বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্কে নতুন মাত্রা
পরিমল পালমা
অতীতের কূটনৈতিক তিক্ততা থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ ও তুরস্ক নতুন করে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে জোরদার করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে তুরস্ক মুসলিম বিশ্বে তাদের অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে চাচ্ছে। বিপরীতে ঢাকা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পাশাপাশি বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য বিশ্বমঞ্চে শক্তিশালী মিত্র খুঁজছে।
সামরিক শক্তিসমৃদ্ধ তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য। পাশাপাশি জাতিসংঘ এবং ওআইসিসহ বৈশ্বিক ফোরামগুলোতে দেশটির জোরালো অবস্থান আছে। এ ছাড়া তুরস্ক রোহিঙ্গা ইস্যুতে ঢাকার অবস্থানকে সমর্থন করেছে। যা বাংলাদেশের জন্য খুবই আকাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা।
সেই সঙ্গে বাংলাদেশ তুরস্কের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে চায়। আঙ্কারাও বার্ষিক ১ বিলিয়ন ডলারের দ্বিমুখী বাণিজ্যকে উন্নীত করতে চায় ২ বিলিয়ন ডলারে।
বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণ হলো, সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যকার প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার হয়েছে। যা সম্পর্কের গভীরতাকেই নির্দেশ করে।
বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ুন কবির এ বিষয়ে বলেন, ‘গত ১০ বছরে তুরস্ক অনেক উন্নতি করেছে। বিশেষ করে সামরিক প্রযুক্তির দিক থেকে। অন্যদিকে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বিশ্বের মনোযোগ কেড়েছে। তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, দুই দেশের পারস্পরিক ঐক্য ও সম্পর্কের জায়গাগুলো জোরদার হচ্ছে।’
সম্পর্কের পুনর্নির্মাণ
একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে তুরস্ক পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। দেশটি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। তারও দুই বছর পর ঢাকায় দূতাবাস খোলে।
দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক তখন থেকেই উন্নতির পথে ছিল। কিন্তু ২০১২ সালে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের নিন্দা শুরু করলে সম্পর্কটি নেতিবাচর রূপ নেয়।
২০১৬ সালের মে মাসে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির পর তুরস্ক বাংলাদেশে নিযুক্ত তার রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নিলে দিপক্ষীয় সম্পর্ক মারাত্মক চাপের মুখে পড়ে যায়।
পরবর্তীতে একই বছরের জুলাই মাসে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার নিন্দা জানিয়ে চিঠি লেখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন থেকে আবার দুই দেশের মধ্যকার শীতল এই সম্পর্কের বরফ গলতে থাকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আঙ্কারা ওই বছরের শেষে ঢাকায় নতুন রাষ্ট্রদূত পাঠায়।
মিয়ানমার থেকে সাড়ে সাত লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা আসার পর ২০১৭ সালে সেপ্টেম্বর মাসে তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোয়ান কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। জাতিসংঘ এবং ওআইসিসহ অন্যান্য বৈশ্বিক ফোরামেও দেশটি রোহিঙ্গাদের সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, কক্সবাজারে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য তুরস্কের পক্ষ থেকে মানবিক সহায়তাও দেওয়া হয়।
২০২০ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের বিমান ও নৌবাহিনী প্রধান তুরস্ক সফর করেন। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন তুরস্কে রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়ে আঙ্কারায় বাংলাদেশ চ্যান্সেরি কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করেন। একইভাবে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলিত সাভাসগলু গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকা সফরে এসে তুর্কি দূতাবাস ভবনের উদ্বোধন করেন।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদও চলতি বছরের আগস্ট মাসে আট দিনের তুরস্ক সফরে যান। সেখানে তিনি তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রীসহ দেশটির প্রতিরক্ষা শিল্প বিষয়ক প্রেসিডেন্সি ও ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মত বিনিময় করেন সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য বিষয়ে।
ওই সফরে সেনাপ্রধান দেশটির মানববিহীন বিমান পরিচালনা ব্যাবস্থার নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, আর্মি এভিয়েশন সদরদপ্তর ও মহাকাশ শিল্প পরিদর্শন করেন।
সফরে সেনাপ্রধান বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে কৌশলগত বন্ধুত্ব ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের ওপর জোর দেন। বলেন, তার এই সফর ‘দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতার নতুন দ্বার উন্মোচন করবে।’
তুরস্কের কূটনৈতিক একটি সূত্র জানায়, চলতি বছরের শেষ দিকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বাংলাদেশ সফর করতে পারেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল শিগগির তুরস্ক সফর করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
তুর্কি কর্তৃপক্ষ আঙ্কারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ঢাকায় আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্কের একটি করে ভাস্কর্য স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে।
চলতি বছরের জুনে বাংলাদেশ সামরিক সরঞ্জাম তৈরির কোম্পানি ও ঠিকাদার রোকেস্তানের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানির জন্য তুরস্কের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা ক্রয় চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
গত ২৯ জুন করা এক টুইট বার্তায় তুর্কি প্রতিরক্ষা শিল্পের প্রেসিডেন্ট ইসমাইল দেমির এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের তুর্কি প্রতিরক্ষা শিল্প নানা ধরনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রপ্তানির জন্য (বাংলাদেশে) একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। থামবেন না। এগিয়ে যান।’ আঙ্কারায় বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা এই চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
দেশের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিচালিত নিউজ পোর্টাল দ্য বাংলাদেশ ডিফেন্স অ্যানালিস্টে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, তুরস্ক থেকে আমদানি করা প্রতিরক্ষা সরঞ্জামগুলো বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে (সেনা, নৌ ও বিমান) ন্যাটো স্ট্যান্ডার্ডে সজ্জিত করবে।
তুরস্কের সংবাদ সংস্থা আনাদোলু সম্প্রতি এক খবরে জানায়, তুরস্ক থেকে অস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে চতুর্থ বৃহত্তম ক্রেতায় পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। ২০২১ সালের প্রথম চার মাসে রপ্তানি করা আনুমানিক ১ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের মধ্যে বাংলাদেশ ৬০ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের সরঞ্জাম বুঝে নিয়েছে।
এদিকে চলতি বছরের জুন মাসে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর ৪১ জন সদস্য তুরস্কে একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। সংবাদ সংস্থা আনাদোলুর ভাষ্য অনুসারে, ‘বাংলাদেশ আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে তুরস্কের অন্যতম শীর্ষ প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের গ্রাহক হতে চলেছে।’
প্রতিরক্ষা খাতে চুক্তি
দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে তুরস্ক থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনার জন্য চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। সামনের দিনে তুরস্কের সঙ্গে যৌথভাবে সামরিক সরঞ্জাম দেশেই উৎপাদন এবং দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা খাতে ব্যাপক প্রশিক্ষণ বিষয়ে দুই সরকারের মধ্যে আলাপ-আলোচনাও চলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতের সম্পর্কের এই উন্নয়ন ইতিবাচক, যা সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করছে। ভবিষ্যতে এর সূত্র ধরেই দুই দেশের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।
তুরস্কের আঙ্কারায় অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন জানিয়েছে, দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে ২০২১ সালের ২৯ জুন একটি নতুন চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, তুরস্কের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম কিনবে বাংলাদেশ। চুক্তি সেই অনুষ্ঠানে তুরস্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুসদ মান্নান ও ডিফেন্স অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রাশেদ ইকবালসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, চলমান ভূ-রাজনীতি পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহের একাধিক উৎস রাখতে চায়। এরই অংশ হিসেবে তুরস্কের সঙ্গে এই চুক্তি করা হয়েছে। সামনের দিনে এমন আরও একাধিক দেশের সঙ্গেও এই চুক্তি করার পরিকল্পনা রয়েছে।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুট ক্যাভুসলো একই বছরের ২২ ডিসেম্বর ঢাকায় দুই দিনের সফরে আসেন। ওই সফরে মেভলুট ক্যাভুসলো ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা ছাড়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে দেখা করে তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইওয়ান এরদোয়ানের বার্তা পৌঁছে দেন। এ ছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গেও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুট ক্যাভুসলো ওই সময় ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ এখন এশিয়ার উদীয়মান তারা (রাইজিং স্টার)। এশিয়া নীতিতে বাংলাদেশ তুরস্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। অত্যন্ত অল্প সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক খাতে যে উন্নতি করেছে, তা প্রশংসনীয়। তুরস্কের বড় বড় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ নিতে চায়।
তিনি আরও বলেন, সামরিক খাতে তুরস্ক তার প্রয়োজনীয় ৭৫ শতাংশ নিজেরাই উৎপাদন করে, যা মানসম্মত এবং টেকসই। বাংলাদেশকে এই খাতে সহযোগিতা করতে চায় তুরস্ক। প্রয়োজনে এই খাতের প্রযুক্তি বিনিময় এবং যৌথভাবে উৎপাদনে যেতে আগ্রহী তুরস্ক।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘প্রতিরক্ষা খাতে তুরস্কের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে অগ্রগতি প্রয়োজন। এতে বাংলাদেশের অনেক বিদেশি অংশীদাররা খুশি হবে না। কিন্তু তাদের খুশি রেখেই তুরস্কের সঙ্গে আমাদের এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। তুরস্ক একমাত্র দেশ, যাদের ওপর আমরা ভরসা রাখতে পারি, যারা বিপদের সময় এগিয়ে আসতে পারে।’
সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব আরও বলেন, ‘তুরস্ক এরই মধ্যে আমাদের যৌথভাবে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন ও উন্নয়নে অংশ নিতে আহ্বান জানিয়েছে। তুরস্ক ড্রোন প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী দিনের যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে ড্রোন অস্ত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পরিস্থিতি এমন হতে পারে যে ড্রোন ঘুরে বেড়াবে আর তা নিয়ন্ত্রণ করা হবে অফিসে বসে। ২১ বছর আগে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের সফর দলের অংশ হিসেবে আমি তুরস্ক ভ্রমণ করেছি। তখনই দেখেছি যে তারা আর্মড পার্সোনাল ক্যারিয়ার তৈরি করছে, তখনই তারা ছোট আকারে প্লেন তৈরি করেছে। এক সময়ে তারা ফাইটার জেট তৈরি করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’ মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘তুরস্ক খুবই ভালো উৎস। তুরস্ক আমাদের সামরিক সরঞ্জামের উৎসের পাশাপাশি তাদের সঙ্গে আমরা যৌথভাবে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন এবং উন্নয়নে অংশ নিতে পারি।’
তুরস্কের স্বার্থ
ভারতের মণিপাল সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক ড. ইয়াথার্থ কচিয়ার বলেন, ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) অধীনে তুরস্ক ২০০০ সালের গোড়ার দিকে গ্লোবাল সাউথে তার কৌশলগত স্বার্থ অনুসরণ করতে শুরু করে। পরে ২০১৯ সালে নেওয়া ‘এশিয়া অ্যানিউ’ উদ্যোগের অংশ হিসেবে দেশটি শিক্ষা, প্রতিরক্ষা, বিনিয়োগ, বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সমন্বয়ের জন্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেয়।
এই অধ্যাপক বলেন, বিশ্বব্যাপী কাঠামোগত পরিবর্তন ও একেপির পররাষ্ট্র নীতির পেছনকার আদর্শিক অবস্থানই এশিয়ায় আঙ্কারার নতুন এই সক্রিয়তার কারণ।
এক ইমেইল সাক্ষাৎকারে কচিয়ার বলেন, ‘পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্কে অব্যাহত ফাটল ও মুসলিম বিশ্বে প্রাধান্য পাওয়ার জন্য চলমান লড়াই তুরস্ককে তার পাশ্চাত্যের চিরায়ত মিত্র এবং প্রতিবেশী মুসলিম প্রধান দেশগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।’
কচিয়ারের ভাষ্য, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ২০২৩ সালের মধ্যে অস্ত্র বিক্রি ২৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের ভিত্তি সম্প্রসারিত করতে চান। এতে বাংলাদেশ তুর্কি প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজারে পরিণত হতে পারে।
ইয়েল ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক অ্যালান মিখাইলের বক্তব্য, তুরস্ক এখন অটোমান সাম্রাজ্যের আধুনিক সংস্করণ হিসেবে আবির্ভূত হতে চাচ্ছে।
এক ইমেইল সাক্ষাৎকারে এই অধ্যাপক বলেন, ‘যেখানে প্রত্যেক আধুনিক তুর্কি শাসক অটোমান সাম্রাজ্য ও ইসলামের উত্তরাধিকার থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছেন আরও বেশি পশ্চিমা, ধর্মনিরপেক্ষ ও আধুনিক চেহারা তুলে ধরার জন্য, সেখানে এরদোয়ানই প্রথম ব্যক্তি যিনি অটোমান সাম্রাজ্যর অতীত ও ইসলামী ঐতিহ্যকে সক্রিয়ভাবে তুলে ধরেছেন।’
ঢাকার কৌশলগত উদ্দেশ্য
প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষকদের মতে, তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তিনটি উদ্দেশ্য আছে। এগুলো হচ্ছে- কূটনৈতিক শক্তি বাড়ানো, বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও অস্ত্রের উৎসে বৈচিত্র আনা।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, তুরস্ক সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী। যার একটি স্বাধীন ও জোরালো কণ্ঠ আছে। একই সঙ্গে একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে তুরস্কের ন্যাটো সদস্যপদ আছে।
শমসের মবিনের অভিমত, রোহিঙ্গা সংকটের মতো গুরুতর কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে চলা বাংলাদেশের জন্য মিত্র দরকার। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক ফোরামের মতো তুরস্ক সেই মিত্রতা প্রমাণ করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও উত্তর কোরিয়া থেকে প্রধান প্রধান সামরিক সরঞ্জাম কিনে থাকে।
আঙ্কারার একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ‘তুরস্ক এখন মানসম্মত অস্ত্র তৈরি করছে। যা খুব ব্যয়বহুল নয় এবং কোনো শর্ত ছাড়াই পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের জন্য এটাই দরকার। আর বাংলাদেশ এখান থেকে যন্ত্রপাতি তৈরির প্রযুক্তিও পেতে পারে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহেদুল আনাম খান বলেন, তুরস্ক থেকে অ্যান্টি শিপ মিসাইল ও এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনার অর্থ হচ্ছে এখান থেকে আরও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার বিকল্প আছে।
শাহেদুল আনামের বক্তব্য, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনা কেবল একবারের বিষয় নয়। এর জন্য প্রশিক্ষণ ও আনুষঙ্গিক খুচরা যন্ত্রপাতির দরকার হয়। তিনি বলেন, ‘সংকটের সময়ে অস্ত্র সরবরাহের জন্য আপনি কেবল একটি উৎসের ওপর নির্ভর করতে পারেন না। আপনার যদি আরও বিকল্প থাকে, তাহলে আপনার স্বাধীনতাও বেশি থাকবে।’
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাখাওয়াত হোসেনের অভিমত, বাংলাদেশের জন্য আপাতত কোনো নিরাপত্তা হুমকি নেই। কিন্তু যেহেতু অর্থনীতি বড় হয়েছে এবং বিশাল সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দরকার আছে, সেহেতু দেশের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন দরকার।
এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, এ ছাড়া আমরা জাতিসংঘের মিশনগুলোতে সবচেয়ে বেশি শান্তিরক্ষী পাঠানো দেশ। এ কারণেও আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি আধুনিক প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম দরকার।’
এ ছাড়া দেশের অর্থনীতির জন্যও ঢাকার সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। বিইআই প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবিরের মতে, বাংলাদেশ যেহেতু শিগগির মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে, সেহেতু এখানে আরও বেশি বাণিজ্য ও বৈদেশিক বিনিয়োগ দরকার।
তিনি বলেন, ইউরোপের উচ্চ মধ্যম আয়ের একটি দেশ তুরস্ক বাংলাদেশের জন্য একটা বড় বাজার হতে পারে। দুটি দেশের যৌথ উদ্যোগও থাকতে পারে। যেমন টেক্সাইল খাত। কারণ এই খাতের মতো আরও কিছু ক্ষেত্রে দুই পক্ষেরই বিশেষত্ব আছে।
এ পর্যায়ে এরদোয়ানের ডানপন্থী নীতি ও সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাংলাদেশের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা জানতে চাইলে হুমায়ুন কবির বলেন, এটা অসম্ভব।
সাবেক এই রাষ্ট্রদূতের ভাষ্য, ‘যদি তুরস্ক অটোমান সাম্রাজ্যের মতো তার ক্ষমতা ফিরে পেতে চায় তাহলে ভালো। এ ক্ষেত্রে আমরা দেখব, আমাদের একীভূত হওয়ার জায়গাটা কোথায়।’ তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ তো এই নীতিও বজায় রাখে যে, একজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব অন্যের ওপর প্রভাব ফেলবে না।
এ বিষয়ে শমসের মবিন চৌধুরীর অভিমত, ‘বাংলাদেশের সম্পর্ক তো রাষ্ট্রের সঙ্গে। এরদোয়ানের সরকারের সঙ্গে না।’
প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ।