ্ট্রের একক চরিত্র ধ্বংস করেছে বিধায় এটি অসাংবিধানিক। এ ছাড়াও সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ মোতাবেক এই আঞ্চলিক পরিষদ কোনো স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা নয়। এর কারণ হচ্ছে যে, পরিষদ আইনে আঞ্চলিক পরিষদকে প্রশাসনিক কোনো ইউনিট হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়নি।’

গোলটেবিল আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন ডিপিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক হারুন অর রশীদ এবং এবং সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন সুজন। সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন রাঙামাটি আসনে জামায়াত মনোনীত প্রার্থী ও জেলা আইনজীবি সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মোখতার আহমেদ, জেলা পিপি অ্যাডভোকেট প্রতীম রায় পাম্পু, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও জেলা জজ আদালতের জিপি অ্যাডভোকেট মামুনুর রশিদ, রাঙামাটি আসনে জাতীয় নাগরিক পার্টি মনোনীত প্রার্থী বিপিন জ্যোতি চাকমা, সিনিয়র অ্যাডভোকেট মিহির বরণ চাকমা, খাগড়াছড়ি জেলা আইনজীবি সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল মালেক মিন্টু, ডিপিসির ভাইসচেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুল গাফফার মুন্না, জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মো. আইয়ুব চৌধুরী প্রমূখ।

-পার্বত্য নিউজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *