৮০ সন্তানের রত্নগর্ভা মা কৃতাং ম্রো!!!
 
মোঃ সাইফুল ইসলাম
৮০ সন্তানের মা! এ ও কি সম্ভব! শুনতে অবাক লাগলেও বান্দরবান পার্বত্য জেলার লামা উপজেলার দুর্গম পাহাড়ী জনপদ চংকক স্রো পাড়ার কৃতাং ম্রো মায়ের মতোই ৮০ জন শিশুকে দেখভাল করছেন। কৃতাং ম্রো ঐ ৮০টি শিশুর শুধুই যে দেখভাল করছেন তা কিন্তু নয়, আলোকিত মানুষ হবার প্রত্যয়ে পরিবার ছেড়ে আসা ৮০জন শিশুর ভালো বন্ধু ও ভরসার একমাত্র আশ্রয়স্থলও এই কৃতাং ম্রো। যার স্নেহ, মায়া, মমতায় ধীরে ধীরে ৮০টি শিশু এগিয়ে যাচ্ছে আলোর দিকে, আলোকিত মানুষ হতে। যারা স্বপ্ন দেখছে, শিক্ষিত হয়ে একদিন নেতৃত্ব দিবে দুর্গম পাহাড় তথা পুরো বাংলাদেশের।
বান্দরবান পার্বত্য জেলার লামা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৩-১৪ কিলোমিটার দূরে দূর্গম চংকক ম্রো পাড়া। যেখানে যাওয়ার একমাত্র পন্থা পায়ে হাঁটা।তবে সাম্প্রতিক সময়ে ৮-১০ কিলোমিটার পর্যন্ত মোটরসাইকেল যোগে যাওয়া সম্ভব। এরপর থেকে দূর্গম পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে অনেক ঝিরি আর পাহাড়ী ছড়া ডিঙ্গিয়ে চংকক ম্রো পাড়া পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়। এলাকাটি এতটাই দুর্গম যে, শহুরে চাকচিক্য আর আধুনিকতার ছোঁয়া এখনো সেখানে পৌঁছায়নি। শুনে অবিশ্বাস্য হলেও ডিজিটাল বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেখানে নেই কোন পরিবহণ সুবিধা, নেই কোন সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নেই কোন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এমনকি একটি বাজারও নেই যেখানে, দুর্গম সেই এলাকাতেই গড়ে উঠেছে পাওমুম থারক্লা বিদ্যালয়। ঐ এলাকার অনগ্রসরতা আর দূর্গমতার কারণেই শিক্ষার আলো পৌঁছাতে পারেনি যুগের পর যুগ। অনেকটা শিক্ষা বঞ্চিতভাবেই ওদের শিশুরা বেড়ে উঠছিলো। দুর্গম ঐ পাহাড়েরই স্বপ্নবাজ তরুণ মেং রুং ম্রো’র একান্ত প্রচেষ্টা আর একাগ্রতায় সেখানে গড়ে উঠেছে বিদ্যালয়টি। বলতে গেলে স্বেচ্ছাশ্রমে গড়ে ওঠা বিদ্যালয়টিতে একাই পাঠদানসহ যাবতীয় দেখভাল করছেন মেং রুং ম্রো।
২০১২ সালের শুরুতে স্থানীয় মুরং শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখলেও স্থানীয় কার্বারী চংকক ম্রো ও হেডম্যান সিংপাশ ম্রো লুলাইং’র সহযোগীতায় সেই স্বপ্ন আলোর মুখ দেখে ২০১৬ সালে। স্থানীয়দের দানকৃত জমিতে এলাকাবাসীর উদ্যেগে সেদিন গড়ে উঠেছিলো বাঁশ আর শন দিয়ে তৈরী বিদ্যালয়ের ঘর। শুরুতে স্বল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে পথচলা শুরু হলেও বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে পড়াশুনা করছে ৮০ জন শিক্ষার্থী। বিদ্যালয় থেকে বাড়ির দূরত্ব বেশী হওয়ায় সেখানেই গড়ে তোলা হয়েছিলো আবাসিক ব্যবস্থা। তবে প্রাকৃতিক ঝড়ে বেশ কয়েকবার আবাসিক হোস্টেলটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ঘুরে দাঁড়াতে সময় নেয়নি মেন রুং ম্রো।
নৈতিক শিক্ষাদানের জন্য মাসিক একটি অভিনব আয়োজন করা হয় বিদ্যালয়টিতে। প্রতিমাসে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্লাষ্টিক সামগ্রী কুড়ানোর প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থী এবং একই সাথে স্থানীয়দের মধ্যে এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়ে উৎসাহিত করা হয়। শিক্ষার্থীরা স্কুল প্রাঙ্গন, আবাসিক হোস্টেল এবং আশেপাশের পাড়া/গ্রাম এলাকায় মাসের ১ম সপ্তাহের ১ম ছুটির দিনে অযাচিতভাবে বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা প্লাষ্টিক কুড়িয়ে জমা করে। সর্বোচ্চ প্লাষ্টিক সংগ্রহকারী ৩জন শিক্ষার্থীকে উৎসাহ দেবার জন্য পুরস্কৃত করা হয়।

বর্তমানে পাওমুম থারক্লা বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিতে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন স্থানীয় পাড়া প্রধান (কার্বারী) চংকক ম্রো। তার নামেই পাড়াটির নামকরণ করা হয়েছিলো। আর পাওমুম থারক্লা’য় অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের মায়ের দায়িত্ব পালন করছেন চংকক ম্রো’র স্ত্রী কৃতাং ম্রো। একটি আদর্শ পরিবারের মায়ের মতোই কৃতাং ম্রো দুর পাহাড়ের পাওমুমে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করছেন ৮০টি পরিবার থেকে আলোকিত মানুষ হতে পাওমুমে আসা ৮০জন শিক্ষার্থীকে। মেন রুং ম্রো সেখানকার স্বপ্নদ্রস্টা হয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা বা বাজার করার কাজ করলেও বিদ্যালয়টিতে পড়াশুনা করা ৮০ জন শিশুর সার্বিক দেখা-শুনার দায়িত্ব কৃতাং ম্রো।
শিশুদের দিনের শুরুতে ঘুম থেকে উঠানো থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পর তাদের সার্বিক খেয়াল পর্যন্ত একজন দায়িত্বশীল মায়ের কর্তব্য পালন করে আজকের শিশুদের আগামীর ভবিষ্যৎ হিসেবে গড়ে তুলতে কৃতাং ম্রো’র ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রতিদিন কাক ডাকা ভোরে উঠে শিক্ষার্থীদের জন্য ভাত রান্না, সবজি রান্না, কখনো ডাল কিংবা ডিম রানা করে খাবার পানি সংগ্রহ করে সকাল ৬টায় শিশুদের ঘুম থেকে তুলে ব্রাশ করানো, গোসল করানো, জামা-কাপড় পড়ানোটা কৃতাং ম্রো’র প্রাত্যহিক প্রাথমিক কাজ। এরপর শিশুদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করে কৃতাং ম্রো নেমে পড়েন আরেক অভিযানে। ৮০ জন শিক্ষার্থীর ময়লা জামা-কাপড় ধুয়ে রোদ্রে শুকাতে দিয়ে তিনি নেমে পড়েন দুর্গম পাহাড়ে সবজির সন্ধানে। পাহাড়ী কচুর লতি, ঢেকি শাক, কচু শাক, মাটির আলু, থানকুনিসহ বিভিন্ন ধরণের সবজি সংগ্রহ করে তাকে আবার খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই ফিরতে হয় হোস্টেলে। নিজের সামান্য বিশ্রামের কথা চিন্তা না করেই আবার দুপুরের খাবার তৈরী করতে রান্নায় মনযোগ দিতে হয় তাকে। এরপর আবারো পাহাড়ী কুয়া থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করে দুপুর বারোটায় ৮০জন শিক্ষার্থীকে পর্যায়ক্রমে খাবার খাইয়ে পুনরায় তাকে নামতে হয় মাঠে। সকালে ধুয়ে দেওয়া কাপড় গুলো যার যার কাছে পৌঁছে দিয়েই তবে ফিরেন আপন আলোয়। এরপর আবার সন্ধ্যায় রান্নাঘরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য রান্না করতে হয় তাকে। শুধু রান্না করেই চলে যেতে পারেন না কৃতাং ম্রো, খাবার পানি সংগ্রহ করে শিক্ষার্থীদের সন্ধ্যায় সোলারের আলোয় পড়াশোনা তদারকির পর রাতে খাবার খাইয়ে তাদের ঘুমাতে দিয়ে তারপর ক্ষান্ত হন তিনি। এছাড়া প্রায় সময় অসুস্থ হয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের সেবা করা, চিকিৎসার দেখাশুনা করার দায়িত্ব এই আদর্শ মায়েরই। ক্লান্তি যেন স্পর্শ করতেই পারেনা ৮০জন শিশুকে আগলে রাখা কৃতাং ম্রো’কে।
এর বাইরেও নিয়মিত পাহাড়, বন-বনানী চষে রান্নার জন্য লাকড়ি সংগ্রহ, পাহাড়ের আনাছে-কানাছে জন্মানো গাছ থেকে শিশুদের জন্য ফল-ফলাদি সংগ্রহ করা, ১৩-১৪ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে মাঝে-মধ্যেই শিশুদের জন্য বাজার করে আনা যেন কৃতাং ম্রো নিত্যনৈমত্তিক কাজ।
দেশে প্রতিবছর অনেক জয়িতা মা’কেই রত্নাগর্ভা হিসেবে পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়। সেসব মায়েরা হয়তো তার সন্তানদের নানা বিপত্তি অতিক্রম করেই মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। কিন্তু নিজ গর্ভে ধারণ না করেও দুর্গম অঞ্চলে পাওমুমের ৮০জন শিশুকে নিজ মায়ের মতো ভালোবাসা দিয়ে, দিনরাত পরিশ্রম করে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলা কৃতাং ম্রো হয়তো একজনই।
