মিয়ানমারকে অস্ত্র তৈরিতে সহায়তা করছে ১৩ দেশের কোম্পানি - Southeast Asia Journal

মিয়ানমারকে অস্ত্র তৈরিতে সহায়তা করছে ১৩ দেশের কোম্পানি

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

এশিয়ার যেসব দেশের সামরিক বাহিনীর অস্ত্রভাণ্ডার সবচেয়ে সমৃদ্ধ, সেসবের মধ্যে মিয়ানমার অন্যতম। ক্ষমতাসীন জান্তা মূলত টিকেই আছে তার এই অস্ত্রের জোরে; আর সামরিক বাহিনীকে তাদের অস্ত্রভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে সহযোগিতা করে যাচ্ছে অন্তত ১৩টি দেশের কোম্পানি।

মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সাবেক দূত ইয়াংহি লি বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে বিবিসিকে এ তথ্য জানিয়ে বলেছেন, নিজেদের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র-গোলাবারুদের প্রায় পুরোটাই সামরিক বাহিনী অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদন করে; কিন্তু অস্ত্রের কাঁচামালের জন্য দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাবান সামরিক বাহিনী বাইরের অন্তত ১৩টি দেশের বিভিন্ন কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পারমাণবিক অস্ত্র নেই। তবে দেশটির অস্ত্রভাণ্ডারে পর্যাপ্ত পরিমাণ স্নাইপার রাইফেল, উচ্চ প্রযুক্তির বিমান বিধ্বংসী বন্দুক, ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপক, গ্রেনেড, বোমা ও ল্যান্ড মাইনসহ বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তির বিধ্বংসী সব অস্ত্র মজুত আছে।

বিবিসিকে ইয়াংহি লি জানান, কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বহু ধরনের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থাকলেও তারা কখনোই অস্ত্র উৎপাদন বন্ধ করেনি, বরং তাদের অস্ত্র কারখানার সংখ্যা আরও বেড়েছে। ১৯৮৮ সালে ছয়টি অস্ত্র কারখানা থাকলেও তা বেড়ে এখন ২৫টির মতো হয়েছে।

আর এসব কারখানায় কাঁচামাল, অস্ত্র তৈরির প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি দিয়ে সহযোগিতা করছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, ভারত, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রিয়া, তাইওয়ান, জার্মানি, রাশিয়া, ইউক্রেনসহ আরও অন্তত ২টি দেশ।

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অস্ত্রের জোগানের ওপর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছে বিবিসি। প্রতিবেদনটি প্রস্তুতে ইয়াংহি লি ছাড়াও সহাযোগিতা করেছেন ক্রিস সিডোটি এবং মারজুকি দারুসমান। এই দু’জন জাতিসংঘভিত্তিক তদন্ত সংস্থা ‘ইউএন’স ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন অন মিয়ানমার’র সদস্য।

বিবিসির প্রতিবেদকরা বলেছেন, অস্ত্র উৎপাদনের পুরো নেটওয়ার্কের একটি ভগ্নাংশ মাত্র উন্মোচন করতে পেরেছেন তারা; আরও বলেছেন, প্রাথমিক ভাবে এতে ১৩ দেশের যুক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেলেও তাদের ধারণা— আরও বেশ কয়েকটি দেশ এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে অস্ত্র তৈরিতে চীনের কাঁচামাল ব্যবহৃত হচ্ছে বলে শনাক্ত হয়েছে। এসব অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত লোহা ও তামা চীন ও সিঙ্গাপুর থেকে এসেছে বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে।

ফিউজ ও ইলেকট্রনিক ডেটোনেটর ভারতীয় ও রাশিয়া কোম্পানিগুলো সরবরাহ করেছে। সরবরাহের রেকর্ড ও সামরিক বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

মিয়ানমারের অস্ত্র কারখানাগুলোতে যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলো জার্মানি, জাপান, ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে বলে বলা হয়েছে। এসব যন্ত্রপাতি পরিচালনার সফটওয়্যারগুলোর উৎস ইসরায়েল ও ফ্রান্স।

এসব ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর ট্র্যানজিট কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে প্রতিবেদটিতে বলা হয়েছে। সিঙ্গাপুরের কোম্পানিগুলো মিয়ানমারের সামরিক ক্রেতা ও বাইরের বিশ্বের সরবরাহকারীদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে।

উদ্দেশ্য গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঠেকানো
প্রতিবেশী কোনো দেশ বা শক্তি মিয়ানমারকে আক্রমণ করবে— এমন কোনো পরিস্থিতি কখনও সৃষ্টি হয়নি; আবার মিয়ানমার কোনো দেশে অস্ত্রও রপ্তানি করে না। তাহলে কেন দেশটির সেনাবাহিনী প্রতিনিয়ত নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডার আরও বেশি সমৃদ্ধ করতে এত তৎপর?

প্রশ্নের উত্তরে ইয়াং হি জানিয়েছেন, মূলত নিজ দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঠেকানোই সামরিক বাহিনীর এই তৎপরতার প্রধান উদ্দেশ্য।

ইয়াংহি লি বলেন, ‘১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতালাভেল পর থেকে এ পর্যন্ত মিয়ানমারে বিদেশী কোনো রাষ্ট্র হামলা চালায়নি, ভবিষ্যতে হামলা চালাবে এমন সম্ভাবনাও খুব কম।’

‘সামরিক বাহিনীর এই সমৃদ্ধ অস্ত্রভাণ্ডারের মূল উদ্দেশ্য বেসামরিক গণতন্ত্রপন্থী শক্তিকে ঠেকানো। ১৯৫০ সাল থেকেই তারা নিজেদের অস্ত্র নিজেরা তৈরি করছে এবং তা ব্যবহার করছে সাধারণ বেসমারিক লোকজনের ওপর।’

২০২০ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন সরকারকে উচ্ছেদ করে জাতীয় ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। সেনাপ্রধান মিন অং হ্লেইং এ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন। বর্তমানে ক্ষমতাসীন জান্তা সরকারের প্রধানও তিনি।

অভ্যুত্থানের পরপরই দেশটির বেসামরিক গণতন্ত্রপন্থী জনগণ সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। সেই আন্দোলনকে দমন করতে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেয় জান্তা।

এই নির্দেশ দেওয়ার পর থেকে গত এক বছরে সরকারি বাহিনীর গুলিতে মিয়ানমারে প্রাণ গেছে ২ হাজার ৬০০ জনেরও বেশি মানুষের। এই নিহতদের প্রায় সবাই বেসামরিক জনগণের অন্তর্ভুক্ত।

বিবিসির মিয়ানমার শাখার প্রধান সোয়ে উইন তান বলেন, ‘যখন এটা (বেসামরিক লোকজনকে হত্যা) হয়েছিল…কোথায় গিয়ে (তারা) থামবে— এমন আশঙ্কায় ছিলাম আমরা। তবে সম্প্রতি, বেসামরিক লোকজনের ওপর গুলিবর্ষণ খানিকটা কমেছে।’

‘সাধারণ লোকজনকে গুলি করার বদলে জান্তা এখন সরকারবিরোধী সশস্ত্রগোষ্ঠীগুলোর আস্তানার সন্ধান চালাচ্ছে এবং কোনো আস্তানার সন্ধান পাওয়া মাত্র বিমান বাহিনীর সদস্যরা সেখানে গোলাবর্ষণ করছে,’ বিবিসিকে বলেন সোয়ে উইন তান।