শোকাবহ বেতার বার্তা - Southeast Asia Journal
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

লাইসা ত্রিপুরা

ঊনিশ’শ পঁচাত্তর সালের ষোলই আগস্ট। সকাল আটটা। তখন আমি জুনিয়র হাই স্কুলে সহকারি শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করতাম। আমাদের গ্রাম, স্কুলটি থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে আর খাগড়াছড়ি বাজার থেকে অত্যন্ত ১৩ কিলোমিটার দুরত্ব হবে। স্কুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়ার মুহূর্তে গ্রামবাসী বেতারে প্রচরিত সংবাদের অনুবাদ মাতৃভাষায় শুনতে চায়। গ্রামে ছিল মাত্র একটা রেডিও বা বেতার। গ্রামবাসীরা রেডিও বলতে পারে না, বলে রেদু। বেতার থেকে প্রচারিত খবর শোনার পর সাথে সাথে মাতৃভাষায় বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমার। এই ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ককবরক। পনেরো আগস্টের মধ্য রাতে সংঘটিত ঘটনার নির্মম সংবাদ শুনে সহজ সরল এই গ্রামবাসী কিছুক্ষণ নির্বাক থাকে। নিরবতা ভাঙ্গতে লেগেছে বেশ কিছুক্ষণ। একসময় সংবাদ শেষ হয়। জুম চাষের উপর নির্ভরশীল এই জুমিয়া পরিবারগুলো জুম মৌসুম শ্রাবণের এই সময়ে নিজ নিজ জুম চাষে ব্যস্ত থাকে। মন সায় না দিলেও একে একে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে যার যার জুম পাহাড়ে জীবিকার তাগিদে কাজে চলে গেল। শোকবহ বার্তা এখনও তাদের নিয়ে ভর করে আছে। কাজের মধ্যে বলাবলি করল, যিনি এই দেশকে পাকিস্তানি হানাদার শত্রুদের কবল থেকে মুক্ত করলেন তাঁকে হত্যা করতে খুনিদের বিবেক কেন একটুও বাধলো না ? জঘন্য হত্যাকারীদের পাষন্ড মন কেমন নিষ্টুর, ভাবতে লাগল গ্রামবাসীরা। শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নন, তাঁর স্ত্রী ছেলে পরিবার আত্মীয়বর্গ কেউ রেহাই পেলেন না। নিয়তির জোরে বেঁচে গেলেন শুধুমাত্র দু’কন্যা শেখ হাসিনা (যিনি বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে অবস্থান করার কারণে। সংবাদ শোনার পর সেদিন স্কুলে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েও যেতে উদ্যত হয়ে গেলাম না। এ শোকাবহ বার্তাসহ প্রচারিত হলো সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত বন্ধের ঘোষণা। গ্রামবাসীদের মধ্যে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়েছে এমন একজন আমার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল, শেখ মুজিব নাকি এ বাংলাদেশের জাতির জনক ? এ উত্তরে বললাম- হ্যাঁ ঠিকতো । কেননা ঊনিশ’শ একাত্তর সালে স্বাধীনতার সংগ্রামের আহবান করলেন তিনিই। তাঁরই আহবানে নয় মাস সংগ্রাম চললো। শেখ মুজিব যদি এ আহবান না করতেন এ বাংলাদেশে জন্ম হতো না। এখনো এ বাংলাদেশ পাকিস্তান রয়ে যেতো। পাকিস্তানীরা এ দেশের জনগণকে আরো শোষণ নির্যাতন করতো। এমনই আলাপ-আলোচনা চলতে থাকলো প্রায় মাস খানেক। গ্রামবাসীদের অনেকের মনে এ শোকবহ বার্তা শুনে কারও মনে সুখ ছিল না। তাদেরকে বোঝানোর মতো কোন ভাষা সেদিন আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি নিজেই শোকহত, মর্মাহত। এই মহান জাতির জনক, তাঁরই পরিজন, আত্মীয়বর্গ নিহত সকলের জন্য গ্রামবাসীদের ডেকেই শোকসভা আয়োজন করলাম ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুসহ নিহত তাঁর আত্মীদের আত্মার শান্তি কামনার্থে স্রষ্টার নিকট প্রার্থনা করলাম।