খাদ্য তালিকায় বাঁশ কোঁড়ল, সংকটের আশঙ্কা
নিউজ ডেস্ক
পার্বত্য চট্টগ্রামে যুগ যুগ ধরেই প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে উঠা পাহাড়ী বাঁশের গোঁড়ার কচি নরম অংশকে বাঁশ কোঁড়ল পাহাড়ীদের ঐতিহ্যবাহী এক খাবারের নাম। অতিসম্প্রতি এই বাঁশ কোঁড়ল আবার পার্বত্য জেলাগুলোতে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদেরও জনপ্রিয় এক খাবারে পরিণত হয়েছে, এমনকি অর্থের বিনিময়ে বাঁশ কোঁড়ল এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে পার্সেলও করছে পাহাড়ীরা। বাঁশে পরিণত হওয়ার আগেই প্রতিদিন বাজারে বিক্রি হয় দেদারছে, পাহাড়ের প্রায় সব স্থানেই মেলে এ সবজি। এটির আবার স্বাস্থ্য উপকারিতা ও ঔষধী গুনও রয়েছে প্রচুর। তবে গত কয়েক বছরে পাহাড়ি উপজেলায় প্রায় কোটিরও বেশি বাঁশ অংকুরেই ঝরে পড়েছে বলে বিশেষজ্ঞমহলের ধারণা। এ বাঁশ কোঁড়ল নিধন অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই এ অঞ্চল থেকে বাঁশ সম্পদ একেবারেই হারিয়ে যাবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
জানা গেছে, পাহাড়ে কয়েক প্রজাতির বাঁশ জন্মে। এর মধ্যে রয়েছে মুলি, দুলু, মিটিঙ্গা, কালি ও ছোটিয়া। এর মধ্যে মুলিবাঁশ বেশি জন্মায়। বর্ষা মৌসুম শুরু হলেই আস্তে আস্তে বাঁশ বাগানগুলোতে জন্ম নিতে শুরু করে বাঁশ কোঁড়ল। জুন, জুলাই ও আগস্ট এই তিন মাস বাঁশের বংশ বৃদ্ধির মৌসুম। এটির নাম বাঁশ কোঁড়ল হলেও এটি সবজি হিসেবে খেতে খুবই সুস্বাদু বিধায় বর্তমানে পাহাড়িদের পাশাপাশি এখানকার অনেক বাঙালিরাও বাঁশ কোঁড়ল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছেন। এর আগেই শুরু হয় পাহাড় থেকে খাদ্য হিসেবে ও সংসারের আয় উপার্জনের জন্য বাঁশ কোঁড়ল সংগ্রহ।
তিন পার্বত্য জেলার সকল উপজেলার বিভিন্ন হাট বাজারে এখন বাঁশ কোঁড়ল বিক্রি করা হয় সচরাচর। সপ্তাহে ৩-৪ দিন বিক্রির জন্য বাজারে ১৫০-২০০টি হারে বাঁশ কোঁড়ল নিয়ে আসেন খাগড়াছড়ির গাছবান এলাকার মংসিনু মারমা। প্রতি কেজি বিক্রি করা হয় ৬০ টাকা। একই এলাকার উওয়াংচিং মার্মানিও বাজারে প্রায় প্রতিদিন একই পরিমাণ বাঁশ কোঁড়ল বিক্রি করতে আসেন সংসার চালানোর তাগিদে। তাদের মতো আরও অনেকে সাপ্তাহিক দু’দিন হাট-বাজার ছাড়া প্রায় প্রতিদিন সকালে অথবা বিকেলে বাঁশ কোঁড়ল বিক্রি করতে নিয়ে আসেন।
সূত্র বলছে, তাজা বাঁশের কোঁড়লে শতকরা ৮৮-৯৩ভাগ পানি, ১.৫-৪ ভাগ প্রোটিন, ০.২৫-০.৯৫ ভাগ চর্বি, ০.৭৮-৮৬ ভাগ চিনি, ০.৬০-১.৩৪ ভাগ সেলুলৈাজ এবং ১.১ ভাগ খনিজ পদার্থ আছে। এছাড়া ভিটামিনও রয়েছে প্রচুর। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা গেছে, বাঁশের কোঁড়ল দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, উচ্চ রক্তচাপ কমায় ও ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমায়। কোষ্ঠ কাঠিন্য, হাঁপানী, ডায়বেটিস, তীব্র জ্বর, মৃগি রোগে মূর্ছা যাওয়া ইত্যাদি নিরাময়েও যথেষ্ট অবদান রাখে। তাই যে কোনো সবজির সাথে তুলনা করলে বাঁশের কোঁড়ল কোনভাবেই হেলাফেলার নয়। যদিও বা এ খাওয়ায় হ্রাস পাবে বাঁশ সম্পদ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত চার বছর আগে পার্বত্য জেলায় বাঁশে ফুল আসে ও মড়ক সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি ইঁদুর বন্যা দেখা দেয়। ফলে একদিকে বাঁশ বাগানে মড়ক অন্যদিকে ইঁদুরও বাঁশ বাগান নষ্ট করে ফেলে। এতে বাঁশের উৎপাদন কমে যায়। রাতারাতি বাঁশের দাম বেড়ে গিয়ে প্রতি হাজার ১৮-২০ হাজার টাকা এসে দাঁড়ায়। ওই সময় অনেক মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষ ঘর মেরামত কিংবা নতুন বাঁশের ঘর তৈরি করতে সাহস পায়নি। প্রাকৃতিকভাবে বাঁশে মড়ক লাগার দু’বছরের মধ্যে আবার বাঁশের উৎপাদন শুরু হয়। গত বছর প্রতি হাজার মুলি বাঁশের দাম ছিল ১০-১১ হাজার টাকা। এরপরও অনেক পাহাড়ি পরিবার ঘর মেরামত ও নতুন ঘর তৈরি করতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে বলে জানিয়েছেন, উপজেলার রূপসীপাড়া ইউনিয়নের হ্লাচাই পাড়া কারবারী ধুংচিং অং মারম, গজালিয়া ইউনিয়নের মংক্যচিং মার্মাসহ আরো অনেকে।
এ বিষয়ে বান্দরবানের লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্ত কামাল উদ্দিন আহমেদ জানান, ‘জুন, জুলাই ও আগস্ট মাস হচ্ছে বাঁশ জন্মানোর মৌসুম। এ সময় বাঁশ কোঁড়ল সংগ্রহের ফলে বাঁশ উৎপাদন কমে যাওয়া স্বাভাবিক। তবে বন বিভাগের রিজার্ভ এলাকা থেকে কাউকে বাঁশ কোড়ল সংগ্রহ করতে দেয়া হয় না। বরং এ বিষয়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বিট কর্মকর্তা ও ভিলেজারদের মাধ্যমে স্থানীয়দেরকে সচেতন করা হচ্ছে।’