দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার দেশ লাওস কিভাবে করোনায় মৃত্যু এড়াতে পারলো? - Southeast Asia Journal

দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার দেশ লাওস কিভাবে করোনায় মৃত্যু এড়াতে পারলো?

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

পারভেজ হায়দার

নয়নাভিরাম পাহাড়, সবুজে ঘেরা সমতল ভূমি আর ছোট ছোট নদী পরিবেষ্টিত দক্ষিন এশিয়ার ছোট্ট দেশ লাওস। সারাবিশ্ব যখন করোনা মহামারি মোকাবেলায় ব্যতিব্যস্ত ঠিক তখন লাওস সফল ভাবে এ পর্যন্ত মৃত্যু এড়াতে পেরেছে; অথচ সম্পূর্ন স্থলবেষ্টিত এই দেশটির চারপাশে রয়েছে থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, চীন, ভিয়েতনাম আর কম্বোডিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলো। লাওস দেশটি একদলীয় শাসন ভিত্তিক সমাজতন্ত্র প্রভাবিত দেশ। লাওসের একমাত্র রাজনৈতিক দল লাও পিপলস রেভুল্যুশন পার্টি (এলপিআরপি) মার্ক্সিজম ও লেলিনিজম তত্ত্বে বিশ্বাসী। এই দেশটির সাথে চীনের বেশ ভালো সম্পর্ক ও যোগাযোগ রয়েছে। কিন্তু করোনার প্রশ্নে এই দেশের এ’পর্যন্ত সফলতার কারণ কি শুধু রাষ্ট্রীয় সু-ব্যবস্থাপনার প্রভাব আর চীনের সহযোগীতা নাকি সাধারন জনগনেরও এই সাফল্যের পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে?

ছবি-১: লাওসের মানচিত্র।

আসুন জেনে নেয়া যাক, লাওস দেশটির সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন আচরণ কেমন! এই দেশের মানুষ অভ্যাসগত ভাবে অনেক আগে থেকেই মাস্ক ব্যবহার করে। তারা মনে করে একজনের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস কিংবা নিশ্রিত তরল পদার্থের মাধ্যমে অন্যের জন্য অহেতুক বিরক্তির কারন সৃষ্টি সমীচিন নয়। এছাড়া সাধারণত এদেশের মানুষকে কারো সামনে কখনো হাঁচি, কাশি বা সর্দি ফেলতে দেখা যায় না। এমনকি, এদেশের মানুষ এতটাই সচেতন যে কখনোই কাউকে রাস্তায় থু থু ফেলতে দেখা যায় না।

লাওসের মানুষ অর্গানিক খাবার গ্রহণ আর নিয়ন্ত্রিত জীবন ব্যবস্থায় অভ্যস্ত। তারা থানকুনি পাতা, পুদিনা পাতা লেবু পাতাসহ বিভিন্ন প্রকার ভেষজ খাবার গ্রহন করে থাকে। ব্যাপারটা এমন, এই ধরনের জীবন ব্যবস্থায় তারা অনেক আগে থেকেই অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে।

এই দেশে গণপরিবহণ ব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে। গণপরিবহণগুলোতে যাত্রী খুব কম দেখা যায়। এখানকার অধিকাংশ মানুষই সাইকেল, মোটরসাইকেল কিংবা যাদের সামর্থ আছে তারা ব্যক্তিগত মোটরগাড়ি নিয়ে চলাচল করে। তাই এক ব্যক্তির সাথে অন্য ব্যক্তির সরাসরি সংমিশ্রনের সম্ভাবনা অনেকটা কম থাকে।

ছবি-২: লাওসের সাধারণ মানুষের  অর্গানিক খাবারগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি মেন্যু

লাওসের মানুষ সবসময় পরিপাটি ভাবে জীবন-যাপন করতে পছন্দ করে। উচ্চ কিংবা নিম্ন যে পেশায়ই থাকুক না কেন, এদেশের মানুষ একদিন পরিধান করা পোশাক পরবর্তীতে আবার না ধৌত করে পরিধান করে না। এমনকি এই অভ্যাসটি বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় গৃহ পরিচারিকা হিসেবে কর্মরত মেয়েদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রতিদিন কাজে আসার সময় তারা পরিষ্কার, ইস্ত্রি করা কাপড় পরে। তারা যে যেই পেশায়ই থাকুক না কেন প্রতি শনিবার এদেশের মানুষ নিজেদের কাপড়-চোপড় ধৌত করে রোদে শুকাতে দেয়। এই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নিম্ম পদবীর কর্মকর্তা-কর্মচারীগণও নিজ নিজ এলাকায় যোগদান করে।

এই দেশের মানুষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে এতটাই সচেতন যে, অফিসে প্রবেশ করার পর কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ প্রত্যেকেই নিজেদের পরিহিত জুতা পরিষ্কার করেন, যাতে জুতায় ধুলাবালি না থাকে এবং অনেকটা চকচকে দেখায়। অফিসে প্রবেশের পর মহিলা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রাথমিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পর লিপষ্টিকসহ সামান্য মেকআপ করে তারপর কাজকর্ম শুরু করেন। এই ভাবে পরিপাটি ও সুন্দরভাবে নিজেদের উপস্থাপন করার অভ্যাস গড়ে উঠায় অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনোবল সবসময় চাঙ্গা থাকে। বর্তমানে করোনার কারণে অফিসে প্রবেশের পূর্বেই প্রয়োজনীয় জীবানুনাশক ব্যবহার করে অফিস কক্ষ জীবানুমুক্ত করা হচ্ছে।

ছবি-৩: লাওসের প্রাকৃতিক দৃশ্য

সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত অভ্যাস ছাড়াও লাওস দেশটি সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। এই দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে কম কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। যান্ত্রিকতামুক্ত জীবনধারা, গাছপালা সংরক্ষনে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া আর সাধারন মানুষ অর্গানিক দ্রব্য ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়াই এর বড় কারণ বলে অনুমেয়। তথাপি এই দেশের মানুষের মাথাপিছু বাৎসরিক আয় ১৯৫০ ডলার, যা বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয়ের চেয়ে বেশী। তবে এটা ঠিক ২ লক্ষ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটিতে মাত্র ৭০-৮০ লক্ষ লোকের বসবাস, অথচ ১ লক্ষ ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বসবাস। বাংলাদেশের জন্য বিষয়গুলো অত সহজ নয়। লাওস দেশটির জিডিপি (পিপিপি) দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চতুর্থ, অর্থাৎ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া আর থাইল্যান্ডের পরেই এর অবস্থান। এই দেশ নিজেদের বনভূমি থেকে উৎপাদিত কাঠ আর বিভিন্ন প্রকার অর্গানিক দ্রব্য সামগ্রী রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে।

আবহাওয়ার দিক থেকে লাওসের সাথে বাংলাদেশের যথেষ্ট মিল রয়েছে। তবে দিনের বেলায় বেশ গরম পড়লেও রাতের বেলায় পাহাড় আর বিপুল বনভূমি বেষ্টিত লাওসের আবহাওয়া বাংলাদেশের তুলনায় ঠান্ডা থাকে।

এবার আসা যাক লাওস সরকারের করোনা সংশ্লিষ্ট প্রস্তুতির কথায়। এই দেশে এ পর্যন্ত করোনায় কেউ মৃত্যুবরণ না করলেও শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক সীমান্ত ও বন্দর সমূহে সতর্ক ব্যবস্থাপনা গ্রহন করা হয়েছিলো। এছাড়া আভ্যন্তরীন বিভিন্ন বিষয় সমূহে ব্যাপক পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিলো। এই দেশ কোন প্রকার লকডাউনে যায়নি। তবে কিছু কিছু নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। যেমন, ৫০ জনের অধিক কোন সমাবেশ করা যাবে না, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ থাকবে ইত্যাদি। রেষ্টুরেন্টগুলো খোলা রাখার আদেশ থাকলেও নাইট ক্লাবগুলো বন্ধ রাখার আদেশ রয়েছে। অবশ্য সাধারণ মানুষের চাহিদার কথা চিন্তা করে কিছু কিছু নাইট ক্লাব চালু রয়েছে। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে এই দেশে কেউ আসতে চাইলে, তাকে সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট কিছু হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঐ ব্যক্তি লাওসে পৌঁছানোর পর নির্দিষ্ট হোটেলে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন। কোয়ারেন্টাইনে থাকা অবস্থায় তার খাবার ও অন্যান্য সামগ্রী তার রুমে পৌঁছে দেয়া হবে। কিন্তু সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হোটেলগুলো উচ্চমানের হওয়ায় সার্বিক ব্যয় বেশী হয়ে থাকে। তবে সার্বিক ব্যয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকেই বহন করতে হয়। ফলশ্রুতিতে একেবারে জরুরী কোন প্রয়োজন না হলে শুধুমাত্র চিত্ত বিনোদনের জন্য দেশটিতে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে ভ্রমন প্রকারান্তরে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

ছবি-৪: লাওসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

চীনের সাথে লাওসের সম্পর্ক অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ন ও মধুর। করোনা ভাইরাস সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে চীন থেকে লাওসে একটি টাস্কফোর্স পাঠানো হয়েছে বেশ আগেই। ঐ টাস্কফোর্স লাওস সরকারকে করোনা সংক্রান্ত বিষয়ে ক্রমাগত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই করোনাকে প্রাধান্য দিয়ে একটি বাজেট প্রনয়ন করেছে। এছাড়া বাংলাদেশে করোনা মহামারি সংক্রমনের শুরু থেকেই বিভিন্ন সচেতনতামূলক ও কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়েছিলো। ফলশ্রুতিতে ঘনবসতিপূর্ন বাংলাদেশে তুলনামূলক ভাবে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা কম। এদিকে লাওস সরকারও করোনা মহামারিকে সামনে রেখে সেদেশের জনগনের জন্য বেশ কিছু প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করেছে। লাওসের জনগনের জন্য সামগ্রীক আয়কর হ্রাস করা হয়েছে। গাড়িসহ অন্যান্য বিষয়ে যেখানে সরকার নিয়মিত কর গ্রহন করতো, প্রতিটি বিষয়েই সময় বাড়ানো হয়েছে অথবা অন্যান্য সুবিধাদি নিশ্চিত করা হয়েছে। লাওসের সরকারের পক্ষে দেশের জনগনের জন্য যতটুকু প্রনোদনা দেওয়া সম্ভব, ১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশের সরকারের পক্ষে একই মাত্রায় প্রনোদনা দেওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া দীর্ঘ অভ্যাসগত ভাবেই লাওসের সাধারণ মানুষ সরকারী আদেশ-নির্দেশনা যেভাবে অনুসরণ ও মান্য করে, একই ভাবে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে সেই ধরণের সুশৃঙ্খল আচরণ প্রদর্শন করা কঠিন। তারপরেও আশার আলোয় আমাদের বেঁচে থাকা। করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশের জনগনের মধ্যেও অনেক সচেতনতা এসেছে। তবে লাওসের সাধারণ মানুষদের মতো ব্যক্তিগত পর্যায়ে যদি আমাদের দেশের মানুষগুলোর মাঝেও সচেতনতা গড়ে উঠতো, তাহলে দেশের সরকার ও প্রশাসনের জন্যও সামগ্রিক বিষয় নিয়ন্ত্রন করা সহজতর হতো।