ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের (বীর উত্তম): পাহাড়ে চির নিদ্রায় শায়িত এক শহীদ বীর

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

ফিচার ডেস্ক

বাংলাদেশের ইতিহাসে শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের (বীর উত্তম) ওরফে ইকবাল এক অন্যরকম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের পার্বত্য অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের এক অবিস্মরণীয় নাম।

ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের (ইকবাল) ১৯৪৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর দিনাজপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তবে পৈত্রিক গ্রামের বাড়ি লক্ষীপুর জেলার (তৎকালীন বৃহত্তর নোয়াখালী) রামগঞ্জ থানাধীন টিওড়া গ্রামে। পিতার নাম মরহুম আব্দুল কাদের, মাতার নাম রওশন আরা বেগম। তিনি ছিলেন আট ভাইয়ের মধ্যে পঞ্চম। তার কোন বোন ছিলোনা। পিতা স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন পুরাতন ঢাকার ফরিদাবাদ এলাকার লাল মোহন পোদ্দার লেনে। সেখানেই অকুতোভয় এই সৈনিকের শৈশব কাটে। পিতা মরহুম আবদুল কাদের ছিলেন ইংরেজ আমলের একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, মাতা রশন আরা বেগম ছিলেন গৃহীনি।

শিক্ষা জীবনে ক্যাপ্টেন কাদের ছিলেন সৎ ও নিষ্ঠাবা।ন ১৯৬৪ সালে ময়মনসিংহ শহরের মৃত্যুঞ্জয় স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৬ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ইংরেজিতে স্নাতক (সম্মান) এ ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৬৬ সালে ১৬ নভেম্বর তিনি ৩৯ বিএমএ লং কোর্স এর মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬৮ সালের ২৫ শে নভেম্বর তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন এবং ৪০ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারিতে যোগ দেন।

সময়টা ছিল ১৯৬৯ সালের ১৪ নভেম্বর। সবে মাত্র লেফটেন্যান্ট থেকে ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি হয় আফতাবুল কাদেরের। নিয়োগ তখন পাকিস্তানের হায়দ্রাবাদে ৪০ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারিতে। এর কয়েক দিনের মধ্যে চিঠি আসে দেশ থেকে, তার ভালোবাসার মানুষ জুলিয়ার চিঠি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম বর্ষের পড়া মুর্শেদা বাহার জুলিয়া আত্মীয়তার সম্পর্কে খালাতো বোন। দারুন সুন্দর জুলিয়া, আফতাবুল কাদেরও কম নয়।ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের এর কন্ঠে ইংরেজি গান শুনে অন্য অফিসাররা তাকে বিখ্যাত হলিউড নায়ক রক হাডসনের নামে রকি বলে সম্বোধন করতেন। জুলিয়া তখন চট্টগ্রামের দেওয়ান বাজারের সিরাজ-উজ-দৌল্লা রোডে থাকতেন আর আফতাবুলের বাবা ছিলেন চট্টগ্রামের সাবেক ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট আব্দুল কাদের। যদিও তারা থাকতেন পুরাতন ঢাকা ফরিদাবাদ এলাকার লালমোহন পোদ্দার লাইনে।

জুলিয়া ও আফতাবুলের দুজনের পরিবারের সম্মতিক্রমে আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের বিয়ে টা হয় পারিবারিক ভাবেই। কারণ, সেনাবাহিনীর চাকরীতে সব সময় ছুটি মেলে না। তাই ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে এক বছরের ছুটির জন্য আবেদন করেন, কিন্তু ছুটি মঞ্জুর করা দুই মাসের। ৫ ফেব্রুয়ারি দেশে আসলেন আফতাবুল কাদের। ১৯ শে ফেব্রুয়ারি মহা ধুমধাম করে জুলিয়াদের বাড়ি চট্টগ্রাম দেওয়ান বাজার সিরাজউদ্দৌলা রোডে বিয়ে হয় তাদের। এরই মধ্যে দেশের পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেলে, ২৫ মার্চ গনহত্যার রাতে নববধুসহ ঢাকার বাড়িতেই ছিলেন আফতাবুল কাদের। গনহত্যার পর সিদ্ধান্ত নিলেন আফতাবুল কাদের আর ফিরে যাবেন না পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মস্থলে। বিয়ের অল্প কয়েকদিন পর যুদ্ধ শুরু হলে বদ্ধ ঘরে স্থির থাকতে পারেননি ক্যাপ্টেন কাদের। বিয়ের মেহেদীর রং ম্লান না হতেই ঘরের বউ সংসারের মায়া ত্যাগ করে ৫১ দিনের মাথায় মার্চের ২৮ তারিখ মাকে বন্ধুর বাসায় যাবার কথা বলে ফেনীর শুভপুর যুদ্ধে ইপিআর বাহিনীর সাথে যোগ দেন। বিয়ের মাত্র ১মাস পার হয়েছে। প্রিয় মানুষ জুলিয়াকে নিয়ে মায়ার সংসার, অথচ এক রাতে সকল মায়া ত্যাগ করে দেশমাতৃকার টানে বাড়ি থেকে চলে গেলেন আফতাবুল কাদের। শুরু করলেন এক অনিদিষ্ট পথ যাত্রার, লক্ষ্যে দেশ স্বাধীন করার। চট্টগ্রাম তখন মুক্তাঞ্চল।

২রা এপ্রিল রাতে ক্যাপ্টেন কাদের সীমান্ত শহর রামগড়ে আসেন করেন। মুক্তিযুদ্ধের ১নং সেক্টরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রামগড় সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রায় ৫ শতাদীক সংগ্রামী তরুনকে অস্ত্র প্রশিক্ষনে অংশ নিলে তিনি সহযোগী ইপিআর সুবেদার এ.কে.এম. মফিজুল বারিকে সাথে নিয়ে মুক্তিকামী যুবকদের অস্ত্র চালানো ও যুদ্ধ কৌশলের প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষণ দিয়ে কয়েকজন ইনসট্রাকটকে প্লাটুনে ভাগ করে অন্যান্য অফিসারের সাথে ১০ এপ্রিল ক্যাপ্টেন কাদের ৫০ জনের একটি গ্রুপ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়লে ক্যাপ্টেন কাদের তাঁর গ্রুপ নিয়ে রাঙ্গামাটি রেকীতে অবস্থান করেন।

১৩ই এপ্রিল ১৯৭১ সালের দুপুরে বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার মহকুমা শহর রামগড় থানার ওসির অফিসে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক এইচটি ইমাম ও ৮ ইষ্ট-বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান আলোচনায় ব্যস্ত। এ সময় থানায় আসেন ৫ ফিট ৭ ইঞ্চির এক সুঠাম দেহের যুবক। এসেই মিলিটারি কায়দায় সালাম ঠুকে বলেন, ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের আর্টিলারি রিপোর্টিং প্রেজেন্ট স্যার। ইতিমধ্যে যুদ্ধের দামামা বাজে উঠেছে। ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের ৮ ইষ্ট বেঙ্গলের সাথে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে মহালছড়ি ডিফেন্স নিলেন। ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের যখন ইপিআর সৈন্যদের সঙ্গে ফেনী ছাগলনাইয়ার শুভপুর প্রতিরক্ষায় যোগ দিলেন, তখন পাকিস্তানিরা হেলিকপ্টারের সাহায্যে শুভপুরে সৈন্য নামানোর সময় গ্রামবাসীর সহায়তায় ধরে ফেলেন একজন সৈন্যকে। পরবর্তীতে তিনি রামগড় ফিরে আসেন। এখানে তিনি ৫০০ জন তরুন নিয়ে গড়ে তোলেন একটি মুক্তি ক্যাম্প। এসব তরুনদের তিনি নিজ হাতে প্রশিক্ষন দেয়া শুরু করেন। তিনি নিজ অধিনস্থ মুক্তিযুদ্ধদের উজ্জীবিত করতে একটা কথা প্রায় সময় বলতেন, একজন পাকিস্তানি সৈন্য খতম করার অর্থ হলো- এদেশে অন্তত এক লাখ নিরহ মানুষ ও নারীকে নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করা।

এদিকে পাকসেনারা হাজার হাজার মিজোদের সহযোগীতায় মুক্তিযোদ্ধাদের গুরুত্বপূর্ণ সকল ঘাঁটির উপর বিমান হামলা শুরু করে। পাহাড়ী এলাকায় যুদ্ধে পাক বাহিনীর মোকাবিলায় মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ ও গোলা বারুদ শেষ পর্যায়ে চলে এলে ২৪ এপ্রিল ১৯৭১ সালে খবর আসলো মেজর শওকত এর নিকট হতে, এখনি ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরকে মহালছড়ি ফিরে যেতে হবে। তিনি নির্দেশ মতে মহালছড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এমন পরিস্থিতির খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন কাদের রাঙ্গামাটি রেকী থেকে দ্রুত এসে খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে তুমুল যুদ্ধে মুক্তি সেনাদের সাথে যোগদান করেন। বুড়িঘাট এসে দেখা হলো লেফটেন্যান্ট মাহফুজ, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, হাবিলদার সাহীদ এবং হাবিলদার তাহেরের সাথে। বুড়িঘাট হতে রওয়ানা হয়ে যখন ক্যাপ্টেন কাদেরের লঞ্চটি একটি দ্বীপ (কাপ্তাই লেকের মধ্যে পাহাড় গুলো দ্বীপের মতই মনে হয়) তখনি পাকবাহিনীর একটি ধাবমান লঞ্চ এসে পৌঁছালো সেখানে। বন্দুক ভাঙ্গায় ক্যাপ্টেন আফতাবুল এর বাহিনীকে না পেয়ে শত্রু পক্ষ কয়েকটি লঞ্চ করে পুরো লেক এলাকা ঘিরে ফেলে এবং তাদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তখন শত্রুপক্ষের অতর্কিত আক্রমনে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের কোম্পানির সদস্যরা এদিক-ওদিক ছিটকে পরলেন।

২৭ এপ্রিল ১৯৭১, সেই দিন সকালে মহালছড়ির অবস্থা থমথমে। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে শত্রু পক্ষের ভারী অস্ত্র ও নিয়মিত কমান্ডো কোম্পানীর ১৫-১৬ শ মিজোর দুটি ব্রিগ্রেড মহালছড়িতে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের উপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্যাপ্টেন কাদেরের সাহাসী সম্মুখ যুদ্ধে পাক বাহিনী কিছুটা পিছু হটতে শুরু করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত জীবন বাঁচানোর তাগিতে পাক সেনারা আবারো বেপরোয়া হয়ে মিজোদের সামনে রেখে একের পর এক আক্রমন চালিয়ে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। এই প্রতিকূল ও দূর্বল মুহূর্তে ২৭ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে হানাদার বাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়ানের এক কোম্পানি সৈন্য (১৩৬) জন এবং একটি মিজু ব্যাটালিয়ানের (১০০০)জন সঙ্গে নিয়ে আক্রমন চালায় মহালছড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযৌদ্ধাদের উপর। এ সময় মেজর মীর শওকত চন্দ্রঘোনা পেপার মিলের প্রকৌশলী ইসহাকের নেতৃত্বে ওই সময় শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করা হচ্ছিল। এর মধ্যে হানাদার বাহিনীর হেলিকপ্টার যোগে দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়ান আরো এক কোম্পানি সৈন্য এখানে নামিয়ে দিয়ে যায়। দুই পক্ষের গুলাগুলি, এ যুদ্ধে বেলা ৩ টার দিকে ক্যাপ্টেন আফতাবুলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা একটি গ্রুপ মহালছড়িতে এসে পৌঁছালেন। সুদক্ষ যুদ্ধ কৌশলে টগবগে তরুণ ক্যাপ্টেন আফতাবুল সঙ্গীদের নিয়ে নামলেন শত্রুর মোকাবিলায়। তাদের এ সম্মিলিত কঠিন প্রতিরোধের মুখে মিজো বাহিনীর প্রথম অবস্থায় পিছু হাটতে শুরু করে। এতে হানাদারেরা বেপরোয়া হয়ে পড়ে। তারা মিজুদের সামনে রেখে একটার পর একটা আক্রমণ চালিয়ে অগ্রসর হতে থাকলো। প্রতিবারই যুদ্ধাদের পাল্টা জবাব দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করছে শত্রুরা, মুক্তিযুদ্ধাদের লক্ষ করে বেপরোয়া গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে যায় তারা। তিন চার গুন অধিক সংখ্যাক শত্রুপক্ষ বীভবৎস উল্লাস ধ্বনি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় চার পাশ থেকে ঘিরে ফেলে। চরম এ বিপদজনক অবস্থায় সহযোদ্ধারা পিছু হটার পরামর্শ দেয় ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরকে। কিন্তু, ক্যাপ্টেন আফতাবুল, তাঁর সহযোদ্ধা ছাত্র শওকত ফারুক এবং দুই ইপিআর সৈন্যকে সঙ্গে নিয়ে, তিনটি এলএমজি দিয়ে ফায়ারিং করে অবিরাম বৃষ্টি বর্ষণ এর মত কোণঠাসা করে ফেলেন শত্রুদের।এই চরম মুহূর্তে হঠাৎ এক সহযোদ্ধার এলএমজি ফায়ারিং বন্ধ হয়ে গেলো, শত্রুর হাত থেকে শতাধিক মুক্তিযুদ্ধোর জীবন বাঁচাতে একটি এলএমজি অচল হয়ে পড়ায় অস্হির হয়ে উঠেন ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের। মেরামতের জন্য দ্রুত অস্ত্রটি তার কাছে নিয়ে আসার নির্দেশের পরও সহযোদ্ধা শওকত আসতে দেরি হওয়ায় ক্যাপ্টেন আফতাবুল নিজে এগিয়ে যেতেই শত্রুর অস্ত্রের কয়েকটি গুলি এসে বেঁধে যায় তার ডান বগলের কয়েক ইঞ্চি নিচে এবং পেটের বাম পাশে। বৃষ্টির মতো গোলাগুলির মধ্যে গুরুতর আহত অবস্থায় আফতাবুলকে বহন করে একটি নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসেন সহযোদ্ধা শওকত, ফারুক, ইপিআর ড্রাইভার আব্বাস। সেখান থেকে জীপ গাড়ি যোগে রামগড় আসার পথে গুইমারায় আহত ক্যাপ্টেন কাদের পানি পান করতে চাইলে পান করানো হয় আর এখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

২৭ শে এপ্রিলের বিকালে শহীদ বীরযোদ্ধা ক্যাপ্টেন কাদের এর পবিত্র মরদেহ রামগড় নিয়ে আসা হয়। সন্ধ্যার প্রক্কালে রামগড় কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গনে ইমাম মাওলানা মোহাম্মদ মোস্তফার পরিচালনায় শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের জানাজা নামাজ শেষে কেন্দ্রীয় কবরস্থানে পূর্ণ সামরিক ও ধর্মীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। অথচ শহীদ আফতাবুল কাদেরের হাতের মেহেদির রং এখনো শুকায়নি। ভেজা শার্ট আর বিয়ের আংটি সহযোদ্ধারা জেড ফোর্স হেডকোয়ার্টার্সে পাঠিয়ে দেন। যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের শেষের দিকে মায়ের হাত হয়ে জুলিয়ার হাতে আসে শহীদ স্বামী আফতাবুল কাদেরের শার্ট ও আংটি। সেই শার্ট ও আংটি ছিল শহীদ স্বামীর একমাত্র স্মৃতি।

যুদ্ধ পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ ও গৌরবোজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতির স্বরূপ ১৯৭৩ সালে সরকার ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরকে মরণোত্তর ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁর নামে স্মৃতিসৌধ (খাগড়াছড়ি), ভার্স্কয (মহালছড়ি), কিন্ডার গার্ডেন স্কুল (রামগড়), রামগড় ১৬ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের উদ্যোগে রাস্তার নাম করণ (রামগড়) করা হয়েছে।

ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের শহিদ হওয়ার পর কালের পরিক্রমায় ১৯৭৫ সালে আবার বিয়ে হয়েছিল জুলিয়ার। স্বামী ডক্টর শামসুল হুদা যুক্তরাষ্ট্রের জেভিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক। আজও প্রতি বছর একবার হলেও দেশে আসেন জুলিয়া আর শামসুল হুদা। বিমানবন্দরে নামার পর প্রথমে তারা ছুটে যান খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলা কেন্দ্রীয় কবরস্থানে। যেখানে শুয়ে আছে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের। স্বামীর কবরের সামনে দাড়ান জুলিয়া। সেখানে শায়িত বাংলার নক্ষত্র, বীর সেনানি ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের। এছাড়া প্রতি বছর একবার হলেও শহিদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের ভাইয়েরা এসে কবর জিয়ারত করেন।

রামগড় বাজার থেকে বর্তমানে ৪৩ বিজিবির রামগড় জোন পর্যন্ত এই প্রধান সড়কটির নাম করন করা হয়েছিল শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের বীর উত্তমের নামে, এখনো এখানকার দোকান-পাটের সাইন বোর্ডেও লেখা আছে শহিদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের সড়ক। তবে, বড় আকারে কোন সাইন বোর্ডের মাধ্যমে লেখা নেই বলে অনেকেই জানে না এ সড়কটি কার নামে নামকরণ করা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শহিদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের (বীর উত্তম) এর সমাধি স্থলে ২১ শে ফেব্রুয়ারী, ২৬ মার্চ, ২৭ শে এপ্রিল মৃত্যু দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর এ রাষ্ট্রীয় ভাবে কিংবা সরকারী-বেসরকারী ভাবে অথবা দলীয় ভাবে কোন ধরণের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে দেখা যায় না। তবে তার নামে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যানিকেতনের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয় কাউন্সিলর আহসান উল্যাহর উদ্যোগে প্রতিবছর তার মৃত্যুবার্ষিকীতে এখানে মোনাজাতের আয়োজন করা হয়।

শহিদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের নামে রামগড় পৌরসভা এলাকায় একটি বেসরকারি কিন্ডার গার্ডেন রয়েছে, যার নাম শহিদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের বিদ্যা নিকেতন। যেখানে প্রায় ২০০ জন ছাত্র-ছাত্রী লেখা পড়া করে। বর্তমানে বিদ্যালয়টি সেমিপাকা অবস্থায় আছে। ১০-১২ বছর আগে গুইমারা রিজিয়ন এবং রামগড় বিজিবি জোন থেকে বিভিন্ন আর্থিক সহায়তা এবং আসবাপত্র অনুদান দেয়া হতো সেখানে তবে বর্তমানে বিদ্যালয়টির ততটা খোঁজ নেয়না কেউই। এমনকি সমাধিস্থল পরিস্কার পরিছিন্ন করা হয় না ঠিক মতো। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছরেও এই বীর মুক্তিযোদ্ধার কবরে তার নামের পাশে “বীর উত্তম” শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি, তবে চলতি বছরের মে মাসে স্থানীয় কাউন্সিলর সম্পূর্ন ব্যক্তিগত অর্থায়নে শহীদ ক্যাপ্টেন কাদেরের কবরের পাশের নাম ফলকটি পরিবর্তন করে সেখানে “বীর উত্তম” শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

স্থানীয়রা জানান, শহিদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের এর সমাধি স্থলে রাস্তার পাশে তার জীবনীসহ বড় আকারের একটি স্মৃতি স্মারক করা হলে দেশ মাতৃকার এই বীর সেনানী সম্পর্কে এ সড়কে আগত লোকজন সহজেই জানতে পারতো।