প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধিঃ একটি পুনর্বিচার
 
সাদ্দাম হোসেন
প্লাস্টিক একুশ শতকের সভ্য সমাজের মাথাব্যথার অন্যতম এবং মৌলিক একটি কারণ। এটা নিশ্চিত যে, প্লাস্টিক পরিবেশের বাস্তুসংস্থানে বা ইকোসিস্টেমে বেশ প্রভাব বিস্তার করে। কারণ, একটি হাঁড় বা উদ্ভিদের অঙ্গ যেভাবে মাটিতে পঁচে যায় বা বিলীন হয়ে যায় বিভিন্ন প্লাস্টিক সামগ্রী ঠিক তার বিপরীত, সে সহজে পঁচে যায় না এবং দীর্ঘদিন মাটির ভেতর শক্তি সঞ্চয় করতে পারে, অনেকাংশে আরো বেশি মজবুত হয়। আবার, সাগর-নদী, বা সর্বোপরি পানিতে জলজপ্রাণীর জন্য এ এক ত্রাস। অর্থাৎ, প্লাস্টিক আমাদের যতই না উপকারি তারচে’ ঢের ক্ষতিকারক বস্তু হিসেবে অনস্বীকার্য এবং তার ব্যবহারে পুনবিচার্যের প্রয়োজন রয়েছে। উদ্ভিদকূল, জলজ প্রাণী, দ্বীপাঞ্চলের প্রাণীরা প্লাস্টিক বর্জ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে নিয়মিত৷ মূলত প্লাস্টিক বর্জ্য প্রাণীর বাসস্থান, খাদ্য সংগ্রহের স্থান ও উদ্ভিদের খাদ্য গ্রহণের পথে বাধার সৃষ্টি করে। শুধুমাত্র উদ্ভিদ বা জলজ প্রাণী নয়, মানুষ প্লাস্টিক দূষণের কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ৷ মানষের থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত ক্ষরণের জন্য এই প্লাস্টিক দূষণ পরোক্ষভাবে দায়ী৷ আমাদের পরিবেশে যত্রতত্র প্লাস্টিকের ছড়াছড়ি প্রকৃতপক্ষে আমাদেরকেই নিশ্চিত ক্ষতির মুখোমুখি করতেছে, যা বিরাজমান সভ্যতা এবং জলবায়ুর জন্য অশনি সংকেত। স্পষ্টত প্রতীয়মান যে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে।
এই প্লাস্টিক-দূষণ সাগর বা সমুদ্রের জন্য এক ভয়াবহ ত্রাসে পরিণত হচ্ছে নিয়মিত। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, নদীর জলের মাধ্যমে ভেসে প্লাস্টিক পণ্য-সমূহ সাগরে জমা হচ্ছে, এবং পর্যটকের অসৎ আচরণের সম্মুখীন হয়ে সাগর-সমূহ প্লাস্টিকে সমৃদ্ধ হচ্ছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক জমা হয়েছে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ এবং ক্যালিফোর্নিয়ার মাঝের বিস্তৃত অংশে। এই প্লাস্টিকের স্তূপের নামই বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন ‘গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ’। যা আয়তনে টেক্সাসের দ্বিগুণ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমেরিকার তিনটি বৃহত্তম শহরের মধ্যে অন্যতম হলো টেক্সাস। তবে এখানেই শেষ নয়। ফ্রান্সের তুলনায় এই গারবেজ প্যাচ আয়তন তিনগুণ বড়। এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই আঁতকে উঠছেন বিশ্ববাসী। এই প্লাস্টিক শুধুমাত্র আমেরিকাতে প্রতিবছর ৫ মিলিয়ন টন ব্যবহৃত হয় ৷ এগুলোর মধ্যে মাত্র ২৪ শতাংশ পুনঃচক্রায়ন হয়ে থাকে ৷ অন্য ৩.৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য আকারে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়। বিশ্ব জ্ঞানকোষ উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, ২০০৪ সালে যুক্তরাজ্যের প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্ড থম্পসন গবেষণার মাধ্যমে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, এন্টার্কটিকা অঞ্চলের সাগরের পানিতে প্রচুর পরিমাণে মাইক্রোবর্জ্য খুঁজে পান। থম্পসন ও তার সহযোগীরা ঐ অঞ্চলের পানিতে গৃহস্থালি ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ভাঙ্গা অংশ খুঁজে পান, যার কিছু মানুষের চুলের থেকেও ক্ষুদ্র৷ থম্পসন সেখানকার সমুদ্র পৃষ্ঠের থেকে সম্ভবত ৩,০০,০০০ প্লাস্টিক উপাদান/কিমি এবং সমুদ্রতলদেশ থেকে ১০০,০০০ প্লাস্টিক কণা/কিমি মাইক্রো প্লাস্টিক বর্জ্য পান। ম্যাক্রোবর্জ্য প্রায়ই সমুদ্রের জলের মধ্যে পাওয়া যায় যা সামুদ্রিক জীবের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে৷ এতে প্রধানত মাছ ধরার জাল দূষণ হয়ে থাকে।বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন রিপোর্টে ওঠে আসতেছে, প্রতি বছর নদী থেকে সাগরে এসে জমা হয় ১.১৫ থেকে ২.৪১ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক। গবেষক Marcus Eriksen’র (ডিসেম্বর ১০, ২০১৪) তথ্য মতে, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে যে পরিমাণ তারা আছে, সুমুদ্রে তার থেকেও বেশি, প্রায় ১৪ মিলিয়ন টনের বেশি প্লাস্টিক প্রতিবছর জমা হচ্ছে৷ এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক পরিমাণ প্লাস্টিকের ঘনত্ব জলের তুলনায় বেশি। ফলে সমুদ্রের বুকে জমা হলেও তা ডোবে না। যেহেতু এ জাতীয় প্লাস্টিক জলে ডুবে বা মিশে যায় না, ফলে খোলা জায়গায় সূর্যের তাপে নানা বিক্রিয়ার মাধ্যমে এরা মাইক্রোপ্লাস্টিক জাতীয় জিনিসে ভেঙে যায়। আর প্লাস্টিকে থাকা অণু-পরমাণু একবার ভাঙতে শুরু করলে পরিবেশের জন্য তা হয়ে দাঁড়ায় আরও ক্ষতিকর। সমগ্র সামুদ্রিক ইকোসিস্টেমের জন্য ত্রাস হয়ে যায় এই মাইক্রোপ্লাস্টিক। বিভিন্ন জলজ প্রাণী এবং মাছেরা হামেশাই এইসব প্লাস্টিককে নিজেদের খাবার ভেবে ভুল করে। আর দিনের পর দিন খাবার ভেবে প্লাস্টিক খাওয়ার ফলে কার্যত মড়ক লাগে জলজীবনে। কারণ জমা জঞ্জালের মধ্যে প্রায় ৮৪ শতাংশ আবর্জনাই থাকে মারাত্মক বিষাক্ত। আর এই বিষ শরীরে প্রবেশ করলে মৃত্যু অবধারিত। ফলে বেঘোরে মারা যায় বহু মাছ এবং সামুদ্রিক প্রাণী। এমনকী এই প্লাস্টিকের দৌলতেই বিলুপ্তির পথেও পৌঁছে যায় সামুদ্রিক ইকোসিস্টেমের বেশ কিছু প্রাণী। বহু বছর ধরে চলা অসংখ্য গবেষণার ফলে দেখা গিয়েছে, প্রায় ৭০০ ধরণের সামুদ্রিক প্রজাতি প্রতিনিয়ত মেরিন ডেবরিস (সামুদ্রিক ধ্বংসাবশেষ)-এর সংস্পর্শে আসে। যার মধ্যে ৯২ শতাংশ প্রাণীই এই ক্ষতিকর প্লাস্টিকের সংস্পর্শেই থাকে।
এই প্লাস্টিক ঝামেলা আমাদের স্বদেশেও উদগীরণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সরকার বিভিন্ন স্টেপ নেওয়ার পরেও তেমন ফল হচ্ছে না। অসর্তকতার ধরুণ প্লাস্টিক ব্যবহারের নিয়মিতকরণ এবং পর্যটকদের অসচেতনতা ও পর্যটক ব্যবস্থাপনার অযুতসই নিয়ম স্বয়ং বঙ্গোপসাগরের জন্যই আকাল হয়ে পড়তেছে, যা আমাদের জানা। ২১ নভেম্বর, ২০১৯ জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর রিপোর্টে দেখা যায়, পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ন্যাশনাল জিওগ্রাফির ভাষ্যমতে বঙ্গোপসাগরে প্রতিদিন ৩০০ ধরনের এবং প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক পতিত হচ্ছে। যার ফলত জলজ-জীববৈচিত্র ধ্বংস এবং ইকোসিস্টেমের অধঃপতন নিশ্চিত বলা অত্যুক্তি নয়।
প্লাস্টিকের এই দূষণ এবং পরিবেশ ক্ষতির মৌলিক কারণ হচ্ছে তা পুনঃচক্রায়ণে দীর্ঘসময় এবং মাটিতে বা পানিতে তা পঁচতে অন্তত ৪০০ বছর সময়ের প্রয়োজন পড়ে। পুরোবিশ্ব, বাংলাদেশ এবং আমাদের জন্য প্লাস্টিক ব্যবহার এখন পুনর্বিবেচনার বিষয়। পুনর্বিবেচনা করে আশাকরি আমরা সচেতন হবো, এবং প্লাস্টিকের বিকল্পন চিন্তা সাপেক্ষে প্লাস্টিক পণ্য সহসা বর্জন করবো।
