উত্তপ্ত মণিপুর: পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ্যের লোকজনকে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে - Southeast Asia Journal

উত্তপ্ত মণিপুর: পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ্যের লোকজনকে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

চারিদিকে শুধু বোমা গুলির শব্দ, বিদ্যুৎ নেই, মোবাইল সংযোগ নেই, ইন্টারনেট নেই, পর্যাপ্ত খাদ্য নেই, খাবার পানি নেই, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বাজার, বোমা মেরে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শপিং মল, জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে পাহাড়ের বন জঙ্গল থেকে শহরের হাজার হাজার বাড়িঘর। ইউক্রেন বা সুদানের যুদ্ধক্ষেত্রের কথা বলছি না, এমন অবস্থা প্রতিবেশী ভারতের! তিন দিনের টানা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে ভারতের মণিপুর রাজ্যের পরিস্থিতি। এমন অবস্থায় রাজ্যটিতে আটকে পড়া ভারতের অন্যান্য রাজ্যের নাগরিকদের উদ্ধারে শুরু হয়েছে অভিযান। প্রায় প্রতিটি রাজ্যই তাদের নাগরিকদের সুস্থভাবে ফিরিয়ে নিতে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শুরু করেছে উদ্ধার অভিযান।

মাত্র ৩২ লাখ জনসংখ্যার রাজ্যটিতে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে চাকরি ও পড়াশোনার সূত্রে থাকেন অন্তত তিন লাখ ভারতীয়। মণিপুরে জাতিগত সংঘর্ষ শুরু হলে রাতারাতি সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গিয়ে মণিপুর পরিণত হয় বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপে। সেখানে অবস্থানরত ভারতের অন্যান্য রাজ্যের নাগরিকদের অবস্থা হয় ইউক্রেন বা সুদানে আটকেপড়া ভারতীয়দের মতোই। ভয়ানক এমন পরিস্থিতি থেকে ফেরার পর নাগরিকদের চোখে মুখে আজও আতঙ্কের ছবি।

কলকাতা বিমানবন্দরের থ্রি সি গেটের পাশে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের জন্য রাজ্য সরকারের তরফে করা হয়েছে হেল্প ডেস্ক। রাখা হয়েছে গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা। গতকাল রোববার থেকে মনিপুরের পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলে অন্যান্য রাজ্যের মতোই সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের উদ্ধার অভিযোগ শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। সোমবারও প্রথম দফায় সকাল সাড়ে ১১টার ফ্লাইটে প্রায় ১৮ জন ছাত্র-ছাত্রীকে উদ্ধার করে কলকাতায় আনা হয়।

কলকাতায় ফিরে আসা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানায়, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বসবাস তাদের। নার্সিং ট্রেনিং, স্নাতক, স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনার জন্য রাজ্যটিতে গিয়েছিলেন তারা। কিন্তু পড়াশোনা মাঝপথে রেখেই প্রাণ বাঁচাতে ফিরতে হলো তাদের। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজ্যটিতে কেন্দ্রীয় স্তরের পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। আপাতত পড়াশোনার ভবিষ্যৎ নিয়ে অন্ধকারে তারা। তবে মণিপুরের ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে ঘরে ফিরতে পেরে আপাতত স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলছেন তারা।

পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের বাসিন্দা প্রসেনজিৎ বর্মন মণিপুরে গিয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। আজ সোমবার কলকাতা বিমানবন্দরের নেমে তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি ভয়াবহ। দিনে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি মনে হলেও রাত হলেই বোমা-গুলির শব্দ, টায়ার জ্বালিয়ে দেওয়ার ছবি একেবারেই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আতঙ্কে সন্ধ্যা নামলেই ঘরের লাইট বন্ধ করে বসে থাকতে হচ্ছিল। মোবাইলে কানেকশন ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছিল না, ইন্টারনেট সম্পূর্ণ বন্ধ। মেসের খাবারও শেষ হয়ে এসেছিল, যেহেতু বাজার জ্বালিয়ে দিয়েছে তাই নতুন করে খাবার সংগ্রহের পরিস্থিতি নেই। অন্যান্য রাজ্যের যেসব বন্ধুরা ছিল, তাদের নিজের নিজের রাজ্য উদ্ধার করে নিয়ে চলে যাচ্ছে। আমার অবস্থায় আমারও চলে আসা ছাড়া উপায় ছিল না।’

মালদার তার চাচোলের বাসিন্দা ২২ বছর বয়সি সিমরান পারভীন বলেন, ‘ওখানকার পরিস্থিতি, পরিবেশ এখনও ভয়াবহ। স্টুডেন্টদের জন্য ওখানকার লোকালিটির জন্য ভয়াবহ ক্ষতি হয়ে গেল। আমাদের সর্বভারতীয় স্তরে সব পরীক্ষা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। পানি নেই, খাবার নেই। এমন হয়েছে তিন দিন একটানা পানি আসেনি, যতটুকু ছিল তার মধ্যেই আমাদের থাকতে হয়েছে। শপিং মল বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার পর থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হতো। পরিবেশের মারাত্মকভাবে ক্ষতি হচ্ছে, আমরা নিজের চোখে দেখেছি কিভাবে গোটা পাহাড়ের জঙ্গল একসঙ্গে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন জানি না কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, আবার কবে ফিরতে পারব।’

ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি উৎকণ্ঠায় ছিলেন অভিভাবকরাও। আটকেপড়া ছাত্রী দিশারী বিশ্বাসের বাবা মৃদুল বিশ্বাস ও মা দোলা বিশ্বাস বলেন, দিনে ১৮ থেকে ২০ বার আমরা ফোনে যোগাযোগ করতাম। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আমলাদের ক্রমাগত ফোন করেছিলাম মেয়েকে ফিরিয়ে আনার জন্য। শুরুতে আমরা আতঙ্কে ছিলাম। তবে ভয় পেয়ে বসে থাকলে চলবে না, মেয়েকে মনে সাহস যুগিয়েছিলাম।’

এদিকে ফোনে মনে পড়ে আটকে থাকা কলকাতার চিকিৎসক আহেলি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এখনও দলাই লামা আর্মি ক্যাম্পে আটকে আছি। আমার মতো সাড়ে তিন হাজার মানুষ এখনও আটকে আছে। গতকাল থেকে বোমা-গুলির শব্দ শোনা না গেল বাইরে বেরনোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। সব থেকে খারাপ অবস্থা রাজধানী ইম্ফলের। আর্মিও এসকর্ট করে আমাদের গাড়ি বিমানবন্দর পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার রিস্ক নিতে চাইছে না।’

চিকিৎসক আহেলি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘মেঘালয়, নাগাল্যান্ড রাজ্য তাদের লোকজনকে এই পরিস্থিতির মধ্যেও নিয়ে গিয়েছে। কেরালা আজ তাদের সব লোককে বিশেষ উড়োজাহাজে করে নিয়ে যাবে। মিজোরাম ত্রিপুরার লোকজনকে গতকাল রাত থেকে ওদের রাজ্য সরকার উদ্ধার করছে। আমরা তামিলনাড়ু, রাজস্থান ও পশ্চিমবঙ্গের অনেকেই এখনও মণিপুরীদের সঙ্গেই আটকে আছি। কলকাতা নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি কিন্তু এখনও যোগাযোগ করতে পারিনি। মণিপুর রাজ্য সরকার এতটাই বিধ্বস্ত যে, ওদের পক্ষে সাহায্য করা আর সম্ভব নয়। গতকাল থেকেই খাবার-দাবারের সংকট শুরু হয়েছে। আমাদের সকালে খাবার দেওয়ার পর আর্মিদের থেকে বলে দেওয়া হলো দুপুরে কী খাবার দিতে পারব এখনও ঠিক নেই। এত মানুষের খাবার একসঙ্গে জোগাড় করা সত্যিই কঠিন। এতদিন ওরা টাউনে গিয়ে বন্ধ দোকানগুলোর শাটার ভেঙে যা খাবার পাচ্ছিল আমাদের জন্য নিয়ে আসছিল। এখন সেটুকুও জোগাড় করা যাচ্ছে না।’

ভারতের উত্তর-পূর্বের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য মণিপুরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতিদের তপশিলি জনজাতি গোষ্ঠীর মর্যাদার দাবি ঘিরে গত বুধবার (৩ এপ্রিল) রাত থেকেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মণিপুর। রাজ্যটির বিভিন্ন এলাকায় দফায় দফায় উত্তেজনা দেখা দেয় মেইতেই, কুকি, নাগাসহ একাধিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে। ১০ জেলায় ‘ট্রাইবাল সলিডারিটি মার্চ’ কর্মসূচির কারণে বিভিন্ন জায়গায় যুবকদের মধ্যে সংঘর্ষ চরম আকার ধারণ করে। পুড়িয়ে দেওয়া হয় হাজার হাজার ঘরবাড়ি, গাড়ি ও দোকান। মন্দির, গির্জায় অগ্নিকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে। পরিস্থিতি স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও আসাম রাইফেলসের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

এর পরেই মণিপুরের আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাজ্যটির ৮টি জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করে রাজ্য প্রশাসন। গুজব প্রতিরোধে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয় । একইসঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দেখামাত্রই গুলি করার নির্দেশও জারি করেছে মণিপুরের বিজেপি সরকার। সব মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত ৫৪ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। বেসরকারি মতে মৃতের সংখ্যা ১০০ জনের বেশি। ভারতের সেনাবাহিনী বলছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আসামের দুটি এয়ারফিল্ড থেকে লাগাতার কাজ করে যাচ্ছে ভারতীয় বায়ুসেনার সি১৭ গ্লোবমাস্টার এবং এএন৩২ বিমান।